টি-ব্যাগে মিলছে ক্ষতিকর প্লাস্টিক

জাবি প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২২, ১২:৪৩ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

চা উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীতে দশম। গতবছর দেশের ছোট-বড় প্রায় ১৬৭ টি চা বাগানে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। যা দেশের ইতিহাসে যেকোনো বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ।

উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে চা পানের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবর্তন এসেছে পান পদ্ধতিতেও। বাংলাদেশ চা বোর্ডের ২০১৯ সালে দেয়া তথ্য মতে দেশে চায়ের বাৎসরিক চাহিদা প্রায় ৯ কোটি ৫২ লাখ কেজি। সমীক্ষায় দেখা যায় একজন মানুষ বছরে প্রায় ৫৮৮ গ্রাম বা ২৯৪ কাপ চা পান করে থাকেন।  সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে ঝামেলা কম ও দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় অনেক চাপ্রেমীর কাছেই প্রথম পছন্দ টি-ব্যাগ।

তবে দেশের বাজারে নামিদামি ৫টি ব্র্যান্ডের টি-ব্যাগে পাওয়া গেছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক দলের গবেষণায় টি-ব্যাগে উদ্বেগজনক প্লাস্টিকের কণার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে৷ 

গবেষণায় দেখা যায়,  একটি চা পাতা ভর্তি টি-ব্যাগে ৫০৫টি এবং খালি টি-ব্যাগে ৪৭৭টি প্লাস্টিকের কণা রয়েছে। টি-ব্যাগের চা পানের মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় ১০.৯ টন মাইক্রোপ্লাস্টিক রাজধানী শহর ঢাকায় বসবাসকারীদের দেহে প্রবেশ করতে পারে।

আন্তর্জাতিক জার্নাল “সায়েন্স অব দ্য টোটাল ইনভায়রনমেন্ট” এ গবেষণা নিবন্ধটি “ইজ দেয়ার টি কমপ্লিমেন্টেড উইথ দি এ্যাপেইলিং ফ্লেভার অব মাইক্রোপ্লাসটিক? অ্যা পায়োনিয়ারিং স্টাডি অন প্লাস্টিক পলিউশন ইন কমার্শিয়ালি এভেইলএবল টি-ব্যাগস ইন বাংলাদেশ” নামে প্রকাশিত হয়েছে।

দেশে প্রথমবারের মতো টি-ব্যাগে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক ড. খবির উদ্দিন, একই বিভাগের স্নাতোকত্তরের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. এহেদুল আকবর ও মো. আবু বক্কর সিদ্দিক এবং ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব গোয়াসের গুইলহার্ম মেলাফিয়া।

গবেষণায় ব্যবহৃত ৫টি ব্র্যান্ডের টি-ব্যাগে পলিটেট্রাফ্লুরোইথিলিন, হাই ডেনসিটি পলিথিলিন, পলিকার্বোনেট, পলিভিনাইল ক্লোরাইড, নাইলন, ইথিলিন ভিনাইল এসিটেট, সেলুলোজ এসিটেট এবং এবিএস প্রভৃতি প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ইথিলিন ভিনাইল এসিটেট, এবিএস এবং  সেলুলোজ এসিটেটের আধিক্য তুলনামূলক বেশি।

এসব আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক কণা  আকারে প্রায় ৩৩ থেকে ২১৮০ মাইক্রো মিটার৷ মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলোর  কিছু তন্তু আকৃতির, কিছু টুকরা, কিছু গোলক আকৃতির এবং কিছু ঝিল্লি (ফিল্ম) আকৃতির।  

এছাড়াও গবেষণায় প্রায় ৯ ধরণের রঙ পাওয়া গেছে যার মধ্যে বাদামি, নীল ও লাল রঙের প্রাধান্য বেশি।

গবেষণা দলের প্রধান ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা ঢাকার সুপারমার্কেটগোতে পাওয়া যায় এমন ৫টি ব্র্যান্ডের টি-ব্যাগের উপর গবেষণা করে ক্ষতিকর প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। একটি খালি টি-ব্যাগের তুলনায় চা পাতা ভর্তি টি-ব্যাগে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি। সংখ্যায় তা প্রায় ২২.২ শতাংশ। এ থেকে বুঝা যায় চা প্রক্রিয়াজাতকরণের সময়েও মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংমিশ্রণ হয়ে থাকে৷

টি-ব্যাগ প্যাকেটজাতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সময় প্লাস্টিক কণার সংমিশ্রণ হয়ে থাকে বলে মনে করেন তিনি। এছাড়াও চা পাতা সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সময়ও মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংমিশ্রণ হয় বলে গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়।

সাধারণত প্লাস্টিক মাটির সাথে মিশে যেতে ৪০০ বছরের মতো সময় লাগে৷ বর্তমান সময়ে প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহারের জন্য বড় আকৃতির প্লাস্টিক গলো ভেঙে প্লাস্টিক কণায় রূপ নেয়। পরবর্তীতে এই কণাগুলোই খাদ্যদ্রব্যের সাথে মিশে যায়। এছাড়াও গার্মেন্টস শিল্পে কাপড় ধোয়া ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় কৃত্রিম কাপড় মাইক্রোপ্লাস্টিকের আরেকটা বড় খাত বলে গবেষকরা মনে করেন।

মানবদেহের জন্য মাইক্রোপ্লাস্টিক কতটা ক্ষতিকর এবিষয়ে জানতে চাইলে ড. মোস্তাফিজুর বলেন, মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে বিশ্বজুড়ে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই, তবে আমরা পাখি এবং ব্যাঙসহ বিভিন্ন প্রাণীর উপর গবেষণা করেছি এবং লক্ষ্য করেছি যে মাইক্রোপ্লাস্টিক অন্যান্য দূষণকে সমর্থন করে এবং একটি গৌণ ভেক্টর হিসাবে কাজ করে। এসব প্লাস্টিকে যেসব রাসায়নিক মেশানো হয় তা মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।

স্বল্প সময়ের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক দেশের স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে করেন তিনি। সেই সাথে ড. মোস্তাফিজুর পরিবেশ বাঁচাতে প্লাস্টিকের বিকল্প ভাবার উপর জোর দেন।

মানব স্বাস্থ্যে প্লাস্টিকের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক হেল্থ অ্যন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তাজউদ্দিন সিকদার বলেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক সাধারণত হজম হয় না। এসব ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা খুব সহজে এটি কোষের মধ্যে ঢুকে যায়। এর প্রভাবে স্নায়ুবিক সমস্যার পাশাপাশি পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন জায়গায় ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশি।

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশনসহ (বিএসটিআই) সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে বিশেষজ্ঞরা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh