দেশে আশঙ্কাজনক হারে ধর্ষণ বাড়ছে

হাসান হামিদ

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২২, ০৩:২১ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকায় এমন কোনো দিন নেই, যেদিন ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয় না। প্রায় প্রতিদিনই সংগঠিত হচ্ছে ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনা। 

পরিসংখ্যান বলছে, ভয়াবহ এমন অপরাধের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। 

সর্বশেষ ২০২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে সংঘটিত অপরাধের ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি প্রকাশিত মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) করা এক গবেষণা বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১০৩টি। আর জানুয়ারি মাসে এই সংখ্যা ছিল ৬৫টি। সে হিসাবে জানুয়ারি মাসের তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দেড় গুণেরও বেশি। মার্চ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৬৯টি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ২০২১ সালেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ২৩৫ নারী ও শিশু। তাদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৪১। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩১ জনকে। এছাড়া ৩ হাজার ৭০৩ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এই গবেষণা করেছে ১৪টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে বাস্তবতা আরো ভয়াবহ। কারণ সব ধর্ষণের খবর নিশ্চয়ই জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয় না। তাছাড়া অনেকে সামাজিক লোক লজ্জার ভয়ে এসব চেপেও যান।

সরকারের হিসাবেও বিগত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এবং রাহাজানির সংখ্যা বেড়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত ২০২০-২১ অর্থবছরের কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মোট ঘটনা ছিল ২১ হাজার ৭৮৯টি, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ১৮ হাজার ৫০২টি। সে হিসেবে মহামারিতে এক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। 

এদিকে ডয়েচে ভেলেতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, বিদেশি বাংলাদেশে ধর্ষণের হার প্রতি লাখে ১০ জন এবং সমগ্র বিশ্বে আমাদের অবস্থান ৪০তম। ধর্ষণের বেলায় বাংলাদেশের থেকে নিম্ন পর্যায়ের দেশগুলোর মধ্যে আছে- দক্ষিণ আফ্রিকা, লেসেঙ্গো, বোতসোয়ানা, সোয়াজিল্যান্ডের নাম।

দেশে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৩২১ নারী ও শিশু। আর ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬২৭ জন। আসকের গত ৫ বছরের (২০১৭ থেকে ২০২১ সাল) তথ্য বলছে, ৫ হাজার ৯১১ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৮৬ জনকে। আর ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৫১ জন নারী ও শিশু। এ সময়ে ১ হাজার ৫০ নারী ও শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।

আমাদের দেশে ‘জাতীয় কন্যাশিশু এ্যাডভোকেসি ফোরাম’ নামে একটি সংগঠন আছে। কিছু দিন আগে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন’ প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলন করেছিল তারা। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪টি জাতীয়, স্থানীয় ও অনলাইন দৈনিক পত্রিকা থেকে ৬ থেকে ১৯ বছর বয়সের কন্যাশিশুদের প্রতি নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করে তারা গবেষণা করেছেন। তাদের সেই সংবাদ সম্মেলনে ২০২১ সালে বছরব্যাপী সারাদেশে কন্যাশিশু নির্যাতন নিয়ে জরিপ প্রকাশ করা হয়।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে সারা দেশে ১ হাজার ১১৭ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭২৩ আর দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ১৫৫ জন। এছাড়া ২০০ প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে দেশে কন্যাশিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৬২৬টি। 

এই হিসাব অনুযায়ী, এক বছরে দেশে কন্যাশিশু ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৪.৪৪ শতাংশ। ২০২১ সালে মোট ১১৬ কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৫ জন বিশেষ শিশুও রয়েছে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১০৪ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছর যৌন হয়রানি বৃদ্ধির হার প্রায় ১২ শতাংশ। 

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দেশে প্রতিদিন সহস্রাধিক কন্যাশিশু পর্র্ণোগ্রাফি ও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। এর মধ্যে গড়ে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন ভিকটিম সাইবার হয়রানি সম্পর্কিত অভিযোগ কেন্দ্রে মৌখিক ও লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল করে। প্রতিদিন ৩০টি অভিযোগ দাখিল হলে মাসে আনুমানিক ৯০০টি অভিযোগ জমা হয় বলে ধরে নেওয়া যায়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সূত্র বলছে, ২০২১ সালে রাজধানীতে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ২ হাজার ২১৮টি। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৫৪৬টি ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৪২০টি। ডিএমপিতে গত ৫ বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৮টি। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা হয়েছে দুই হাজার ৪৪৬টি এবং শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ১ হাজার ৭৯০টি। 

পুলিশের তদন্ত সংস্থা বলছে, রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, সামাজিক অস্থিরতা, আইন ও রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা, পারিবারিক ও সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং নারীর প্রতি নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারের অভাবে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ বাড়ছে। তাই এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে অপরাধীকে দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। 

অনেকে মনে করেন, প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং পারিবারিক ও সামাজিকসহ নানা কারণে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের সব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। তবে ধর্ষণের প্রকৃত চিত্র কয়েকগুণ বেশি বলে মনে করেন তারা। বিশেষ করে পরিবার, বন্ধু ও আত্মীয়র মাধ্যমে ধর্ষণের শিকারের তথ্যও খুব একটা প্রকাশ হয় না। 

সর্বশেষ ২০২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে সংঘটিত অপরাধের ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি প্রকাশিত মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) করা এক গবেষণা বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১০৩টি। আর জানুয়ারি মাসে এই সংখ্যা ছিল ৬৫টি। সে হিসাবে জানুয়ারি মাসের তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দেড় গুণেরও বেশি। 

শুধু তাই নয়, আগের মাসের তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে নারী ও শিশু আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে বেশি। সেই সাথে বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতনের সংখ্যা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh