হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু ঠেকাবে কে?

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২২, ০৩:০১ পিএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু রোধে ২০১৩ সালে একটি কঠোর আইন করা হলেও, এ বাহিনীর সদস্যরা যে এই আইনের থোড়াই তোয়াক্কা করেন না তার সর্বশেষ উদাহরণ লালমনিরহাটের যুবক রবিউল; পুলিশি নির্যাতনে যার মৃত্যুর অভিযোগ এনেছে তার পরিবার।

এর মাস দুই আগেই গত ফেব্রুয়ারিতে সুনামগঞ্জে চুরির মামলায় গ্রেপ্তারের পর জামিনে মুক্তির ১১দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় উজির মিয়া নামে আরেক যুবকের মৃত্যু হলে তার পরিবারও পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিল এবং পুলিশের কাছে আটক অবস্থায় নির্যাতনের ফলেই উজির মিয়ার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করে। পরিবার, স্বজন ও স্থানীয় ক্ষুব্ধ মানুষ তার লাশ নিয়ে মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধ পর্যন্ত করে। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত এসআই দেবাশীষ সূত্রধর ও আলাউদ্দিনকে আসামি করে মামলাও করা হয়। সর্বশেষ লালমনিরহাটেও রবিউল ইসলাম নামে এক যুবকের নিহতের ঘটনায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছিল।

রবিউলের স্ত্রী মনিরা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ তাকে বিধবা করে দিয়েছে। তার ৮ মাস বয়সের সন্তানকে অনাথ করেছে। রবিউল ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তারা এখন কী নিয়ে বাঁচবেন? তার অভিযোগ, পুলিশের সাথে বাকবিতণ্ডার জেরে তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, লালমনিরহাট সদর উপজেলার হারাটি ইউনিয়নের কাজীর চওড়া গ্রামে বৈশাখী মেলা থেকে কাঠ ব্যবসায়ী রবিউলকে আটক করেন পুলিশ। এ সময় রবিউল নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে পুলিশের সাথে বাকবিতণ্ডা করেন। পরে তাকে লালমনিরহাট সদর থানার এসআই হালিমুর রহমানসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাকে নির্যাতন করেন। ওই রাতে রবিউলকে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০২০ সালের অক্টোবরে সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে হেফাজতে থাকা অবস্থায় রায়হান আহমদ নামে এক যুবক নিহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় একটি হত্যা মামলা করা হলেও, মামলার অন্যতম সাক্ষী চুনাই লাল ‘আত্মহত্যা’ করেন।

শুধু তাই নয়, আরেক সাক্ষী হাসানকেও সাক্ষ্য না দিতে ‘হুমকি’ দেওয়া হয়। একজন সাক্ষীকে সাক্ষ্য না দিতে হুমকি দেওয়ার সময়ে আরেকজন সাক্ষীর ‘আত্মহত্যা’ নিতান্তই আত্মহত্যা কি-না সে প্রশ্নও উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই? রায়হান আহমদের মৃত্যুর পরের দিন তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তে প্রথমে পুলিশ ছিল। পরে সে বছরের ১৩ অক্টোবর মামলাটি স্থানান্তর করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে। ২০২১ সালের ৫ মে আদালতে ১ হাজার ৯০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। মূল অভিযুক্ত এসআই আকবরসহ যে ছয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে পাঁচজনই পুলিশ সদস্য।

মনে রাখা দরকার, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগগুলো খুবই গুরুতর। এটি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন বা দু’জন বা কয়েকজন সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধ এবং তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার ইস্যু নয়। বরং এর সাথে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রশ্ন জড়িত। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো কীভাবে চলছে এসব মৃত্যু হত্যা বা নির্যাতনের ঘটনায় সেই প্রশ্নটি বারবারই ঘুরে ফিরে সামনে আসে, যা রাষ্ট্রকে বিব্রত করে। সুতরাং রাষ্ট্র বিব্রত হয়, এমন কোনো ঘটনা ঘটলে, সেটি ধামাচাপা দেওয়া কিংবা অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত করা কিংবা ঘটনার সত্যতা প্রমাণের পথে বিবিধ অন্তরায় সৃষ্টির প্রচেষ্টা যে চলবে, সেটি অস্বাভাবিক নয়। এখন প্রশ্ন হলো, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু কেন বন্ধ হয় না বা কে বন্ধ করবে? 

প্রসঙ্গত, এখন পর্যন্ত এই আইনে একটি মাত্র বিচার হয়েছে আইনটি পাশের সাত বছর পরে, ২০২০ সালে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, দেশের ইতিহাসে প্রথম এই আইনে দায়ের করা একটি মামলার রায় হওয়ার ঠিক এক মাসের মাথায় সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান নামে ওই যুবককে নির্যাতনে হত্যা করা হয়। তার মানে পুলিশ এই আইনকে যে বারবার বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে বা দেখাতে পারছে, তা প্রমাণিত। 

২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস হয় নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন; কিন্তু এরপর থেকে এই আইনে এ পর্যন্ত কতগুলো মামলা হয়েছে এবং কতগুলো মামলার বিচার শেষ হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০২০ সালের প্রথম আট মাসেই জেল কাস্টডিতে মারা গেছেন ৫৩ জন। 

মুশকিল হলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো বটেই, রাষ্ট্রের সব আইন এমনভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সুরক্ষা দেওয়া হয় যে, কোনো একটি আইন জনবান্ধব হলেও ওই আইনের আওতায় অপরাধসমূহ বন্ধ হয়ে যায় না। হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বন্ধ না হওয়ার পেছনে এটিই মূল কারণ। কারণ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হলেও, হয়রানির ভয়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা পরিবার সাধারণত আইনের আশ্রয় নিতে চায় না। রাষ্ট্র তাকে সেই সুরক্ষাও দিতে পারে না। 

কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় নাগরিকদের নির্যাতন ও হত্যার বিচার হয় না বা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেন মামলা হয় না তার একটি বড় কারণ অপরাধের জবাবদিহি না থাকা। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর মনে এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, খুব ব্যতিক্রম না হলে এ সব নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো আইনের আশ্রয় নেবেন না। আবার আইনের আশ্রয় নিলেও, সেখান থেকে নানা কৌশলে বেরিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে। পুরো তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রয়েছে এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকেই যে কোনো অপরাধকে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত’ বলে প্রমাণেরও সুযোগ রয়েছে।

ফলে পুরো সিস্টেমই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীকে বেপরোয়া হতে সহায়তা করে। জনগণের সুরক্ষায় প্রণীত ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ বাতিলে বিভিন্ন সময়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছে। যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জনগণের প্রতিনিধি সংসদ সদস্যরা যথেষ্ট আলাপ আলোচনা আর বিচার বিশ্লেষণের পরে মানবাধিকারের সুরক্ষায় একটি আইন পাস করলেন, পুলিশের মতো একটি বাহিনীর কী করে সেই আইন বাতিল চায়, বা কী করে তাদের এই দাবি তোলার সাহস হয় সেটি বরং প্রশ্ন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh