হাওরের ফসল ডোবায় কে?

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২২, ১০:৫৯ এএম | আপডেট: ০১ মে ২০২২, ১০:০৪ এএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

চোখের সামনে নিজের সন্তান ডুবে যাওয়ার যে বেদনা, একজন কৃষকের সামনে তার ফসলের ক্ষেত ডুবে যাওয়া এর চেয়ে কম বেদনার নয়। কারণ ওই ক্ষেতে তিনি নিজের রক্ত ঘাম একাকার করে যে ফসল ফলিয়েছিলেন, সে ফসল বিক্রি করে সংসারের যাবতীয় খরচ মেটানোর পাশাপাশি দেনা শোধ করারও স্বপ্ন ছিল। সেই ফসল যখন বানের জলে ভেসে যায়, তখন তা অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কৃষকের কী-ই বা করার থাকে! অসহায় কৃষক ও তার পরিবারের লোকরা তখন ফসল বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেন, ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করেন, যে কাজটি তাদের করবার কথা নয়।

কৃষকের ফসল রক্ষায় যাদের টেকসই বাঁধ নির্মাণ করবার কথা, তারা বাঁধ নির্মাণের নামে মূলত ব্যবসা করেন। প্রকল্পের পরে প্রকল্প হয়; কিন্তু কৃষকের ফসল বাঁচে না। বাঁধের পয়সা হাওরের জলে ভেসে যায়। তাহলে কৃষকের ফসল ডুবাল কে?

সুনামগঞ্জের হাওর বেশ কয়েক দিন ধরেই গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম হয়ে আছে। খবরে বলা হচ্ছে, মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি ও উজানের নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় বাঁধ উপচে তলিয়ে গেছে বেশ কয়েকটি হাওর। যেসব হাওরে লাগানো ছিল ধান। যে ধান প্রায় পরিপক্ব হয়ে উঠছিল। কিছু দিন বাদেই কৃষকের গোলায় যার হাসি ফোটানোর কথা ছিল; কিন্তু দুর্বল বাঁধ ভেঙে সেই সোনালি ধান ধূসর স্বপ্নে পরিণত করেছে বানের জল। এর আগে ২০১৭ সালেও একই ঘটনা ঘটেছিল। তখনো কৃষকের মূল দাবি ছিল টেকসই বাঁধ এবং নানা কারণে ভরাট হয়ে যাওয়া নদীগুলো খনন করে এসবের নাব্য বাড়ানো। কারণ মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি ও উজানের নদীতে পানি বেড়ে গেলে সেই অতিরিক্ত পানি যখন ভাটির নদীগুলো ধরে রাখতে পারে না, তখন সেই পানির তোড় ভাসিয়ে নেয় বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল। অথচ নদী খনন ও বাঁধ নির্মাণে সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। বাজেটেও কমতি নেই; কিন্তু সেই টাকা কোথায় যায়?

নদী ভরাট করে বহুতল ভবন; ফসলের ক্ষেত ভরাট করে শিল্পায়ন; প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কংক্রিটের জঙ্গল; সিমেন্ট ও বালু দিয়ে সবুজ ঘাসের দুনিয়াকে ঢেকে দেওয়ার মতো আত্মবিধ্বংসী কাজে এই ধরিত্রীর মানুষ, বিশেষ করে সবুজ শ্যামল সুজলা সুফলা এই বাংলার মানুষ এতই পারঙ্গম যে, সে তার দেশকে নদীমাতৃক বলার পরেও নদী যার মাতা, সেই মাকে হত্যা করে; এমন আত্মঘাতী সন্তান পৃথিবীতে বিরল। যে কারণে প্রশ্ন উঠছে, এই ধরিত্রীর জন্য, এই দেশের প্রাণপ্রকৃতির সুরক্ষার জন্য বিনিয়োগ কোথায়?

বিনিয়োগ আছে। নদী খননের জন্য বিনিয়োগ বা বরাদ্দ আছে। সেই টাকা দিয়ে নদীকে খাল বা ড্রেন বানিয়ে খনন করা হয় (উদাহরণ ঝালকাঠির ধানসিঁড়ি নদী); সেই টাকা দিয়ে প্রাকৃতিক খাল ও ছড়ার দুই পাশে গাইড ওয়াল নির্মাণ করে প্রাকৃতিক জলাভূমি সংকুচিত করে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করা হয় (উদাহরণ সিলেট); প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সেখানে কথিত সামাজিক বনায়ন করা হয় (উদাহরণ সারাদেশ)।

তাহলে প্রশ্ন হলো, এই বিনিয়োগের রিটার্ন কী আসবে? নদীকে যদি ড্রেন বানানো হয়; প্রাকৃতিক ছড়া ও খালের চরিত্র বদলে দিয়ে সেটিকে যদি কৃত্রিম লেক বা নালায় পরিণত করা হয়, তাহলে সেই নদী ও ছড়াকে কেন্দ্র করে যে প্রাণপ্রকৃতির বিশাল দুনিয়া সৃষ্টি হয়েছিল বহু বছর ধরে, সেই দুনিয়ার প্রাণিকুল কোথায় যাবে? ওই জনপদে যখন প্লাবন হবে, অতি বৃষ্টি হবে, তখন সেই বাড়তি পানিকে ধরে রাখবে কিংবা কে বয়ে নিয়ে যাবে সমুদ্রে? তার নিজেরই তে মরণদশা। সে কী করে বাঁচাবে জনপদকে? পারবে না। পারবে না বলেই হাওরের ফসল ডুবে যায়।

হাওরের কৃষকের অন্যতম প্রধান দাবি টেকসই বাঁধ; কিন্তু হাওরের ভুক্তভোগী মানুষেরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে একটি ‘লাভজনক ব্যবসা’। অর্থাৎ কৃষকদের স্বার্থে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা দেয়; কিন্তু কাজ বাস্তবায়ন যাদের দায়িত্ব তারা নিজেদের স্বার্থই বড় করে দেখেন। তাদের কাছে প্রকল্প মানেই টাকা। টাকা মানেই ভাগবাটোয়ারা। সুতরাং হাওরের প্রাণপ্রকৃতি আর ফসল রক্ষায় বিনিয়োগ হলেও, সেই বিনিয়োগে ভারী হয় মূলত প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পকেট।

হাওরের ভুক্তভোগী মানুষের বরাতে গণমাধ্যমের খবরেও বলা হচ্ছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রভাবশালীরা মিলে হাওরে বাঁধ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। যে কারণে কাজে দুর্নীতি-অনিয়ম হচ্ছে। বাঁধের নামে অপচয় ও লুটপাট হচ্ছে। কপাল পুড়ছে কৃষকের। আবার যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়, সারা বছর সেটিরও তদারকি করা হয় না। একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই সবাই নড়ে-চড়ে বসেন। মন্ত্রী ও প্রশাসনের কর্তারা কৃষকের কাছে ছুটে যান। তদন্ত কমিটি করেন। দুর্বল বাঁধ নির্মাণের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তির আশ্বাস দেন; কিন্তু পরের বছর কৃষককে আবারো সেই একই আতঙ্কে রাত জেগে বাঁধ পাহারা দিতে হয়; কিন্তু পাহারা দিয়ে কি বাঁধ রক্ষা করা যায়? যদি না সেটি টেকসই হয়?

সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষের অভিযোগ, নানা জায়গায় অপ্রয়োজনে বাঁধ হলেও, প্রয়োজনীয় জায়গায় হয়নি। আবার বাঁধ নির্মাণে অনিয়মেরও শেষ নেই। ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে অধিকাংশ বাঁধই এখন ঝুঁকিতে রয়েছে। 

তবে বাঁধের চেয়েও হাওরাঞ্চলে নানা কারণে ভরাট হয়ে যাওয়া নদীগুলো খননে যে পরিমাণ আন্তরিকতা থাকার কথা ছিল, তা অনুপস্থিত। অথচ নদীগুলো নাব্য থাকলে, গভীর থাকলে বন্যার অতিরিক্ত পানি ধরে রাখতে পারত। তাতে হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলের জমি তলিয়ে যেত না; কিন্তু নদী খননের বাজেটও কোথায় কতটুকু খরচ করা হয়েছে; কী কাজ হয়েছে; সেই কাজের ফলাফল কী-তা নিয়ে স্থানীয়দের মনে প্রশ্নের শেষ নেই?

সুতরাং হাওরে কৃষকের ফসল কে ডুবিয়ে দেয় সেই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই এতক্ষণে আপনি পেয়ে গেছেন। সমাধান কী? সমাধান জবাবদিহিতা। সমাধান অপরাধের বিচার। সমাধান স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের সততা, আন্তরিকতা এবং মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, সংবেদনশীলতা।

প্রকল্প মানেই টাকা, টাকা মানেই ভাগবাটোয়ারার এই থিওরি মন থেকে মুছে ফেলা। নিজের পকেটের চেয়ে যে দেশ ও দেশের কৃষক বড়- সেই বাস্তবতাটি উপলব্ধি করা। নিজের লোভ সংবরণ করা। সরকার জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় যে বেতন দেয়, তাতে সন্তুষ্ট থাকা। জনগণের ট্যাক্সের পয়সা কিংবা উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা অথবা ঋণকে নিজের অধিকার মনে না করা। এই উপলব্ধি জাগ্রত না হলে হাওরের ফসল বাঁচানোর জন্য সরকারের বরাদ্দ বছর বছর বাড়বে; কিন্তু সেই টাকার সিংহভাগ চলে যাবে সিংহদের পেটে। গরিব কৃষক শুধু হাওরের ভাঙা বাঁধের ওপরে দাঁড়িয়ে নিজের সন্তানতুল্য ফসলের ডুবে যাওয়া দেখবে আর অশ্রুপাত করবেন, যে অশ্রু মিশে যাবে হাওরের জলে। কেউ তার হিসাব রাখবে না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh