তামাকে আয় ২২ ও চিকিৎসায় ব্যয় ৩১ হাজার কোটি টাকা

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২২, ০৯:৪৪ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

দুই কোটি শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। তামাক পরোক্ষভাবে মানুষ হত্যা করছে, সীমাহীন অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে মানুষ। তামাকজাতীয় পণ্য থেকে সরকার বছরে আয় করে ২২ হাজার কোটি টাকা; কিন্তু তামাকজনিত কারণে রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হয়ে থাকে ৩১ হাজার কোটি টাকা।

জাতীয় আয়ের (জিডিপি) ১.৪ শতাংশ চলে যায় তামাকজনিত ক্ষতির কারণে। তামাকজনিত রোগে বাংলাদেশে বছরে প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের একটি ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকের ব্যবহার ছেড়ে দিলে একটি মানুষ অতিরিক্ত পাঁচ বছর বেঁচে থাকতে পারে। 

তামাকজনিত কারণে প্রধান সাতটি রোগের একটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ বেশি এবং এতে ক্যান্সারের ঝুঁকি ১০৯ শতাংশ বেশি তাদের তুলনায়, যারা ব্যবহার করে না। বর্তমানে দেশে ১৫ লাখের অধিক প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ তামাক সেবনের কারণে এবং ৬১ হাজারের অধিক শিশু পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। তামাক ব্যবহারের কারণে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হয়ে থাকে। তামাকের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। বাংলাদশের দুই কোটি শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। এছাড়া তামাক চাষে কৃষিজমি ব্যবহারের ফলে খাদ্য নিরাপত্তার হুমকির মধ্যে পড়েছে। অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

তামাক কেন ক্ষতিকর? : তামাকে থাকে প্রায় সাত হাজার রাসায়নিক পদার্থ। এর অন্যতম হলো নিকোটিন ও আলকাতরা (টার)। এসব রাসায়নিক পদার্থ রক্তনালিকে সংকুচিত করে দেয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত করে। নিকোটিন নামক যে রাসায়নিকটি তামাকে পাওয়া যায়, তা বিপজ্জনক মাত্রায় এডিক্টিভ (নেশা) ও বিষাক্ত পদার্থ (টক্সিক)। তামাকে একবার আসক্ত হলে ব্রেন বার বার এই নিকোটিন চায়। নিকোটিন না হলে ব্রেন কোনো কাজ করতে চায় না। ফলে তামাক ব্যবহার বাড়াতেই হয়। তামাক ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারীর হার্টরেট বেড়ে যায়, বাড়ে উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার)। তামাক ব্যবহারে যে ধোঁয়া বের হয়, তাতে থাকে উচ্চ বিষাক্ত পদার্থ কার্বন মনোক্সাইড। এই পদার্থটি রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। তাতে করে হার্ট (হৃৎপিণ্ড) কম মাত্রায় অক্সিজেন পায়। ধূমপানের কারণে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হচ্ছে; কিন্তু অনেকে বুঝতেই পারেন না। তামাকের কারণে প্রতি ১০ জনের একজনের হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ধূমপানের কারণে শরীরের তাপ বৃদ্ধি, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি রোগ-ব্যাধি দেখা যায়। মাল্টিপল স্ক্‌লেরেসিস বা মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের সমস্যা দেখা দেয়। ক্রনিক বাইনিটিস বা দীর্ঘমেয়াদি নাকের ইনফেকশন হয়। অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে বেশি বয়ষ্ক দেখায়। ধূমপানের কারণে ফুসফুস, মূত্রথলি, কিডনি, কণ্ঠনালিতে ক্যান্সার হয়ে থাকে। হার্টের সাথে সম্পৃক্ত ধমনিগুলো ব্লক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। যকৃত শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গর্ভপাত কিংবা অপরিণত শিশু জন্মাতে পারে। ধূমপানের ফলে যৌনশক্তি বিলুপ্ত হতে থাকে। ইদ্রিয় ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। ঘ্রাণ নেওয়া এবং স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ধূমপায়ী ব্যক্তি সবসময় দুর্বলতা অনুভব করে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। স্মরণশক্তি কমিয়ে দেয় এবং মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে। মূত্রথলি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং প্রস্রাবে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। ধূমপানের কারণে রিউমাটয়েড আথ্রাইটিসের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ধূমপানের প্রভাবে চুল পড়া শুরু হয়। ধূমপায়ী নারীদের মেনোপজ সময়ের অন্তত দুই বছর আগে হয়ে যায়। 

তামাক কর বৃদ্ধি জীবন বাঁচাবে ও রাজস্ব বাড়াবে : তামাক যে ক্ষতিকর তাতে কারও মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। তামাক ব্যবহার কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো কর বাড়ানো। তাহলে অনেকে তামাক জাতীয় পণ্য কিনতে পারবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিগারেটের চার মূল্য স্তর ব্যবস্থা বাতিল করে দুই স্তরে আনতে হবে।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে তামাকজনিত রোগে প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশে এই হার মোট মৃত্যুর ১৩.৫ শতাংশ। সরাসরি না হলেও পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি মারাত্মক। ২০১৭ সালের আরেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ধূমপান না করেও নারীরা ১৯.৩৮ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে, ৩৮ শতাংশ গণপরিবহনে এবং ৩৭ শতাংশ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। ঢাকার প্রাথমিক স্কুলে পড়া ৯৫ শতাংশ শিশুর দেহে ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব পাওয়া গেছে। আরেক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, উচ্চমাত্রার নিকোটিনযুক্ত বিড়ি কারখানাগুলোর মোট শ্রমিকের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ শিশু শ্রমিক। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। একই সময়ে তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ মাত্র ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। পরিবেশ এবং কৃষকের জীবন-জীবিকার উপর তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব ব্যাপক। 

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটিবি) ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে তারা কর বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে ২২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। এই অর্থের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর বাবদ তারা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে মাত্র এক হাজার ৮২ কোটি টাকা। করের অবশিষ্ট অর্থ সরকারি কোষাগারে যায় সরাসরি ভোক্তার পকেট থেকে। 

কেমন তামাক কর চাই : অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা সিগারেট ও বিড়িসহ সব প্রকার তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করার সুপারিশ করে আসছেন অনেক দিন থেকে। প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের নিম্ন স্তরে খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৩২.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করার সুপারিশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। মধ্যম স্তরে খুচরা মূল্য ৭০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করার প্রস্তাব করছেন বিশেষজ্ঞরা।

উচ্চ স্তরে খুচরা মূল্য ১১০ টাকা নির্ধারণ করে ৭১.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক এবং প্রিমিয়াম স্তরে ১৪০ টাকা খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে ৯১ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার সুপারিশ করেন তিনি। এর ফলে সব মূল্য স্তরে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের হার হবে চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬৫ শতাংশ। বিড়ির ক্ষেত্রে, ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১.২৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করা, ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করার সুপারিশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে উভয় ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের হার হবে চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৪৫ শতাংশ।

বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের চিত্র : গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, বর্তমান দেশে ১৫ বছরের উর্ধ্বে মোট তামাক ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৮ লাখ, মোট জনগোষ্ঠীর ৩৫.৩ শতাংশ। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার অনেক বেশি। উদ্বেগজনক তথ্য হলো, প্রায় ৪৮ শতাংশ অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করে। তবে অতি উচ্চবিত্তের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ২৪.৮ শতাংশ। অন্যদিকে শহরের ২৯.৯ শতাংশের তুলনায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৩৭.১ শতাংশ তামাক ব্যবহার করেন। নারীদের ২৪.৮ শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন। গ্যাটস ২০১৭ অনুযায়ী, একজন ধূমপায়ীর সিগারেট বাবদ মাসিক গড় ব্যয় হয় এক হাজার ৭৭.৭০ টাকা।

অথচ খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, একটি পরিবারে শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে গড়ে ব্যয় হয় যথাক্রমে ৮৩৫.৭০ ও ৭০০ টাকা। তামাকের জন্য ব্যয়িত অর্থ শিক্ষা ও চিকিৎসায় ব্যয় করা গেলে পরিবারগুলোর জীবনমানে উন্নতি ঘটত। তামাক খাত থেকে সরকার প্রতি বছর যে পরিমাণ রাজস্ব পায়, তার তুলনায় তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় অনেক বেশি ব্যয় করতে হয়। তামাকজনিত রোগে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এর পাশাপাশি প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ মানুষ পঙ্গু হয়ে যায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh