নানা সংকটে বিপর্যস্ত রাজধানীবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২২, ০৯:১৩ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

বিভিন্ন সংকটে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন রাজধানীবাসী। ঘর থেকে বের হলে যানজট, বায়ু আর শব্দদূষণে বিপর্যস্ত হতে হয়। আর ঘরে ফিরলে পানি বা গ্যাস সংকটে নাকাল হতে হয়। শুধু তাই নয়, মশার যন্ত্রণায় সারারাত নির্ঘুম কাটাতে হয় মধ্য ও নিম্নবিত্তের লাখো মানুষকে। সেইসাথে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর লাগামহীন বাড়ি ভাড়ার চাপ আছে।

বর্তমানে উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে ঢাকার যানজট পরিস্থিতি। ট্র্যাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চল থাকাটাই যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই যানজটের কারণ কী তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে তো চলছেই। এর মধ্যে যানজট নিরসনে নেওয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা, এমনকি মহাপরিকল্পনাও; কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এসব অপরিকল্পিত পরিকল্পনার কারণেই ঢাকার যে সড়ক আজ ‘ওয়ান ওয়ে’, কালই তা হয়ে যাচ্ছে ‘টু ওয়ে’। আজ এই সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ তো কাল আবার খুলে দেওয়া হচ্ছে। কোনো রাস্তায় আবার চলছে আইল্যান্ড বা সড়ক দ্বীপ তৈরি এবং ভাঙার খেলা।

সম্প্রতি যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতীয় সংসদে জানান, একটি আধুনিক নগরীতে মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ ভাগ রাস্তা বা সড়ক থাকা প্রয়োজন; কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র সাত থেকে আটভাগ। প্রয়োজনের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সড়ক আছে এই শহরে। ঢাকা শহরের মোট এলাকা ১৩৫৩ বর্গ কিলোমিটার, আর বর্তমান রাস্তার আয়তন ২,২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক। 

অন্যদিকে ট্র্যাফিক বিভাগের হিসাব মতে, সড়কের কম করে হলেও ৩০ ভাগ বা তারও বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং নানা ধরনের দখলদারদের কারণে। এছাড়া ফুটপাথ হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই পায়ে হেঁটে চলেন নগরবাসী। ফলে যানজটের সাথে আছে জনজট। কোন পন্থায় এই শহর যানজটমুক্ত হবে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনাও নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, বর্তমানে বায়ুদূষণে ধুলার সাথে যুক্ত হয়েছে গাড়ি ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া। বর্তমানে বাতাসে ধুলা আগের চেয়ে পরিমাণে বেড়েছে। 

তিনি আরো বলেন, আগে এত মেগা প্রজেক্ট ও গাড়ি ছিল না। পাশাপাশি ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাশয় ভরাট হওয়ায় ধুলার নতুন উৎস জন্মেছে।

সম্প্রতি শব্দদূষণেও বিশ্বের শীর্ষ স্থান দখল করেছে ঢাকা। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। শব্দদূষণে ঢাকার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। শব্দদূষণে বাংলাদেশেরই আরেক শহর রাজশাহী রয়েছে চতুর্থ স্থানে। আর পঞ্চম অবস্থানে ভিয়েতনমের হো চি মিন শহর। 

এদিকে গরমের শুরুতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানির সংকট। কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার ধর্ণা দিয়ে সমাধান না পাওয়ায় মিরপুরবাসী ওয়াসা অফিস এবং উত্তরার আশকোনা এলাকাবাসী রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুরাদ হোসেন বলেন, বেশকিছু দিন ধরেই এলাকার মানুষ ওয়াসার পানি সংকটে ভুগছে। খুবই খারাপ অবস্থা। আগে সংকট হলে কাউন্সিলর হিসেবে আমাকে বিনামূল্যে পানি দিত; কিন্তু এখন আমাকেও পানি দিচ্ছে না। আমাকেও ওয়াসার গাড়ির পানি কিনে খেতে হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, এলাকার পানি সংকটের বিষয়টি জানিয়ে আমি ওয়াসা অফিসে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তারপরও এখনো পানি সংকট দূর হয়নি। ওয়াসার কর্মকর্তাদের ফোন দিলেও তারা ধরছেন না।

একই ধরনের মন্তব্য করেন ডিএনসিসির ৮ ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাসেম মোল্লা। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গরমকালে অত্র এলাকায় পানির সংকট দেখা দেয়। চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় এলাকাবাসীর। ওয়াসার কাছে বারবার ধর্ণা দিয়েও প্রতিকার পাওয়া যায় না।

এ বিষয়ে ওয়াসার স্থানীয় মডস জোনের-৪ নির্বাহী প্রকৌশলী ইকবাল আহমেদ মজুমদার বলেন, গরম বেড়ে যাওয়ায় পানির চাহিদা বেড়েছে। এছাড়া মিরপুর এলাকায় পাম্পের পানি ব্যবহার করা হয়; কিন্তু গরমের সময় পানির স্তরও ২/৩ মিটার নিচে নেমে যাওয়ায় পানির উৎপাদন কমে গেছে। এ কারণে কয়েকটি এলাকায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে। তবে আমরা বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করছি।

জানা যায়, সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার থেকে যেসব এলাকায় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে, সে সব এলাকায় পানি সংকটের পাশাপাশি দুর্গন্ধও বেড়ে গেছে। এতে ওইসব এলাকার বাসিন্দারা বেশ সংকটে পড়েছেন। যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মানিকনগর, বাসাবো এলাকার বাসিন্দারা গত কয়েক দিন ধরেই পানি সংকট ও দুর্গন্ধজনিত সমস্যায় ভুগছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানি সংকটের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, গরমের সময় পানির স্তর দুই-তিন মিটার করে নিচে নেমে যায়। এ কারণে  যে পাম্পে  দৈনিক আড়াই হাজার লিটার পানি উৎপাদন হতো, সেখানে এখন ১৮শ’ লিটার পানি উৎপাদন হচ্ছে। 

রাজধানী বিভিন্ন এলাকাতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে গ্যাস সংকট। আর রমজানে বেশ কিছু এলাকায় এই সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। রাজধানীর অনেক এলাকায় দিনভর চুলাই জ্বলছে না। গ্রিনরোড, ইস্কাটন, বাংলামটর, ৬০ ফিট, রামপুরা, ধানমন্ডি, মিরপুর, উত্তরা, ওয়ারিসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে এই সংকট। আগামী এক সপ্তাহ এই অবস্থা চলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গ্যাস সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করে বিদু্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা  হয়েছে, শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের কাজের জন্য এমনটা ঘটেছে। দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি বিবিয়ানা।  সেই  ক্ষেত্রের ছয়টি কূপ বন্ধ রয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে রাজধানীতে। 

এদিকে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি সড়ক, বাসা-বাড়ি,গণপরিবহন সর্বত্রই এখন মশার উপদ্রব। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) কিউলেক্স মশার মোট ৯২৫টি হটস্পট শনাক্ত করা হয়। এসবের মধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সাঁতারকুল। এরপর রয়েছে মিরপুর।

রাজধানীবাসীর এই ভোগান্তির সম্পর্কে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস এমপির সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উত্তর সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না করে কাজ করলে নাগরিক ভোগান্তি আরো বাড়বে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh