জিয়াউদ্দীন আহমেদ
প্রকাশ: ২২ মে ২০২২, ০৩:০৫ পিএম | আপডেট: ২২ মে ২০২২, ০৩:০৬ পিএম
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
জনগণের আন্দোলনের মুখে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করেছেন। মন্ত্রিসভার ২৬ জন মন্ত্রী আগেই পদত্যাগ করেছিলেন। মাহিন্দা রাজাপাকসের বাড়িসহ প্রায় এক ডজন বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, অগণিত যানবাহনে আগুন দেওয়া ছাড়াও কয়েকটি নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
শহরে সান্ধ্য আইন, রাস্তায় দেখামাত্র গুলি করার হুকুম জারি করা হয়েছে; কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে এখন প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করছে। রাজাপাকসে পরিবারের আর কাউকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না জনগণ। প্রেসিডেন্ট বাধ্য হয়ে তার কিছু নির্বাহী ক্ষমতা পার্লামেন্টের কাছে হস্তান্তরে রাজি হয়েছেন। সর্বদলীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে গত নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দল মাত্র একটি আসন পেয়েছিল সেই দলের প্রধান রনিল বিক্রমাসিংহেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রনিল বিক্রমাসিংহে এর আগেও পাঁচবার দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। এবার তিনি পাঁচ হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণের দায়ে ঋণ খেলাপি শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নিলেন।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনুকূল না থাকায় শ্রীলঙ্কার শাসক পরিবর্তনে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। রাজাপাকসের পরিবার আবার হয়তো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। গণবিক্ষোভে পতিত স্বৈরশাসকের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার বহু নজির আছে। প্রচণ্ড গণবিক্ষোভে এরশাদ সাহেবের পতনের পর তাকে বহুদিন জেলেও থাকতে হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অস্তিত্ব এখনো সবাই উপলব্ধি করে। ১৯৮৬ সালে এক গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ফিলিপিন্সের স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসপুত্র সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
তবে গণতন্ত্রের কুৎসিৎ রূপ হলো বিরোধী দল সর্বদা সরকারের ব্যর্থতা কামনা করে। বাংলাদেশেও অনেকে মনেপ্রাণে কামনা করছে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হয়ে যাক, বর্তমান সরকারের পতনটা শ্রীলঙ্কার মতো আগুন সন্ত্রাসের তাণ্ডবে পরিসমাপ্তি ঘটুক। শ্রীলঙ্কার এমন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেও কিছুটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশেও বৈদেশিক ঋণে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন।
তবে পার্থক্য হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার মেগা প্রকল্পগুলো তাদের দেশের প্রয়োজনের নিরিখে গুরুত্বহীন; কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সব মেগা প্রকল্প দেশের সমৃদ্ধি আনয়নে জরুরি ও অপরিহার্য। শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারবে না ঋণদাতাদের জানিয়ে দিয়েছে। রিজার্ভে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আছে তা তাদের এক মাসের আমদানি করার জন্যও পর্যাপ্ত নয়। শ্রীলঙ্কার এত দুরবস্থা যে, কেউ ঋণ দিতেও রাজি হচ্ছে না। বাংলাদেশের কাছেও ২৫ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছিল, বাংলাদেশ দিতে রাজি হয়নি, কারণ আগে যে ২০ কোটি ডলার নিয়েছিল তার কিস্তিও পরিশোধ করতে পারেনি।
শ্রীলঙ্কা সরকারের কিছু ভুল পদক্ষেপও দেশে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করার লক্ষ্যে সরকার রাসায়নিক সার আমদানি ও কৃষিতে প্রয়োগ বন্ধ করে দেশীয় পদ্ধতিতে উৎপাদিত জৈবিক সারের প্রয়োগ করে। ফলে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পায়। অন্যদিকে ক্ষমতায় এসেই সরকার ভ্যাটের হার ৫০ শতাংশ হ্রাস করে দেয় এবং এর ফলে রাজস্ব আদায় বিপুল পরিমাণে কমে যায়। রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
শ্রীলঙ্কায় রপ্তানি আয়ও মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়, অন্যদিকে দেশে উৎপাদন কমে যাওয়ায় আমদানির পরিমাণ বেড়ে যায়। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। ফলে শ্রীলঙ্কায় বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। জ্বালানি তেলের সংকট এত তীব্র আকার ধারণ করেছে যে, পেট্রোল পাম্পগুলোতে সেনাবাহিনী রেখে তেলের গ্রাহকদের নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে।
প্রতি বছর প্রচুর বিদেশি পর্যটক দেশটিতে ভ্রমণ করেন। ২০১৯ সনে কলম্বোতে একটি ইসলামপন্থি গ্রুপের সিরিজ বোমা হামলার কারণে পর্যটনে ধস নামে। অন্যদিকে করোনা মহামারি ও মহামারি উত্তর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শ্রীলঙ্কার শুধু পর্যটন খাতে নয়, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের খাতেও ধস নামে। জ্বালানি তেলের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। দেশের অবস্থা কত চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বোঝা যায় যখন সাদা কাগজের অভাবে স্কুল-কলেজের পরীক্ষা বন্ধ থাকে।
শ্রীলঙ্কার আয়-ব্যয়, আমদানি-রফতানি, উৎপাদন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ, ঋণের পরিমাণ ও ধরন ইত্যাদির সাথে তুলনা করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে যে, বাংলাদেশের আর্থিক স্বাস্থ্য এখনো তত দুর্বল হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক অনেক বেশি শক্তিশালী। বেশি সুদ ও স্বল্প মেয়াদের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশে অনেক কম, বাংলাদেশের বেশিরভাগ বৈদেশিক ঋণ দীর্ঘ মেয়াদি। বৈদেশিক ঋণের সুদের গড়পড়তা হার বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২ শতাংশেরও কম, এই হার শ্রীলঙ্কার ৬ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শূন্যের ঘরে নেমে এসেছে; কিন্তু বাংলাদেশের রিজার্ভ এখনো ৪২ বিলিয়ন ডলার।
শ্রীলঙ্কার হাতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আছে তা দিয়ে এক মাসের আমদানির অর্থ পরিশোধ করাও সম্ভব নয়, বাংলাদেশের মজুদ অর্থ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি খরচ মেটানো সম্ভব। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ৬১ শতাংশের সাথে তুলনায় বাংলাদেশের ঋণ মাত্র ১৬ শতাংশ। এই ঋণের বেশিরভাগ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের মতো বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্প সুদ আর সহজ শর্তে গৃহীত। শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয় যেখানে প্রায় স্থবির হয়ে গেছে সেখানে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি। প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণ গত বছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ কমে গেলেও গত মাস থেকে প্রেরিত রেমিট্যান্সে বাড়তি ট্রেন্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় বিদ্যুতের অভাবে যেখানে বাতি জ্বলে না সেখানে বাংলাদেশ অচিরেই উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ নিয়ে অহঙ্কার করবে। বাংলাদেশে সার্বিক কৃষি উৎপাদন সন্তোষজনক। পৃথিবীব্যাপী অধিকাংশ দেশের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মধ্যেও বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৪ শতাংশ।
তবে বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা যত সবল হোক না কেন, সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন অপরিহার্য। চলতি বছরে বাংলাদেশের আমদানি বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ; আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি শ্রীলঙ্কার মতো ব্যাপক। আমদানি ব্যয় ৫০ শতাংশ বাড়লেও দেশে পণ্য কিন্তু বেশি ঢুকছে না; বিশ্ব বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণেই আমাদের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। আমদানি হ্রাস করাও খুব সহজ নয়- জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ শিল্পায়নের জন্য মেশিনপত্র আমদানি করতেই হবে। অন্যদিকে বিশ্ব বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
শ্রীলঙ্কার ঘটনা বাংলাদেশ সরকারকে সচেতন হতে সহায়তা করেছে। সরকার প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রণোদনার হার বৃদ্ধি করেছে, অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি রোধ করতে এলসি মার্জিনে শর্তারোপ করেছে, ডলারের সাথে টাকার দর সমন্বয় করেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ প্রায় নিষিদ্ধ করেছে।
তবে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। রাজস্ব আদায়ে সরকারকে অধিকতর মনোযোগী ও করের আওতার বাইরে থাকা লোকগুলোকে করের আওতায় আনা জরুরি। লাগামহীন ভর্তুকি দিয়ে পণ্যের দর কম রাখার জনপ্রিয় নীতির প্রয়োগে আরো বিচক্ষণ হতে হবে। অন্যদিকে তেয়াত্তর বছর বয়সী নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ঐকমত্যের প্রশাসনের নেতৃত্ব দিয়ে পঙ্গু অর্থনৈতিক সংকট থেকে শ্রীলঙ্কাকে রক্ষা করবে এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
সাবেক নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক