প্রতারণার আরেক নাম মূল্যছাড়

ঈদের কেনাকাটায় ঠকছেন ক্রেতারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২২, ০৯:২৫ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

ঈদকে সামনে রেখে মূল্য ছাড়ের নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বিক্রি বাড়াতে লটারি, বিশেষ ছাড় কিংবা ফ্রি উপহার দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা করছেন দোকানিরা। নগরীর ছোট-বড় শপিংমল, মার্কেট, বিপণিবিতানে চলছে বিশেষ ছাড় ও নগদ মূল্য ছাড়ের ছড়াছড়ি।

কেউ দিচ্ছেন একটা কিনলে একটা ফ্রি। দেওয়া হচ্ছে লাকি কুপন, স্ক্র্যাচ কার্ড, যাতে পুরস্কার হিসেবে থাকছে সোনা, হীরা, গাড়ি, ফ্ল্যাট, টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেলসহ অস্যংখ্য পুরস্কার; কিন্তু বাস্তবে এমন মূল্যছাড় বা পুরস্কার আদৌ কেউ পান কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন অনেকেরই।

নামি-দামি ব্র্যান্ডের কাপড়েও প্রকৃত দাম আড়াল করে অধিক মূল্য লিখে ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার পেছনে ছুটে নৈতিকতা হারিয়েছেন। ঢাকায় কর্মরত পেশাজীবীরা পরিবার-পরিজনের সাথে ঈদ করতে গ্রামে যাবেন বাস-লঞ্চের ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঈদের দিন নতুন জামা-কাপড় পরবেন প্রতিটি কাপড়ের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই ক্রেতাদের পকেট কাটা হচ্ছে। এ যেন ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতারণার মহোৎসব চলছে।

কাপড় ব্যবসার নামি-দামি প্রতিষ্ঠান আবার বহু বছর ধরে ‘এক রেটে’ কাপড় বিক্রি করা হয়। অথচ ঈদ উপলক্ষ্যে বেশি ক্রেতা চাহিদার সুযোগে অধিক লাভের জন্য অতিরিক্ত রেটের ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। মধ্যম সারির দোকান ও বিপণিবিতানেও ব্যবসায়ীদের একই অপকাণ্ড দেখা গেছে। কম দামের কাপড় কিন্তু ভেতরের ট্যাগে প্রকৃত মূল্য লেখা থাকলেও, উপরে অতিরিক্ত দাম লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার কোনোটির নতুন দাম লিখে পুরনো দাম কালি দিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই রাজধানীর মার্কেট ও বিপণিবিতানগুলোতে ক্রেতা ঠকানো হচ্ছে ঈদের কেনাকাটায়। 

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত হাতে-নাতে ধরে অনেক দোকানের জরিমানাও করেছে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ উপলক্ষে ভোক্তাদের ঠকানোর এই অভিনব প্রতারণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে জামা-কাপড় কিনে ভুক্তোভোগীরা ব্যবসায়ীদের নানাভাবে গালাগাল করছেন।

জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা মুনাফার পেছনে ছুটছেন। তাদের মধ্যে যে নৈতিকতা থাকা দরকার, তা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে না। তবে ভোক্তা অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক অভিযানে বাজার ব্যবস্থাপনায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এই অভিযান অব্যাহত রাখা উচিত। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার। পণ্যের মান, ভেজাল, নকল পণ্য ইত্যাদি প্রতিরোধে আইন আছে। তবে মুনাফা নির্ধারণেও যুগোপযোগী আইন থাকা দরকার।

রাজধানীর মিরপুর বেনারসি পল্লীতে মিতু কাতান শাড়ি ঘরে ১৭০০ টাকা দামের শাড়ি বিক্রি করা হচ্ছে ১৭ হাজার টাকায়। গোপন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১৬ এপ্রিল সেখানে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। একই জায়গায় ও তাওছিফ বেনারসি ফ্যাশনে তদারকি করে দেখা যায়, তাদের কাছে কোনো ক্রয় রসিদ নেই। ক্রেতাকে বিক্রয় রসিদও দেওয়া হয় না। শাড়িতে দেওয়া স্টিকারে এসএল নম্বর ও কোড দেওয়া থাকলেও, কোনো মূল্য লেখা নেই। এসএল অনুযায়ী, বালাম বই চেক করে দেখা যায়, ইচ্ছেমতো ক্রয়মূল্য লিখে রেখেছেন বিক্রেতারা। ক্রয়মূল্যের পক্ষে কোনো কাগজপত্রও দেখাতে পারেননি তারা। পরে জরিমানা করা হয় অনেক দোকানকে।

ভোক্তা অধিকারের অভিযানে অস্বাভাবিক মূল্য আদায় করার প্রমাণ পাওয়া গেছে রাজধানীর নিউমার্কেট, হকার্স মার্কেট, চন্দ্রিমা উদ্যান, ধানমন্ডি, সায়েন্সল্যাব, জিগাতলা এলাকায়ও। পোশাকের দাম কমানোর প্রতারণামূলক লোভনীয় অফার, যৌক্তিক দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম নেওয়া, দামি ব্র্যান্ডের পণ্য নকল করাসহ নানাভাবে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। সব ধরনের পণ্যেই এ ধরনের শত রকমের চাতুরতা দেখা যাচ্ছে তাদের কাছ থেকে। তবে রমজান ও ঈদুল ফিতরকে ঘিরে এই প্রবণতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

রাজধানীর মিরপুর এলাকার ব্যবসায়ীদের সাথে নিউমার্কেট এবং এর আশপাশের এলাকার ব্যবসায়ীরা ঈদের আগেই একাধিক বৈঠক করেন বলে জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। সেখানে এই বৈঠকের মূল এজেন্ডাই ছিল বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণার মাধ্যমে ক্রেতাদের পকেট কাটা। বৈঠক সূত্র নিশ্চিত করেছে, টানা দুই বছর ঈদের বেচাকেনা না হওয়ায়, সেই ক্ষতির পাশাপাশি আরো অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করা তাদের লক্ষ্য। স্বাভাবিকভাবেই রাজধানীর নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা লোকের সংখ্যা অগণিত। 

রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত উত্তরা, গুলশান কিংবা বনানীর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্নগ্রহের মতোই। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বেচাকেনা হচ্ছে পণ্য। দাম বৃদ্ধির অভিযোগও নজরে আসেনি ভোক্তা অধিকারের। তবে এলাকার দোকান ভাড়াসহ যাবতীয় খরচের কথা বিবেচনায় আনলে মিরপুর ও নিউমার্কেটের তুলনায় অভিজাত এসব এলাকায় খরচ হওয়ার কথা ছিল আরো বেশি। তবে সিন্ডিকেটে যুক্ত না হওয়ায় সে দৃশ্য চোখে পড়েনি। অন্যদিকে ঈদের আগে থেকেই বিভিন্ন অনলাইন শপ থেকে যেরকম দামে পণ্য কেনা যেত, এখনো তার তেমন কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। 

অন্যদিকে সরেজমিনে ঈদের পোশাকের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে আগত পণ্যের শতকরা ৯০ ভাগই দেশীয়। সুতরাং বাড়তি খরচেরও সম্ভাবনা কম। তবুও বিদেশি পণ্যের পাশাপাশি দেশি পণ্যের লাগামহীন মুনাফা করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর পিরামিন শপিং কমপ্লেক্সে কথা হয় আরিফুল ইসলাম ও মৌসুমি ইসলাম দম্পতির সাথে। তারা জানান, ঈদে পরিবারের সবার জন্য কেনাকাটা করেছি। প্রায় ১২ হাজার টাকার শপিং করেছি। ছোটদের পোশাক তুলনামূলক দাম এবার একটু বেশি। প্রায় প্রতিটি পণ্যে বিক্রেতারা স্ক্র্যাচ কার্ড দিয়েছেন। ঈদের পরে লটারির ড্র হবে। তবে পুরস্কার আদৌ পাব কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তারা নিজেরাই।

রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন গৃহিণী সুরভী ইসলাম। তিনি জানান, পরিবারের সবার জন্যই পোশাক কিনেছি; কিন্তু দাম অন্যবারের তুলনায় অনেক বেশি। তিনিও অভিযোগ করে বলেন, মূল্য ছাড় দেওয়ার নামে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। ফলে চড়া দামে পোশাক কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

ভোক্তা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনে শিথিল প্রয়োগ ও নৈতিকতার অভাবে অতি লোভী হয়ে উঠছেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী। তাদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে জনসচেতনতার পাশাপাশি আইনের আরো কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কেউ ক্রেতাদের কাছ থেকে আসল পণ্যের দাম নিয়ে নকল পণ্য দিচ্ছেন। চারগুণ লাভে পোশাক বিক্রি করেছে বনশ্রীর আর্টিসান। একটি শার্টের প্যাকেটের গায়ে লেখা ১৬৯৫ টাকা; কিন্তু ভেতরে ট্যাগে লেখা ১১৯৫ টাকা। এছাড়া কোনো কোনো প্যাকেটের গায়ে লাগানো পণ্যমূল্য এবং বারকোড মুছে দেওয়া হয়েছে কালি দিয়ে।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ভোক্তাদের স্বার্থে আরো কঠোর হচ্ছে অধিদপ্তর। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করার পরও অনিয়ম কমেনি। তাই ঈদের পর শুধু জরিমানা নয়, আইন অনুযায়ী অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh