সিঙ্গাপুরের কথা বলে নেওয়া হলো চট্টগ্রামে, টাকা নিয়ে লাপাত্তা বোন

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২২, ১২:২২ পিএম

বোন ও ভাগ্নের প্রতরণার শিকার ভাই শহীজল মাঝি। ছবি : লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

বোন ও ভাগ্নের প্রতরণার শিকার ভাই শহীজল মাঝি। ছবি : লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

ভাতিজাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবে এমন আশ্বাস দিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে স্বজনসহ দীর্ঘদিন মেহমান হিসেবে থেকে অভিনব উপায়ে প্রতারণা করে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নেন এক বোন। সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট সাজিয়ে ভাতিজাকে বিমানে চড়িয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে লাপাত্তা সেই প্রতারক বোন ও তার সংঘবদ্ধ স্বজন। জানাজানি হলে এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় হয়। 

ঘটনাটি ঘটেছে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর মার্টিন ইউনিয়নের ৮নং ওর্য়াড বটগাছতলা এলাকার জেলে শহীজল মাঝির বাড়িতে। 

বোন আলেয়া বেগম ভোলা জেলার বোরহান উদ্দিন উপজেলার কুদবা ইউনিয়নের কুদবা গ্রামের পল্লী পশু চিকিৎসক বশির আহমেদের স্ত্রী। 

এ ঘটনায় বোন আলেয়া বেগমসহ ছয়জনের নামে লক্ষ্মীপুর জজ আদালতে মামলা দায়ের করেছেন ভাই শহীজল মাঝি। গতকাল শনিবার (১৪ মে) দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুনসুর আহমেদ দুলাল। 

এর আগে গত ৯ মে তারিখে মামলা দায়ের করা হয়। তার আগে ২৮ এপ্রিল শহীজলের ছেলে জুয়েলকে সিঙ্গাপুর নেওয়ার কথা বলে বিমানে উঠিয়ে নেওয়া হয় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। ঘটনার সাথে শহীজলের বোন আলেয়া, তার ছেলে আওলাদসহ আত্মীয় পরিচয়ের আরো চারজন জড়িত।

এদিকে ঋণ ও দেনা করে বোনকে দেয়া চার লাখ টাকার চিন্তা ও পাওনাদারদের ভয়ে দিশেহারা ভুক্তভোগী জেলে শহীজল।

শহীজল জানায়, বোন আলেয়া বেগম দীর্ঘদিন তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেনি। বাবা মারা যাওয়ার খবর শুনেও আসেনি। অবশেষে ঘটনার ছয় মাস আগে ভোলার বোরহান উদ্দিন উপজেলার কুদবা গ্রাম থেকে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর মার্টিন গ্রামে মেহমান হিসেবে আসেন বোন। দীর্ঘ  প্রায় ৩০ বছর পর বোনকে কাছে পেয়ে সাধ্যমতো আদর সমাদর করেন জেলে শহীজল ও তার পরিবার।

নিজের অভাবের সংসারে বোনের জন্য আদর যত্নের কমতি রাখেনি শহীজল। বোনের কয়েক দিন পর শহীজলের বাড়িতে বেড়াতে আসে আলেয়ার ছেলে ভাগ্নে আওলাদ হোসেন। ভাগ্নেকেও বাড়িতে রেখে সমাদর করে শহীজলের পরিবার। 

ভাগ্নে আসার দুইদিনের মধ্যে আলেয়া জানান, তার ছেলে আগের স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে। এখন ছেলেকে লক্ষ্মীপুর জেলায় দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চান। বোনের আবদারে ভাগ্নের জন্য পাত্রী দেখে কয়েকদিনের মধ্যে বিয়ে দেন শহীজল ও তার পরিবার। 

বিয়ের দুই-তিনদিন পর আলেয়া তার ভাই শহীজলকে আবার জানান, ছেলের আগের শ্বশুর ছেলের জন্য সিঙ্গাপুরের একটা ভিসা দিয়েছে, এখন দুই-তিনদিনের মধ্যে ছেলেকে সিঙ্গাপুর চলে যেতে হবে। তবে খরচের জন্য চার লাখ টাকা লাগবে। সে টাকা দ্বিতীয় শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় শ্বশুরবাড়ি থেকে চার লাখ টাকা নেওয়ার পরেরদিনই আওলাদ তার মামার বাড়ি থেকে সিঙ্গাপুরের কথা বলে বিদায় নেয়। মামার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার একদিন পর আওলাদ বিদেশি নম্বরের মতো নম্বর তৈরি করে শহীজলদের ফোনে কল দিয়ে জানায় সে সিঙ্গাপুর এসেছে। এখন শহীজলের ছেলে জুয়েলকেও সিঙ্গাপুর নিতে চায়। আলেয়ার সাথে শহীজলকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করে।

আলেয়া তার ভাই শহীজলের ছেলে জুয়েলকে সিঙ্গাপুর নেওয়ার জন্য ১২ লাখ টাকা দাবি করে। পরে ৯ লাখ টাকায় সমঝোতা হয়। যার মধ্যে শহীজল দেবে পাঁচ লাখ টাকা, বাকি চার লাখ টাকা আলেয়া দেবে বলে ভাইকে জানায় এবং ভাইকে তড়িঘড়ি করে টাকা দেয়ার কথা বলে। আওলাদও শহীজলকে বারবার ফোন দিয়ে টাকা দিতে বলে। 

শহীজলের ছোট ভাই মাহে আলম জানায়, ভাগ্নে আর বোনের চাপাচাপিতে তার বড় ভাই শহীজল ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পাগল হয়ে যায়। টাকা নেওয়ার জন্য ঋণ খোঁজে। আলেয়াও শহীজলকে ঋণ নেয়ার পরামর্শ দেয়। বোনের কথা মতো শহীজল এনজিও কোডেক থেকে এক লাখ টাকা, তিন মেয়ের জামাইদের থেকে আড়াই লাখ এবং নিজের ৫০ হাজারসহ মোট চার লাখ টাকা জোগাড় করে। 

টাকা জোগাড়ের একদিন পর ২৯ এপ্রিল জুয়েলের সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট আছে বলে জানান আলেয়া। ওইদিন সকালে নগদ চার লাখ টাকাসহ বোন আর ছেলেকে নিয়ে ঢাকার বিমানবন্দরে রওনা হন শহীজল। বিমানবন্দরে আসার পর সানী নামের একজনের ব্যাগে টাকা দেওয়ার জন্য বলেন আলেয়া। সানীকে টাকা দেওয়ার পরপরই জুয়েলের হাতে একটি বিমান টিকেট ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত গিয়ে বিমানে ওঠতে বলেন সানি। 

জুয়েল জানান, তিনি বিমানবন্দরের দুইটি গেট অতিক্রম করার পরপরই তার সাথে দেখা হয় দুইদিন আগে সিঙ্গাপুর যাওয়া ফুফুতো ভাই  আওলাদের। ফুফাতো ভাইকে ঢাকা বিমানবন্দরে পেয়ে জুয়েল থমকে যায়। এরপর ফুফাতো ভাই ভয় দেখিয়ে তাকে বিমানে ওঠায়। তিনিও ওঠেন।  কিছুক্ষণ পর বিমান ছেড়ে দেয়। তার ঘন্টাখানেক পর বিমান চট্টগ্রাম নামে। 

চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে শামীম নামের আরো একজন অপেক্ষা করছিলেন। তারা জুয়েলকে নিয়ে একটি হোটেলে ওঠেন। হোটেলে কক্ষে নিয়ে আওলাদ ও শামীম মিলে জুয়েলকে অস্ত্র দেখিয়ে মেরে ফেলার ভয় দেখান এবং তাদের কথা মতো চলার নির্দেশ দেন। তার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বাড়িতে ফোন করে সিঙ্গাপুর পৌঁছেছে বলে বাবার কাছে সিঙ্গাপুরের পরিচয়পত্রের জন্য তার ফুফুকে আরো দেড় লাখ টাকা দেয়ার কথা বলে। 

জুয়েল জানায়, সকালে হোটেলের এক ব্যক্তির ফোন থেকে বাড়িতে আবার ফোন দিয়ে সঠিক ঘটনা তার বাবাকে জানায়। বাড়িতে ফোন দেয়ার কিছুক্ষণ পর ভাগ্নে ও তার চট্টগ্রামের সহযোগী শামীম চট্টগ্রাম থেকে তাকে আবার বাস যোগে ঢাকায় নিয়ে আসে। পরে ঢাকার সায়েদাবাদ ফেলে রেখে তারা দুজন লাপাত্তা হয়ে যায়। 

শহীজলের প্রতিবেশী আবদুল হালিম জানায়, বোন ও ভাগ্নের সংঘবদ্ধ প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হওয়ার খবর পেয়ে এখন স্থানীয়ভাবে দায়-দেনা করে যে চার লাখ টাকা নিয়েছিল শহীজল, এখন সে টাকা পরিশোধের জন্য এখন পাওনাদারেরা চাপ দিচ্ছে। টাকার জন্য এক মেয়ের জামাই তার মেয়েকে শহীজলের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। অন্য জামাইরাও চাপাচাপি করছে।  

এ ঘটনায় গত ৯ মে তারিখে শহীজল বাদী হয়ে প্রতারণা ও টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে নিজের বোন আলেয়া বেগম, ভাগ্নে আওলাদ হোসেন, আওলাদের শালা সানী, ভাগ্নি জামাই শামীম, ভাগ্নে বৌ আয়েশাসহ ছয়জনকে আসামি করে লক্ষ্মীপুর জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরর পর আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। 

এলাকার স্থানীয়রা জানায়, এমন নিষ্ঠুর আর নির্মম বোন যেন কারো ভাগ্যে না জুটে। আলেয়া নামের সংঘবন্ধ এ অপরাধী চক্রকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেন দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে এমন প্রত্যাশা করেন স্থানীয়রা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh