শত্রুপক্ষ

আকদিয়াত কার্তা মিয়ার্জা

সুদেষ্ণা ঘোষ

প্রকাশ: ২২ মে ২০২২, ০৩:২৪ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

ইন্দোনেশিয়ার সাহিত্যিক আকদিয়াত কার্তা মিয়ার্জার জন্ম ১৯১১ সালে, পশ্চিম জাভায়। সোলোতে পড়াশোনা করেন। দর্শনশাস্ত্র এবং সাংবাদিকতার ওপরেই প্রবণতা ছিল সবচেয়ে বেশি। কয়েক বছর ক্যানবেরায় অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেন। ‘নাস্তিক’ ১৯৪৯ তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ‘কেরেতাকান দান এতেগানগান’ ১৯৫০ এবং ‘কেসান দান কেনানাগান’ ১৯৬১ তার জনপ্রিয় গল্পসংকলন।

ঘটনাটা ঘটেছিল অ্যামস্টারডামে। শরতের এক ঝোড়ো সন্ধ্যায়। পথ হারিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করতে হয়েছিল, কী করে ভ্যালেরিয়াস স্ট্রিটে যাব; কিন্তু যাকে জিগেস করলাম তার মুখে ইন্দোনেশিয় ভাষায় জবাব পেয়ে আমি রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম। আমার জার্মান ভাষায় সম্ভাষণের জবাবে তিনি ‘মারডেকা’ বলে আমাকে সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন- ‘এদিক দিয়ে আসুন, সাউদারা।’

আমি যে রাস্তাটা খুঁজছিলাম, ভদ্রলোক অত্যন্ত সহৃদয়ভাবে নিজে সঙ্গে করে আমাকে সেখানে পৌঁছে দিলেন। দেখা গেল, যেখানে আমাদের দেখা হয়েছিল সেখান থেকে মাত্র দুটি মোড় ঘুরেই ভ্যালেরিয়াস স্ট্রিট।

একজন ওলন্দাজের তুলনায় ভদ্রলোকের চেহারাটা একটু ছোটখাটোই বলতে হবে। বাতাসের দমক থেকে সামলে রাখার জন্য থেকে থেকেই তার হাত দুটি মাথার টুপিটার দিকে উঠে যাচ্ছিল। টুপির মতো ভদ্রলোকের ওভারকোটটাও বহু ব্যবহারে জীর্ণ ও মলিন। মুখটা স্পষ্ট দেখতে না পেলেও ভদ্রলোকের কথা বলার শান্ত ভঙ্গিমা আর কোমল কণ্ঠস্বরে মনে হলো, মানুষটা ভালোই। হাঁটতে হাঁটতে উনি জানালেন, বিপ্লবের সময় উনি ইন্দোনেশিয়ায় ছিলেন। আমাকে উনি নিজের বাড়িতেও আমন্ত্রণ জানালেন এবং তখনই আমরা দিনক্ষণ স্থির করে নিলাম।

তিন দিন বাদে নির্ধারিত অপরাহ্নে আমি গিয়ে ভদ্রলোকের দরজার ঘণ্টিটা বাজালাম। উনি নিজেই দরজা খুলে দিলেন, অন্ধকার একটা সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা সোজা চারতলায় গিয়ে উঠলাম। ওখানেই উনি এমন একখানা ঘরে বাস করেন যা এক সরল এবং নিঃসঙ্গ জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। সত্যি বলতে কী ঘরটা খুবই সাধারণ- প্রায় দারিদ্র্য লাঞ্ছিতই বলা চলে। খান-তিনেক চেয়ার, একটা টেবিল, পোশাক রাখার একটা আলমারি এবং একটা ডিভান যা শোয়ার প্রয়োজনও মেটায়। সবকটা আসবাবই ভীষণ পুরনো। সমস্ত কিছুই এলোমেলো, অগোছালো। এখানে সেখানে বই। টেবিলে একটা দাবার ছক- শেষ বার খেলার শেষে সেটাকে তখনও গুছিয়ে রাখা হয়নি। জানলার কাছে ইজেলে একটা অসমাপ্ত ছবি, তুলি আর রঙের টিউবগুলো তার নিচেই মেঝেতে ছড়ানো।

‘আপনি তাহলে আঁকেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘ও শুধু সময় কাটাবার মতো একটা নেশা।’ কোণের দিক থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে, ভদ্রলোক আমাকে সেখানে বসতে বললেন। ঘরের আলোয় তাকিয়ে দেখলাম, প্রথম দিন সন্ধ্যাবেলা ভদ্রলোকের সম্পর্কে আমার যে সমস্ত ধারণা হয়েছিল তা সবই সঠিক। আমার নিমন্ত্রকটির মনোভাব সত্যিই প্রীতিময়, তা সত্ত্বেও উনি যেন একটু অন্য ধাতের মানুষ।

ইজেলের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা ছবির স্তূপটা থেকে ভদ্রলোক আমাকে একটা একটা করে তার আঁকা ছবি দেখাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ছবিগুলোতে নানান ধরনের শৈলী। মনে হলো উনি এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন, প্রচণ্ড পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন; কিন্তু এখনো নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের সঠিক পথটির নিশানা পাননি। ইজেলে তার অসমাপ্ত ছবিটা পাহাড়ের ঢালে একটি ধানক্ষেতের দৃশ্য।

‘এটা প্রিয়াংগানের গ্রামাঞ্চল।’ প্রায় মাড়িয়ে দিতে যাওয়া একটা রঙের টিউব হাতে তুলে নিয়ে ভদ্রলোক আমাকে বললেন, পশ্চিম জাভায় ওই পাহাড়ি গ্রামাঞ্চলটার কথা তার প্রায়ই মনে পড়ে।

‘ভবিষ্যতে আর কোনোদিনও কী ওখানে যাওয়া হবে? উত্তুঙ্গ নীল গেদে পাহাড়ের ঢালগুলোকে মুড়ে রাখা সেই চা-গাছগুলোর মাঝখান দিয়ে আর কোনোদিনও কী আমি ঘুরে বেড়াতে পারবো? রঙিন কেবায়া আর বাটিকের সারং পরা যে সমস্ত গ্রাম্য মেয়েরা সেখানে চা-পাতা তুলতে তুলতে গান করে, আর কোনোদিনও কী আমি তাদের সেই খুশিয়াল গান আর হাসি শুনবো? আর কখনো কী শ্বাস নিতে পারব অরণ্যের সেই সতেজ হিমেল বাতাসে?’

স্পষ্টতই বোঝা গেল, আকুল আকাক্সক্ষা আর সুনিবিড় অনুস্মৃতিতে ভারী হয়ে ওঠা ভাব-প্রবণতায় ডুবে আছেন ভদ্রলোক।

‘কেন হবে না? হবে না, তা আপনি কিছুতেই বলতে পারেন না।’

সামান্য বিষণ্ণ ভঙ্গিমায় বসেছিলেন ভদ্রলোক, পা দুটো আড়াআড়ি ভাবে রাখা। বললেন, ‘এই সুন্দর গ্রামাঞ্চলটাকে আমি এত ভালোবাসি, মনে হয় যেন আমার জন্মভূমি। হয়তো অদ্ভুত...কিন্তু এটা আমি বুঝতে পারি।’

‘কী রকম?’ আমি প্রশ্ন করলাম।

‘ওখানকার পাহাড়গুলো অমন অপূর্ব বলেই আমি জায়গাটাকে অতো ভালোবাসি-ব্যাপারটা ঠিক ততখানি সহজ সরল নয়। কারণ হয়তো আপনি নিজেও জানেন, স্যুইস আল্পসের সৌন্দর্য কী অসাধারণ; কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার কাছে তারা প্রিয়াংগানের গ্রামাঞ্চলের মতো সুন্দর নয়।’

ভদ্রলোক আমার সঙ্গে নেহাতই রসিকতা করছেন ভেবে আমি মৃদু হাসলাম। ‘আমার বিশ্বাস,’ উনি ফের বলতে লাগলেন, ‘আসলে আমার ভালোবাসাটা ওখানকার বাসিন্দা...ওখানকার মানুষ...ওখানকার সহজ সরল বন্ধুত্বপূর্ণ গ্রামীণ মানুষদের জন্য। এটা এমন একটা অনুভূতি যা সমস্তকিছুর মধ্যেই সৌন্দর্য এনে দেয়। যেমন, মনে করুন মরুভূমির কথা। ভালোবাসা যার হৃদয়ে ঝড় তুলেছে তার কাছে ওই অনুর্বর আর বিরক্তিকর একঘেয়ে অঞ্চলও সৌন্দর্যের কল্পলোক হয়ে উঠতে পারে। তাই নয়তো কী?’

আড়াআড়ি ভাবে রাখা পা দুটিকে এবারে পাশাপাশি করে রেখে ভদ্রলোক আমাকে তার কাহিনী বলে যেতে লাগলেন। বললেন, বিপ্লবের সময় তিনি ওলন্দাজ রাজকীয় সেনাবাহিনীর একজন সার্জেন্ট ছিলেন। পরে সীমিত সময়ের জন্য তাকে কয়েদ করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। এর কারণ, তিনি বললেন- যে লোকগুলোর একমাত্র অপরাধ ছিল স্বাধীনভাবে জীবন কাটাবার আকাঙ্ক্ষা, তাদের ওপরে তিনি নির্বিচারে গুলি চালাতে অস্বীকার করেছিলেন।

‘একটা সিগারেট নিন,’ কাহিনী থামিয়ে ভদ্রলোক বললেন। ‘আমি নিজে সিগারেট খাই না। আমি শুধু এটাতে আগ্রহী,’ প্যান্টের পেছন দিকের পকেট থেকে একটা তামাকের নল বের করে, একটা ছাইদানি নিয়ে আসার জন্যে উনি আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেলেন। ‘আসলে পরিস্থিতিটা আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না, আমার ভেতরটা বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল। একদিন সন্ধ্যাবেলা বান্দুঙের দাগো স্ট্রিটে দেখলাম, কয়েকজন সৈনিক রাস্তা দিয়ে সাইকেলে চেপে যেতে থাকা একটা অল্পবয়সী ছেলেকে জোরজার করে থামালো। একেবারে বিনা কারণে ছেলেটাকে তারা পাকড়াও করে নির্দয়ভাবে টানতে টানতে রাস্তার ধারে নিয়ে গিয়ে, তাকে একটা বিজলি বাতির থামের গায়ে টানটান হয়ে দাঁড়াবার হুকুম দিলো। তারপর কোনোরকম সতর্ক না করেই ওদের মধ্যে একজন তলোয়ার দিয়ে ছেলেটিকে এমন এক কোপ মারলো যে তার তলোয়ারটা লোহার থামটাতে লেগে আগুনের ফুলকি ফুটিয়ে তুললো। ভেবে দেখুন, এর সমস্ত কিছুই ঘটে গেল বিনা কারণে। যদিও আসলে এর কারণটা এই যে, ওই হতভাগ্য ছেলেটি এমন এক সম্প্রদায়ের মানুষ যারা পরাধীনতা থেকে মুক্তি চাইছিল। সামান্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছেলেটির আত্মা চরম মুক্তি পেয়ে গেল আর তা নিয়ে কোনোরকম উচ্চবাচ্য হলো না।’

প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে অথচ একেবারে শান্তভাবে ভ্যাঁ বুরে (এটাই ভদ্রলোকের নাম) তার কাহিনীটা বললেন। মাঝে মাঝেই উনি তামাকের নল থেকে মেঝেতে থুথু ঝেড়ে ফেলছিলেন। ইতিমধ্যে দরজার ঘণ্টিটা বেজে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে উনি দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং এক মুহূর্ত পরেই একজন নবাগত ভেতরে এসে ঢুকলো। লোকটা ইন্দোনেশীয়, পরনে গাঢ় নীল রঙের পরিপাটি স্যুট, আকৃতিতে বেঁটেখাটো, নাকটা ছোট্ট, কুতকুতে চোখ দুটো যেন অশান্ত অস্থিরতায় অনবরত এধার-ওধার করছে। লোকটার মাথায় অর্ধেক টাক এবং সেটা তার চওড়া কপালে এক অস্বাভাবিক উচ্চতা এনে দিয়েছে। মানুষটার ভাবভঙ্গি কেমন যেন বিচলিত আর অদ্ভুত ধরনের- যেন খানিকটা উদ্ধত চালচলনের মাধ্যমে সে নিজেকে কোনো একটা সন্দেহ থেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করছে। ভ্যাঁ বুরেকে সে ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। তারপর যেমন এসেছিল তেমনি ভাবেই আবার চলে গেল- আমাকে কোনো সম্ভাষণও জানালো না।

‘লোকটা আমার অনেক দিনের চেনা।’ আমাকে ফের বসতে বলে ভ্যাঁ বুরে বললেন, ‘মাত্র দুদিন আগে ও ইন্দোনেশিয়া থেকে এসেছে। সত্যি বলতে কী, লোকটাকে আমি খুব একটা পছন্দ করি নে।’

তারপর থেকে ভ্যাঁ বুরের বাড়িতে লোকটাকে আমি বেশ কয়েক বারই দেখেছি। প্রতিবারই মনে হয়েছে, লোকটার চালচলন সর্বদা এমন অদ্ভুত আর রহস্যময় কেন। বন্ধুত্ব করার কোনো লক্ষণই সে দেখায়নি।

একদিন বিকেলে ভ্যাঁ বুরে আমাকে ফের তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। যেতেই বললেন, ‘ধান ক্ষেতের ছবিটা শেষ হয়েছে, আপনাকে দেখাবো। আর ইয়ে... আমার কাছে এক বোতল মিঠে শেরি আছে, সেটাও আপনার খুব পছন্দ হবে।’

ছবিটা সত্যিই বেশ ভালো হয়েছিল, যদিও স্পষ্টতই সেটা ভ্যান গগের অনুকরণ।

‘এই অঞ্চলটা আপনি চেনেন?’ আমাদের গ্লাসে শেরি ঢেলে উনি জিজ্ঞেস করলেন।

‘চিনি বইকি!’ বললাম, ‘ওটা জিপানাস জেলা, ওর পেছনেই মহান আগ্নেয়গিরি গেদে।’

‘হ্যাঁ, আমিও জায়গাটাকে ভালোভাবেই চিনি। আসুন, আপনার স্বাস্থ্য কামনায়...’ ভদ্রলোক নিজের গ্লাসটা তুলে ধরলেন।

‘আপনার স্বাস্থ্য!’

আমরা দু’জনে পান করলাম।

‘আপনি ওখানকার মানুষগুলোকেও জানেন নিশ্চয়ই?’

‘না। আমি মুধু গাড়িতে বা বাসে বান্দুং যাবার পথে ওখান দিয়ে গিয়েছি। কাজেই আমার চাইতে সম্ভবত আপনিই ওদের বেশি ভালোভাবে জানেন।’

‘স্বাধীনতার পরে, এখন ওদের জীবন কেমন কাটছে?’

‘বেশ ভালোই।’

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’ এক মুহূর্ত একটু চিন্তা করে উনি ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, ‘ বেশ ভালো’ বলতে আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?’

আমি সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিলাম না। ভদ্রলোক বললেন, ‘ওখানকার কিছু কিছু লোককে আমি চিনি- চাষি আর কিছু ক্ষেত-শ্রমিক। কেউ কেউ অবশ্য চায়ের পাতাও তোলে। আচ্ছা, আপনার কী মনে হয় ক্ষেত-শ্রমিকদের আয় এখন তাদের জীবিকার পক্ষে যথেষ্ট? শুনেছি ওদের মধ্যে অনেকেই নাকি অপুষ্টিতে ভুগছে। এ ধরনের খবর বড্ড অশান্তি দেয়, বুঝেছেন!

আমি জবাব দেবার কোনো সুযোগ পেলাম না, কারণ ঠিক তখুনি দরজার ঘণ্টিটা আমাদের আলোচনায় বাধা দিলো।

‘ওঃ, কে এলো আবার!’ ভ্যাঁ বুরে যেন খানিকটা বিরক্ত হলেন। উনি দরজা খুললেন, কিন্তু কাউকে ভেতরে আসার আহ্বান জানালেন না- বরং নিজেই দরজার আড়ালে উধাও হয়ে গেলেন। তারপরেই আমি সিঁড়ি ভেঙে তার দ্রুত নিচে নেমে যাবার শব্দ পেলাম। একটু বাদে, সামান্য কিছুক্ষণের স্তব্ধতার পরেই, সিঁড়ির নিচ থেকে দুটি রুক্ষ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

আমি তখন বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। ভাবছি, কী হতে পারে ব্যাপারটা।

‘লোকটা একেবারে নির্লজ্জ বেহায়া!’ ভ্যাঁ বুরে ঘরে ঢুকে বললেন, ‘একটা নীতিহীন চরিত্রহীন মানুষ। আদর্শ বলতে কোনো পদার্থই ওর মধ্যে নেই।’

পরিষ্কার বোঝা গেল, উনি সেই পরিপাটি পোশাক-পরা রহস্যময় ইন্দোনেশীয় লোকটার কথা বলছেন।

‘শুনুন, এমন একটা লোককে আপনি কী বলবেন! ওর সঙ্গে আমার পরিচয় দক্ষিণ বান্তেন জেলায়- ১৯৪৭ সালে ইন্দোনেশিয় সাধারণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ওলন্দাজদের তথাকথিত প্রথম পুলিশি আক্রমণের সামান্য কিছুদিন পর।...ঠিক এক সপ্তাহ- আমি এখনো ভুলিনি- কর্তৃপক্ষ আমাকে জেলে ছুঁড়ে দেবার ঠিক এক সপ্তাহ আগে সে আমাকে জানাতে এসেছিল, দেশবাসীর জন্য সে একটা বিরাট ‘কাজ’ করেছে।’

ভ্যাঁ বুরে তাঁর কাহিনীটা শেষ করবার পরে আমি বুঝতে পারলাম, ‘কাজ’ শব্দটা উনি ব্যঙ্গার্থেই ব্যবহার করেছিলেন।

‘একটা পুরো গ্রামকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। পনেরো জন গেরিলা যোদ্ধা-দীর্ঘ পথ হেঁটে তারা তখন গাড়ি-টানা ঘোড়ার মতোই ক্লান্ত, নিঃশেষিত- ওলন্দাজ সেনাবাহিনী তাদের প্রত্যেককে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। নিখুঁতভাবে তাদের ঘিরে ফেলা হয়েছিল। এবং আক্রমণটাও হয়েছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে। কেউ পালাতে পারেনি। প্রত্যেকেই অর্থহীনভাবে মারা পড়েছিল। এই হলো ওই লোকটার বিরাট কাজ।’

কথা বলতে বলতে ভ্যাঁ বুরে একবারও স্থির হয়ে বসতে পারছিলেন না। একবার এগিয়ে গিয়ে জানলার তাকে তামাকের নলটা ঠুকছিলেন, একবার শেরির গ্লাস ভরে নিতে আলমারিটার কাছে ফিরে আসছিলেন, তারপর আবার নিজের চেয়ারের কাছে এসে ডান পাটা তুলে দাঁড়াচ্ছিলেন।

‘জানেন- আর একবার লোকটা বলতে এসেছিল, তার ওই কাজের পুরস্কার হিসেবে তাকে একটা উঁচু পদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তার সব কথা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি; কিন্তু তার কাহিনীগুলো আমাকে বিরক্ত করে তুলতো।’

ভ্যাঁ বুরে কথাগুলো শেষ করে প্রচণ্ড জোরে তামাকের নলটা টানতে শুরু করলেন এবং পরবর্তী কথাগুলো বলার সময় তার ঠোঁট দুটি পরস্পরকে স্পর্শই করছিল না প্রায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এইমাত্র কী এমন ঘটেছিল। উনি বললেন, ‘গতকাল লিদসে প্লেইনের কাছাকাছি ছোটো একটা কাফেতে ঘটনাচক্রে লোকটার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল। যথারীতি সে তার নিজের কীর্তিকাহিনী-বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে তার রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলোও গল্প-শুনিয়ে আমাকে ক্লান্ত করে তুলছিল। শেষঅব্দি আমি এতো বিরক্ত হয়ে উঠলাম যে লোকটাকে খোলাখুলি বলেই দিলাম, সে আদপেই আমার প্রশংসা পাবার উপযুক্ত নয়। তখনই দেখে মনে হয়েছিল, লোকটা বেশ অপমানিত হয়েছে। একটু আগে সে একটা উদ্দেশ্য নিয়েই এখানে এসেছিল। সে আমাকে দেখাতে চেয়েছিল যে যদিও তার সম্পর্কে আমার দারণা খুবই নিচু; কিন্তু অন্যেরা তাকে সম্মান আর প্রশংসার যোগ্য পাত্র বলেই মনে করে। সেই উদ্দেশ্যে লোকটা জাকার্তা থেকে সদ্য সদ্য পাওয়া একটা তারবার্তা আমাকে দেখালো। ওঃ, কী জঘন্য! এমন উল্লাস, এতো গর্ব আর অহঙ্কার নিয়ে সে ওটা আমাকে দেখালো যে শয়তানটা ভেতরে আসার আগেই আমি রীতিমতো রূঢ়ভাবে তাকে বাইরের দরজাটা দেখিয়ে দিলাম।’

‘ লোকটার অতো গর্ব কিসের?’ খানিকটা মজা পেয়ে আমি জানতে চাইলাম।

‘তারটা পেয়েছে বলে গর্ব।’

‘কিন্তু কেন?’

‘আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না... তারটা পাঠিয়েছে একটা রাজনৈতিক দল, লোকটা ওই দলেরই সদস্য। জানানো হয়েছে, আগামী নির্বাচনে ওই লোকটাকে পার্লামেন্টের আসনে একজন প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।’

‘তাই নাকি!’

‘বিশ্বাস হচ্ছে?’

অবাক বিস্ময়ে আমি মাথা নাড়লাম। খানিকক্ষণ আত্মমগ্ন হয়ে থাকার পর অবশেষে ভ্যাঁ বুরে বললেন, ‘এই ধরনের লোক যে সমস্ত মারাত্মক বিপদ-বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে, আশা করি, সেসব থেকে আপনাদের দেশকে রক্ষা করা হবে। রক্ষা করা হবে আপনাদের দেশবাসীর সুখের জন্য... আর...’ ফের খানিকক্ষণ ভাবনার গভীরে মগ্ন হয়ে থেকে উনি বললেন, ‘বিশেষ করে আমার ছোট্ট ছেলেটার জন্য।’

‘আপনার ছোট্ট ছেলে?’ আমি চমকে উঠলাম, ‘কী বলছেন আপনি?’

‘হ্যাঁ, আমার ছোট্ট সোনা-মানিক... আমার সন্তান।’

‘তার মানে আপনি একজনের বাবা?’

‘হ্যাঁ, আমি আমার ছোট্ট জোসেফের বাবা। ওখানে সবাই ওকে ইউসুফ বলে ডাকে। আশা করি সে আজও বেঁচে আছে।’

গ্লাস দুটি ভরে নেবার জন্যে ভ্যাঁ বুরে ফের দেরাজ-আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি তখনো বিস্ময়ে বিমূঢ়। উনি বলতে লাগলেন, ‘ওর মায়ের নাম সিতি- মিষ্টি একটি গ্রামীণ মেয়ে। সিতির প্রেম ছিল সরল আর শান্ত, ওর নিষ্পাপ মনে ছিল খুশির সোহাগ... পাহাড়ি অঞ্চলের অশিক্ষিত মেয়েরা প্রায়ই যেমনটি হয়ে থাকে। রুজির জন্যে ও চায়ের পাতা তুলতো। আমি যখন ওলন্দাজ জেলে পচছি, তখন দুর্ভাগ্যক্রমে এক ক্ষিপ্ত জনতা ওকে খুন করে ফেলে।’

‘খুন?’

‘হ্যাঁ, তারা ওকে একটা কুকুরের মতো খুন করেছিল- ওকে একটা গুপ্তচর... শত্রুপক্ষের সহযোগী মনে করে ওর চরিত্রে কালি দিয়েছিল।’

গ্লাসটা শেষ করে ভ্যাঁ বুরে ফের কয়েক মুহূর্তের জন্য চিন্তায় বিভোর হয়ে গেলেন, হয়তো হারিয়ে গেলেন কিছু মধুর আর বিধুর হয়ে যাওয়া স্মৃতির গভীরে।

‘কিন্তু বলুন তো, বাস্তবে ওই গ্রাম্য মেয়েটি রাজনীতি বা বিপ্লবের কী বুঝতো?’ একই সঙ্গে আবেগ আর বিষাদে মেশানো কণ্ঠস্বরে ভদ্রলোক বললেন, ‘শত্রুর সহযোগী হবার পক্ষে ও ছিল বড্ড বেশি সরল। ও পার্লামেন্টের প্রার্থী ছিল না, ছিল কী? কিন্তু হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম- আমি সর্বদাই ভুলে যাই- ওর একটি সন্তান ছিল এবং সে আমারই সন্তান... শত্রুপক্ষের সন্তান।...’


ভাষান্তর : সুদেষ্ণা ঘোষ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh