দুর্ভিক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্ববাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ মে ২০২২, ০৮:৫৯ পিএম

নানা সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্বের খাদ্য ব্যবস্থা।

নানা সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্বের খাদ্য ব্যবস্থা।

করোনা মহামারি থেকে জীবনযাত্রার নিম্নগামীতা শুরু। ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ শেষে প্রায় দুই বছর পর মানুষ স্বপ্ন দেখছিল ঘুরে দাঁড়াবার। এরমধ্যেই বাজলো ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের দামামা। বোমা ফাটছে ইউক্রেনে, কিন্তু এর তাপ ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর কোনায় কোনায়, মানুষের পেটে। যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে খাদ্য ব্যবস্থা। ফলে এক আসন্ন দুর্ভিক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্ববাসী।

পরিস্থিতি যেভাবে সামনের দিকে যাচ্ছে তাতে এর শেষ কোথায় তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। গত ১৮ মে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আগামী মাসগুলোতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যে প্রচণ্ড ঘাটতি দেখা দেওয়ার হুমকি তৈরি হয়েছে, যা বছরের পর বছর ধরে স্থায়ী হতে পারে।

বিশ্ববাজারে সরবরাহকৃত মোট ক্যালোরির প্রায় ১২ শতাংশ আসে যুদ্ধরত ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। তবে দুই দেশেরই রপ্তানি এখন প্রায় বন্ধ। চলতি বছরে বিশ্ববাজারে গমের দাম ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। জলবায়ুর কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে গমের রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারতও।

খাবারের দাম বৃদ্ধির কারণে এখনই পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন না প্রায় ১৬০ কোটি মানুষ। যেটা কিছুদিন আগেও ছিল ৪৪ কোটিতে। আরো প্রায় ২৫ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন।

যুদ্ধ চলতে থাকলে ও বিশ্ববাজারে রাশিয়া ও ইউক্রেনের রপ্তানি বন্ধ থাকলে আরো কয়েক কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারেন। একারণে রাজনৈতিক অস্থিরতার যেমন বাড়বে, তেমনই শিশুদের জীবনেও এর প্রভাব পড়বে। যারা তিন বেলা খাচ্ছেন তাদের হয়তো এক বেলা কম খেতে হবে।

যদিও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খাবারকে যুদ্ধের অস্ত্র বানাবেন না বলে আশা অনেকের। তবুও আসন্ন অভাব মোকাবিলায় আগেই সচেতনতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্যে প্রয়োজন জরুরিভিত্তিতে বৈশ্বিক সমাধান।

বিশ্বজুড়ে মোট গমের ২৮ শতাংশ, বার্লির ২৯ শতাংশ, ভুট্টার ১৫ শতাংশ এবং সূর্যমুখী তেলের ৭৫ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। লেবানন ও তিউনিসিয়ার আমদানিকৃত খাদ্যশস্যের প্রায় অর্ধেকই রাশিয়া ও ইউক্রেনের; লিবিয়া এবং মিসরের ক্ষেত্রে তা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ।

ইউক্রেনের খাদ্য রপ্তানি বিশ্বের প্রায় ৪০ কোটি মানুষের খাবারের ক্যালোরির যোগান দেয়। যুদ্ধের কারণে দেশটির খাদ্য রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে। কারণ আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ইউক্রেন জলসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া ওডেসা বন্দর অবরোধ করেছে।

আগ্রাসনের আগেই বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২০২২ সাল ভয়াবহ একটি বছর হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছিল।

বিশ্বের বৃহত্তম গম উৎপাদনকারী চীন বলেছে, বৃষ্টির কারণে গত বছর রোপণ বিলম্বিত হওয়ায় এই ফসলের উৎপাদন সবচেয়ে খারাপ হতে পারে। চরম বৈরী তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের অভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উত্পাদনকারী ভারতের পাশাপাশি আমেরিকান অঞ্চলের গমের বেল্ট থেকে ফ্রান্সের বিউস অঞ্চলের রুটির ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত এলাকায়ও এর ফলন হুমকির মুখে পড়েছে।

চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরায় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে প্রবেশ করেছে সেখানকার দেশগুলো। আর এসব কিছু দরিদ্র দেশগুলো ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। 

উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো তাদের বাজেটের ২৫ শতাংশ খাদ্যে এবং সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলে তা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করছে।

মিসরে মানুষের ক্যালোরির চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ পূরণ করে রুটি। অনেক আমদানিকারক দেশের সরকার দরিদ্রদের সহায়তা বৃদ্ধির জন্য ভর্তুকির ব্যয় বহন করতে পারছে না। বিশেষ করে অস্থিতিশীল বাজারের জ্বালানি আমদানি করেও ভর্তুকি দেওয়া যাচ্ছে না।  

সংকট আরো ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইউক্রেন ইতিমধ্যে দেশটিতে যুদ্ধ শুরুর আগে মজুতকৃত গত গ্রীষ্মের ফসলের বেশিরভাগই রপ্তানি করেছে। অতিরিক্ত ব্যয় এবং পরিবহনকারীদের ঝুঁকি সত্ত্বেও রাশিয়া এখনও খাদ্য শস্য বিক্রি করছে। তবে যুদ্ধে ইউক্রেনের গুদামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সেগুলো ভুট্টা এবং বার্লিতে পূর্ণ রয়েছে।

দেশটিতে আগামী জুনের শেষের দিকে কৃষকদের পরবর্তী ফসল মজুত করতে হবে। কিন্তু মজুত করার জায়গা না থাকায় নতুন ফসল পচে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাশিয়া সাধারণত ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বীজ এবং কীটনাশক কিনে থাকে। তবে যুদ্ধের কারণে এবার বীজ এবং কীটনাশকের সংকটে পড়তে পারে দেশটি।

শস্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা বিশ্বের অন্য স্থান থেকেও ঘাটতি পূরণ করতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ হলো অস্থিতিশীল দাম। তবে আরো ভয়াবহ সংকট হলো সার ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে লাভের পরিমাণ সঙ্কুচিত হচ্ছে। এসবই কৃষকদের প্রধান ব্যয়। নিষেধাজ্ঞা এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট উভয় বাজারকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষকরা যদি সারের ব্যবহার কমিয়ে দেন, তাহলে ভুল এই সময়ে বিশ্বজুড়ে ফসলের উৎপাদন কমে যাবে।

উদ্বিগ্ন রাজনীতিকদের প্রতিক্রিয়া খারাপ পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর কাজাখস্তান থেকে কুয়েত পর্যন্ত বিশ্বের অন্তত ২৩টি দেশ খাদ্য রপ্তানিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। আর এসব দেশের রপ্তানি বিশ্বজুড়ে সরবরাহকৃত মোট খাদ্যের প্রায় ১০ শতাংশের যোগান দেয়। বিশ্বে সারের মোট রপ্তানির এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি সীমিত হয়েছে। চলমান এই সংকটে যদি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় তাহলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। ফলে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি। সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh