প্রশান্ত মহাসাগরে আধিপত্যের লড়াই

অরুন্ধতী বসু

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২২, ০২:৫৭ পিএম

পৃথিবীর বৃহৎ ও গভীরতম জলধি প্রশান্ত মহাসাগর। ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর বৃহৎ ও গভীরতম জলধি প্রশান্ত মহাসাগর। ছবি: সংগৃহীত

নশ্বর পৃথিবীর তিন ভাগ জল ও এক ভাগ স্থল। ভূখণ্ড নিয়ে বিভিন্ন দেশে চলছে লড়াই। দখল স্পৃহার বাইরে নেই জলসীমাও। পৃথিবীর বৃহৎ ও গভীরতম জলধি প্রশান্ত মহাসাগর।

১৫ কোটি ৫০ লাখ বর্গকিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যরে এই বিস্তীর্ণ জলরাশির পূর্ব দিকে আমেরিকা এবং পশ্চিমে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ। অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে এই মহাসাগরকে কেন্দ্র করে এশিয়া অঞ্চলের ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমেই বাড়ছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। আধিপত্য বিস্তারে প্রশান্ত মহাসাগরে এরই মধ্যে নৌশক্তি বাড়িয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন ও অস্ট্রেলিয়া।

বিশাল মৎস্যসম্পদ, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে। এসব সম্পদের বেশিরভাগই সবেমাত্র আবিষ্কৃত এবং অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এই সম্ভাবনাময় সম্পদ দখলদারিত্বের বিষয়টি মহাসাগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ও জনবসতিহীন দ্বীপগুলোর মালিকানার সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ এসব দ্বীপের মালিকানা প্রাপ্তি সাপেক্ষে পার্শ্ববর্তী সমুদ্রতলসহ বেশ কিছু সমুদ্র অঞ্চল দখলে চলে আসতে পারে যে কোনো দেশের। আলজাজিরার এক নিবন্ধে সম্প্রতি বলা হয়, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, ক্রমহ্রাসমান সম্পদ এবং বিপুল শিল্প চাহিদার এই বিশ্বে প্রশান্ত মহাসাগরে ব্যাপৃত দ্বীপ দখলের মধ্য দিয়ে একটি দেশ সহজেই পেয়ে যেতে পারে ভালো থাকার দীর্ঘমেয়াদি ছাড়পত্র। এই দূরদর্শী চিন্তা থেকে উত্তাল জলরাশির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ ও সম্পদ দখলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ছে।  

প্রশান্ত মহাসাগরে এরই মধ্যে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনীতির দেশ চীন। চীন পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশও বটে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চাইলে চীনকে অবশ্যই পর্যাপ্ত খাদ্য, জ্বালানি এবং শিল্পে ব্যবহৃত সম্পদের উৎস সন্ধানে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এই অভিপ্সা থেকে আধিপত্য বিস্তারে মনযোগী দেশটি। প্রায় ১৭ হাজার জাহাজের সমন্বয়ে গঠিত চীনের মাছ ধরার বহরটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড়। এর তুলনায় নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাছ ধরার বহর খুবই ক্ষুদ্র। প্রশান্ত মহাসাগরে এই দুই দেশের মাছ ধরার জাহাজের সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো। 

বিশাল চীনা দূরপাল্লার বহরগুলো প্রশান্ত মহাসাগরজুড়ে মৎস্যক্ষেত্র সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। ট্রলার, প্রসেসিং ফ্যাক্টরি ও সাপোর্ট ভেসেল নিয়ে গঠিত বহরগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই চীনা উপকূল ছাড়িয়ে অনেক দূরের লাভজনক মৎস্যক্ষেত্রগুলোয় হানা দিতেও বহরগুলোর বেশি বেগ পেতে হয় না। ২০২০ সালে গ্যালাপাগোস দ্বীপগুঞ্জের কাছে প্রায় ৩০০টি জাহাজের একটি বিশাল বহর দেখা গেছে। আলজাজিরার নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ইকুয়েডরের আঞ্চলিক সমুদ্রসীমার নিকটবর্তী দ্বীপ গ্যালাপাগোস- চীনা উপকূলীয় অঞ্চল থেকে এর দূরত্ব ১৫ হাজার কিলোমিটারের বেশি।

চীনের কাছে কেবল বিশ্বের বৃহত্তম মছ ধরার নৌবহরই নয়, রয়েছে বাণিজ্য পথ সুরক্ষায় সুবিশাল নৌবাহিনী। এই ক্ষেত্র আরও শক্তিশালী করতে বিশাল জাহাজ নির্মাণ কর্মসূচি নিয়েছে দেশটি। সেইসঙ্গে চাহিদা পূরণে দ্বিতীয় নৌ শিপইয়ার্ড খোলা হচ্ছে সাংহাইয়ে। তবে সংখ্যাই সব কিছু নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই প্রশান্ত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তার করে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এই মহাসাগরের বুকে চীনের বৃহৎ নৌবাহিনী থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্রের আছে বিশাল শক্তিশালী সাবমেরিন বহর এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার গ্রুপ। এই সুবিশাল জাহাজগুলোর প্রতিটি ৯০টি করে এয়ারক্র্যাফট বহনে সক্ষম।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত নৌবহরগুলো প্রায় ২০০ জাহাজ, ১ হাজার ১০০ এয়ারক্র্যাফট, ১ লাখ ২০ হাজার উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নাবিক ও বেসামরিক সেনা নিয়ে গঠিত। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কয়েক দশকে হওয়া যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের নৌবাহিনীকে সামরিক বাহিনীর কায়দায় শক্তিশালী হিসেবে তৈরি করেছে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির এ দেশ। এর ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিনের শক্তি একাই গোটা পৃথিবীর সব প্রাণীর জীবন নির্মূলে সক্ষম। Top of ForBottom of Form

সামুদ্রিক খাদ্য আহরণে চীনা মৎস্য বহরগুলো যেভাবে মহাসাগর দাপিয়ে বেড়ায়, ঠিক সেভাবেই সমুদ্র তলদেশে মজুদ অব্যবহৃত তেল ও গ্যাসের দখল নিতে উপকূলবর্তী জনশূন্য দ্বীপগুলোর প্রতি মনযোগী হয়ে উঠেছে চীন। 

দক্ষিণ চীন সাগরের আইল্যান্ড চেইন থেকে জাপানের দক্ষিণ প্রান্তের দ্বীপ পর্যন্ত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিতে চেষ্টা করছে চীন। আঞ্চলিক ক্ষমতাধর হিসেবে চীনের উত্থানে উদ্বিগ্ন এর প্রতিবেশীরা; কিন্তু চীন বলছে, কেবল নিজেদের অংশ হিসেবে বিবেচিত অঞ্চলগুলোয় অধিকার জোরদার করছে তারা। চীন ও তার প্রতিবেশীদের মধ্যে এখন নতুন শীতল যুদ্ধের কারণ হিসেবে পরিণত হয়েছে কম বাসযোগ্য ছোট দ্বীপগুলো। এমন আঞ্চলিক উদ্বেগ দক্ষিণ চীন সাগর ভিন্ন অন্য কোথাও এত প্রকট নয়। ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনাইয়ের দাবিকৃত জলসীমায় প্রবেশের মাধ্যমে চীন এই এলাকার বড় অংশ দাবি করে। বিশ্বের সমুদ্র বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ এই প্রশান্ত মহাসাগরে হয়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বে অন্যতম কৌশলগত সমুদ্রপথে পরিণত হয়েছে এই মহাসাগর। 

প্রশান্ত মহাসাগরে আধিপত্যের লড়াইয়ে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে ক্রমবর্ধমান অস্ত্র প্রতিযোগিতায় শামিল হচ্ছে- জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান। শান্তিবাদী সংবিধান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নীরবে সশস্ত্র বাহিনী ও মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছে জাপান। এখন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সাবমেরিন নির্মাণ হয় সূর্যোদয়ের দেশে। সর্বাধুনিক সেন্সর ও অস্ত্রে সজ্জিত সোরিউ-ক্লাস সাবমেরিনগুলো জলের গভীরে নিমজ্জিত থাকতে পারে দীর্ঘ সময়। জাপানের হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারগুলোকে হাল্কা এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ারে রূপান্তর করা হয়েছে। আঞ্চলিক মিত্র জাপানের জন্য পঞ্চম প্রজন্মের ১০৫টি বিমানের অর্ডার অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

দূরপাল্লার জাহাজবিরোধী ক্ষেপণাস্ত্রও কিনছে জাপান। এ ধরনের অন্ত্র দেশটিকে আগামীতে প্রশান্ত মহাসাগরে সংঘটিত যুদ্ধে সুবিধা দেবে না-কি হুমকির মুখে ‘প্রি-এম্পটিভ স্ট্রাইক’ পন্থা অবলম্বন করা হবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। যা-ই হোক, জাপানের প্রতিরক্ষা নীতিতে এমন অনেক বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাইওয়ানে চীনা আগ্রাসন ঠেকানোর আগাম প্রস্তুতি হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপগুলো সেনা ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী করেছে জাপান। ভবিষ্যতে চীন এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে জাপান ও তাইওয়ান পরস্পরকে সাহায্য করতে সম্মত হয়েছে।

জনবসতিহীন সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ, যা চীনারা অভিহিত করে দিয়াওয়ু নামে। এটি জাপান ও চীনের মধ্যের দ্বন্দ্বকে আরও উসকে দিয়েছে। দ্বীপপুঞ্জটিকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে এই দুই দেশ। এই দ্বীপপুঞ্জের দাবি কেন্দ্র করে যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত তারা। 

জাপানের হিসাবে শুধু চীনই নয়, সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গেও। জাপানের দাবিকৃত উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলটিকে রাশিয়ার কাছে কুরিল দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপপুঞ্জের চারটি দ্বীপের ওপর সার্বভৌমত্ব দাবি করে রাশিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ নাগাদ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে যাওয়া দ্বীপগুলোয় রাশিয়া ক্রমাগতভাবে সামরিক শক্তিকে শক্তিশালী করে চলেছে। গত মার্চে বিতর্কিত দ্বীপগুলোয় ৩ হাজার সেনা নিয়ে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে দেশটি। গ্যাসমৃদ্ধ সমুদ্রতলবর্তী এমন অনেক দ্বীপ নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে। জাপানের পাশাপাশি প্রশান্ত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে অস্ত্রক্ষেত্র সমৃদ্ধ করছে দক্ষিণ কোরিয়া। গত বছর দেশটি গতানুগতিক ধারার একটি ব্যালাস্টিক মিসাইল সাবমেরিন তৈরি করেছে। এছাড়া বিদেশ থেকে না কিনে নিজস্ব উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূরপাল্লার সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল তৈরি করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। পিছিয়ে নেই তাইওয়ানও। নিজস্ব অস্ত্র কর্মসূচির আওতায় দেশেই নির্মাণ করেছে সাবমেরিন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সাবমেরিনের একটি নিজস্ব বহর তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির। সেইসঙ্গে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সক্ষমতাও দ্বিগুণ করছে তাইওয়ান। 

তাইওয়ান, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া- সকলেই এখন বড় আকারের অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করেছে। এদের সবার আছে বিশাল শিল্প উচ্চ-প্রযুক্তির, যা তাদের প্রতিরক্ষার জন্য নতুন প্রজন্মের অস্ত্র তৈরির কাজে নিযুক্ত।

প্রশান্ত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অস্ট্রেলিয়া অবলম্বন করেছে ভিন্ন পন্থা। গত বছর ‘ওকাস’ চুক্তি করেছে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এ চুক্তির আওতায় অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরিতে সহায়তা করবে দুই দেশ। এই সাবমেরিনগুলোকে জলের নিচে শনাক্ত করা যায় না। অতর্কিতে হামলা করতে সক্ষম অনেক দূরে থাকা শত্রু ঘাঁটিতে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। ওকাস চুক্তিতে এরই ইঙ্গিত মিলছে। 

সমুদ্রপথে বাণিজ্য ব্যবস্থা সহজ করতে উদ্যোগী ভারতও। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ (কোয়াড) নামের চুক্তি করেছে ভারত। ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্য বিস্তার ঠেকাতেই এই চুক্তির অংশীদার হয়েছিল দেশটি। 

কোয়াডের মতো কৌশলগত সম্পর্কগুলো এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য বিস্তার নিয়ে শঙ্কা কমাতে ভূমিকা রাখছে। সামরিক বাহিনী সম্প্রসারণকে বিশ্বের সাথে বাণিজ্য সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে দেখছে চীন। কোয়াডকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে নিজের সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করছে দেশটি। চলছে পাল্টাপাল্টি আগাম হামলার প্রস্তুতি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh