চীনের জিরো কোভিড নীতি

বছরের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক আতঙ্ক

অরুন্ধতী বসু

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২২, ১২:০৫ পিএম

বিশ্বের ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দরগুলোর মধ্যে সাংহাই অন্যতম। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দরগুলোর মধ্যে সাংহাই অন্যতম। ছবি: সংগৃহীত

বেইজিংয়ের ‘ডায়নামিক জিরো-কোভিড’ নীতি শুধু চীনের অর্থনীতি নয়, বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে।

এর দুটি কারণের মধ্যে প্রথম কারণটি সবচেয়ে স্পষ্ট যে, চীনা অর্থনীতির আকার রাশিয়ার চেয়ে ১০ গুণ বড়। আর তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি বড় ইউক্রেনের অর্থনীতির আকারের তুলনায়। দ্বিতীয় কারণ- অন্যান্য কোভিড ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে মৃদু প্রমাণিত হয়েছে ওমিক্রন। বিশ্ব কোভিড সংকট নিয়ে এ মুহূর্তে সেভাবে উদ্বিগ্ন না থাকলেও, ডায়নামিক জিরো কোভিড নীতিতে অটল রয়েছে চীন। এই নীতি মূলত কঠোর বিধিনিষেধকে বোঝায়। এসব বিধিনিষেধের মধ্যে রয়েছে সরাসরি ‘লকডাউন’ ব্যবস্থা। 

চীনের বেশ কিছু শহরে এরই মধ্যে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। এই শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সাংহাই। দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শহরটির অবদান ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে চীনের মহাসড়কগুলো দিয়ে পণ্য পরিবহনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। সীমাবদ্ধতার দরুণ সমুদ্র বন্দরগুলোও সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না। চীনের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র সাংহাইয়ে বাস প্রায় ২ কোটি ৩ লাখ মানুষের। অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থল হওয়ার পাশাপাশি সেমিকন্ডাক্টর, ইলেকট্রনিকস ও গাড়ি উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত সাংহাই। সাংহাইয়ে এখন বেশিরভাগ কারখানার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বিশ্বের ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দরগুলোর মধ্যে সাংহাই অন্যতম। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে প্রথম করোনা শনাক্তের পর এটিই এখন পর্যন্ত সাংহাইয়ে আরোপিত দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন। 

আন্তর্জাতিক ব্যবসার জন্য মেইনল্যান্ড চায়নায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য সাংহাই। শহর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের শেষে পর্যন্ত ৮০০টিরও বেশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সাংহাইয়ে আঞ্চলিক বা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- অ্যাপল, কোয়ালকম, জেনারেল মটরস (জিএম), পেপসিকো, টাইসন ফুডসসহ ফরচুন গ্লোবাল ৫০০ তালিকাভুক্ত ১২১টি কোম্পানি। সাংহাইয়ে বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানির কার্যালয় রয়েছে ৭০ হাজারের বেশি। জাপান সরকারের তথ্য অনুযায়ী, শহরটিতে জাপানি মালিকানাধীন কোম্পানির সংখ্যা ২৪ হাজার ছাড়িয়েছে। ৭ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জে লকডাউন সত্ত্বেও চলছে লেনদেন। এই স্টক এক্সচেঞ্জটি চালু হয় ১৯৯০ সালে। 

গত বছরের অফিসিয়াল তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সাথে চীনের ব্যবসার ১০ দশমিক ৪ শতাংশ দখলে রয়েছে সাংহাইয়ের। এই সাংহাই বন্দরে ২০২১ সালে হ্যান্ডলিং হয় ৪ কোটি ৭০ লাখ ২০ ফুট ইক্যুইভ্যালেন্ট ইউনিটস কন্টেইনার, যা লস অ্যাঞ্জেলস বন্দরের তুলনায় ৪ গুণ বেশি।  

এশিয়ার সবচেয়ে বড় বিমান বন্দর সাংহাইয়ে। শহরটির পাংডং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং হংকিয়াং বিমানবন্দর ২০১৯ সালে ১২ কোটি ২০ লাখ যাত্রী পরিচালনা করেছে। এর মধ্য দিয়ে লন্ডন, নিউইয়র্ক ও টোকিওর পর বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ ব্যস্ততম কেন্দ্রে পরিণত হয় এই শহর; কিন্তু কোভিড মহামারি শুরুর পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়ে যায়। সাংহাই সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম সচল থাকলেও গত মাসের তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, অপারেশনাল কার্যক্রমে বিলম্ব হওয়ায় অপেক্ষমান পণ্যবাহী জাহাজের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্দরে পণ্যবহী ট্রাকের প্রবেশ ও বাইরে নির্দিষ্ট সময়ে বের হতেও বেগ পেতে হচ্ছে।

চীনের দেশীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রভাব মার্চের তথ্য-উপাত্তে লক্ষ্যণীয়, বিশেষ করে, সেবা ও উৎপাদন খাতে। এসব খাতের বেশ কয়েকটি কোম্পানি উৎপাদন সাময়িক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চীনের উৎপাদন খাতের আকস্মিক স্থবিরতার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে। কারণ বিশ্বের নানা জায়গায় স্থাপিত কারখানাগুলোয় বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের এক-তৃতীয়াংশ রপ্তানি করে চীন। উপরন্তু আন্তর্জাতিক পরিবহন জটিলতায় পরিবহন ব্যয় বাড়তে পারে। ফলে কাঁচামালের ঘাটতি হওয়ায় দেখা দিতে পারে পণ্য সরবরাহ সংকট। এতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই বাজারে পণ্যমূল্য আরো বাড়বে।

চীনে লকডাউন হলে পরিস্থিতি কেমন হয়, দেখা গিয়েছিল ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে। কোভিড মহামারি শুরুর পর সেই সময় দেশটির সীমানা বন্ধ করে দেওয়া হয় বিশ্বের জন্য। বিশ্ব অর্থনীতিতে এই অবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ও নেতিবাচক প্রভাব দেখা গিয়েছিল। চীনা পর্যটকের অভাবে থাইল্যান্ডের মতো দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যায়। মহামারি শুরুর পর চীনের বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ থমকে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ব্যবসায়িক বিনিময়ে মন্দা। এটি বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনীতির জন্য প্রাসঙ্গিক। কারণ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো অবকাঠামো নির্মাণ এবং শিল্প সক্ষমতা উন্নয়নে বিদেশি পুঁজির ওপর নির্ভরশীল। চীনের বন্ধ সীমান্তের দ্বিতীয় পরিণতি- চীন এবং বিশ্বের মধ্যে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব। কোভিড মহামারির প্রাদুর্ভাব দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে বা বাড়তে থাকলে বেইজিংয়ের জিরো-টলারেন্স প্যানড্যামিক স্ট্র্যাটেজি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রায়। 

দেশের স্থবির পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারী এবং প্রধান শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার কিনতে বলা হবে বলে গত সপ্তাহে ঘোষণা দিয়েছে চায়না সিকিউরিটিজ রেগুলেটরি কমিশন। গত মাসে বন্ডে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন এবং স্টকে ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল কমিশন। বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অনেক বিশ্লেষক চীনা অর্থনীতির স্থবিরতা দূরীকরণে সুদহার কর্তন, ঋণদান নীতিমালা শিথিলের মতো পদক্ষেপ আশা করছেন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh