স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২২ মে ২০২২, ০২:৩৬ পিএম
অর্থনৈতিক সংকট যে কোনো সময় রাজনৈতিক সংকটে রূপ নিতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
অর্থনৈতিক সংকট যে কোনো সময় রাজনৈতিক সংকটে রূপ নিতে পারে। এ সময়ের শ্রীলঙ্কা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আর এ দুই সংকট রাষ্ট্র হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে অকার্যকর করে তোলার দিকে এগিয়ে চলেছে। কয়েক বছর আগেও দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনীতিতে বেশ সংহত অবস্থায় ছিল শ্রীলঙ্কার।
তবে যাচ্ছে তাইভাবে বৈদেশিক ঋণগ্রহণ করার জন্য আগে থেকেই সতর্ক করছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তা আমলে নেওয়া হয়নি। বিশেষ করে গোতাবায়া সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং রাজাপক্ষে পরিবারের সীমাহীন দুর্নীতিকেই এ বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।
ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে খাদ্যপণ্য, ওষুধ ও জ্বালানির অভাবে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন লঙ্কানরা। আর সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও জ্বালাও পোড়াওয়ের মাধ্যমে। সরকারি এমপিদের মারধরসহ নানাভাবে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন সেখানকার জনগণ। তবে অর্থনৈতিক সংকটের জন্য বেশিরভাগ জনসাধারণের ক্ষোভ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং তার ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের ওপর। জনবিক্ষোভের মুখে এরই মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা রনিল ইতিমধ্যে সর্বদলীয় সরকার গড়তে প্রধান বিরোধী দল সামাজি জানা বালাওয়েগায়ায়ের (এসজেবি) নেতা সাজিথ প্রেমাদসাকে চিঠি লিখেছেন।
চিঠিতে নতুন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দলীয় রাজনীতি পাশে সরিয়ে রেখে সবার জনগণের মুখোমুখি হওয়া উচিত। কালবিলম্ব না করে টেকসই অর্থনীতি গড়া উচিত। চিঠিতে রনিল আশা প্রকাশ করেন, পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সমর্থন নিয়ে রাজনৈতিক পথ তৈরি করতে হবে, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে।
রনিল বলেন, ‘দেশকে বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্ত করতে একটাই রাস্তা খোলা আছে, নতুন রাজনৈতিক পথে সবার সর্বোচ্চ শক্তি ও অঙ্গীকার দিয়ে দেশকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যাওয়া।’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নত করতে সব দলকে হাত বাড়িয়ে সমন্বিত চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান রনিল। তবে এতেও বিক্ষোভ দমে যায়নি।
জনবিক্ষোভের শুরু যেভাবে : ২০১৯ সালে গির্জা ও হোটেলে ইস্টার সানডের দিন আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৯০ জন নিহত হওয়ার কয়েক মাস পর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। সে সময় দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম মূল উৎস পর্যটন শিল্পে ইস্টার সানডের হামলা মারাত্মক প্রভাব ফেলে। রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কাকে গভীর অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বের করে আনতে এবং অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সরকারকে তার রাজস্ব বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল, বিশেষ করে বড় অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য যে বিদেশ ঋণ নেওয়া হয়েছিল সেগুলোর স্বার্থে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্যাক্স কাটছাঁটের ঘোষণা দেন। আর এই পদক্ষেপটি বিশ্ব বাজার থেকে দ্রুত ছিটকে দিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। ঋণদাতারা শ্রীলঙ্কার রেটিং ডাউনগ্রেড করে দেয়। বৈদেশিক রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আরো অর্থ ধার করা থেকে বাধা দেওয়া হয়।
গোতাবায়ার বিতর্কিত ও হঠকারী সিদ্ধান্তের মধ্যেই আসে মহামারি করোনাভাইরাসের আঘাত। আর সেই থাবায় পর্যটন শিল্প আক্ষরিক অর্থেই মুখ থুবড়ে পড়ে। দেশের অন্যতম প্রধান রেমিট্যান্সের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাস্তবিক অর্থে পঙ্গু হয়ে যায় দেশটির অর্থনীতি।
এরপর সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই রাজাপক্ষে হঠাৎ করে জৈব চাষের প্রচারের নামে রাসায়নিক সার আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। কৃষিব্যবস্থা নতুন ছাঁচে না সাজিয়ে হঠাৎ করে এমন সরকারি সিদ্ধান্তে কৃষকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ধানের ফসল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রধান খাদ্যের দাম বেড়ে যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও তেলের দাম বাড়িয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যার ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে শ্রীলঙ্কায়। ইউক্রেন যুদ্ধ আমদানিকে আরো অসহনীয় করে তুলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এপ্রিলে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৩০ শতাংশ, খাদ্যের দাম প্রায় পঞ্চাশ ভাগ বেড়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ মিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। আর এ কারণেই এ বছর ৭০০ কোটি ডলার বকেয়া থাকা সত্ত্বেও তা দিতে পারছে না সরকার। মোট ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার ঋণের মধ্যে ২০২৬ সালের মধ্যে আর প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলার শোধ করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে।
গত কয়েক মাস ধরে শ্রীলঙ্কানদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। এর মূল কারণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে আমদানিকৃত খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির চরম ঘাটতি সৃষ্টি করেছে। তেলের ঘাটতির কারণে ব্যাপকভাবে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দেশটি। এরই এক পর্যায়ে জনগণ বিক্ষোভ শুরু করে।
রাজনৈতিক সংকটের মূলে রাজাপক্ষে পরিবার : সাবেক সেনা কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকেই বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী করছেন সাধারণ লঙ্কানরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা মহামারির সময় নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলেছেন গোতাবায়া। গোতাবায়াসহ রাজাপক্ষে পরিবারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য শ্রীলঙ্কার বেহাল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যে কারণে রাজাপক্ষে পরিবারের ওপর ক্ষোভ কেন্দ্রীভূত হয়।
তামিল গেরিলাদের নির্মূল করায় কথিত জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল রাজাপক্ষে পরিবার। তামিল নিধনের জন্য মাহিন্দাকে ‘টার্মিনেটর’ বলে আখ্যায়িত করা হতো তখন। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের দমনে নৃশংস সামরিক পন্থা গ্রহণ করেছিলেন মাহিন্দা। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয় তার বিরুদ্ধে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গৃহযুদ্ধের শেষ দিকে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর নির্বিচার বোমাবর্ষণে প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। রাজাপক্ষে পরিবারের প্রধান ক্যারিশমাটিক নেতা মাহিন্দা ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া তার ভাইকে আবারো দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।
এ দিকে মাহিন্দার শাসনামলে চীনকে আরো কাছে টানে শ্রীলঙ্কা। বেইজিং থেকে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ নিয়ে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও, দুর্নীতির কারণে সেসব প্রকল্প লাভের মুখ দেখেনি।
মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকারে অর্থমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন তার আরেক ভাই বাসিল রাজাপক্ষে। তাকে ‘মিস্টার টেন পারসেন্ট’ বলা হয়। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি চুক্তি থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বাসিলের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়। তবে ব্যাপক জনরোষের মুখে গত এপ্রিলে বাসিলকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মাহিন্দার আমলে পার্লামেন্টের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করা তার আরেক ভাই চামাল রাজাপক্ষের ছেলে শশীন্দ্রের বিরুদ্ধে সার কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সরকারি আইনজীবী হিসেবে কাজ করা মাহিন্দার বড় ছেলে নামাল রাজাপক্ষের বিরুদ্ধেও বিদেশে অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
আর এসব দুর্নীতি, অনিয়ম আর হঠকারী সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হয় জনগণের অনাহারে, অর্ধাহারে থেকে। যে কারণে রাজাপক্ষে পরিবারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জনমত পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই আঘাত করেছে। কারণ এ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই রাজাপক্ষে পরিবারকে এত দিন ধরে জনগণের ওপর রাজ করার ক্ষমতা দিয়েছিল। তবে ইতিহাসের শিক্ষা হলো- বিকল্প রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা না গেলে, এত বিক্ষোভও কোনো গণমুখী বার্তা বহন করতে সক্ষম হবে না।