নাগরিক প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করবে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল?

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২২, ০২:২১ পিএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু যেমন আমাদের গর্বের স্থাপনা, তেমনি দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্ত হতে যাওয়া মেট্রোরেলও দেশের, বিশেষ করে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য একটি মাইলফলক; কিন্তু পদ্মা সেতুর টোল নিয়ে যেমন নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, তেমনি মেট্রোরেলের প্রস্তাবিত ভাড়া নিয়েও নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।

মেট্রোরেল চালু হলেই রাজধানীর চিরচেনা যানজটের অবসান হবে কি না? যদি না হয় তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে কেন এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যেহেতু মেট্রোরেলের সব রুট চালু হতে সময় লাগবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত, ততদিনে ঢাকার জনসংখ্যা আরো কী পরিমাণ বাড়বে। 

মেট্রোরেল স্টেশনে একসঙ্গে শত শত মানুষ নামার পরে তারা নির্ধারিত গন্তব্যে যেতে পর্যাপ্ত যানবাহন পাবেন কি-না; কতটুকু দূরে গিয়ে যানবাহন পেতে হবে; মানুষের হাঁটার মতো পর্যাপ্ত ফুটপাত থাকবে কি-না ইত্যাদি প্রশ্নও জনমনে রয়েছে। কারণ যে কোনো মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয় মেগা সমস্যার সমাধান মাথায় রেখে; কিন্তু যদি শেষ পর্যন্ত সেই মেগা প্রকল্পটি সামগ্রিকভাবে ওই মেগা সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। 

মেট্রোরেলে প্রস্তাবিত ভাড়া 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি প্রাথমিকভাবে মেট্রোরেলের যে ভাড়া ঠিক করেছে, সেখানে সর্বনিম্ন ২০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৯০ টাকা। অর্থাৎ যেকোনো স্টেশন থেকে মেট্রোতে উঠে পরবর্তী স্টেশনে নেমে গেলেও ২০ টাকা দিতে হবে। ২০ টাকা দিয়ে সর্বোচ্চ দুই স্টেশন যেতে পারবেন যাত্রীরা। এরপর প্রতি স্টেশনে যেতে ১০ টাকা যোগ হবে। এভাবে দুই প্রান্তের দুই স্টেশনে (উত্তরা ও মতিঝিল) যেতে সর্বোচ্চ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৯০ টাকা।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাতে গণমাধ্যমের খবর বলছে, ভাড়া নির্ধারণে মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। শুধু দৈনন্দিন পরিচালনার ব্যয় ধরে সম্ভাব্য ভাড়ার হার নির্ধারণ করা হয়েছে; কিন্তু তারপরও উত্তরা থেকে মতিঝিল ২০ কিলোমিটারের ভাড়া ৯০ টাকা নির্ধারণ যুক্তিসঙ্গত নয় এবং প্রতিদিন একজন অফিসগামী সাধারণ মানুষের জন্য আসা-যাওয়ায় ১৮০ টাকা শুধু মেট্রোরেলের ভাড়া দেওয়া সহজ হবে না। ফলে তারা হয়তো আগের মতোই বাসে যাবেন, জ্যাম থাকা সত্ত্বেও।

রাজধানীতে যেখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা, সেখানে রাষ্ট্রীয় মালিনাকাধীন গণপরিবহন মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া কী করে ২০ টাকা হয়? আর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের ভাড়া হবে ৯০ টাকা। প্রশ্ন হলো, এখন বাসে উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে কত টাকা লাগে? বাসের চেয়ে মেট্রোরেলের ভাড়া কেন দ্বিগুণ হবে? এটি তো ব্যক্তিমালিকাধীন কোনো পরিবহন নয়।

সারা পৃথিবীতেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গণপরিবহনের ভাড়া হয় যথেষ্ট কম; কিন্তু আমাদের এখানে কেন উল্টো? সরকার কি ব্যবসা করার জন্য মেট্রোরেল চালু করবে, না-কি মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য? যদি ব্যবসাই মূল উদ্দেশ্য হয় এবং ভাড়া যদি বেশি হয় তাহলে বিরাট অংশের মানুষের পক্ষে এই মেট্রোরেল ব্যবহার করা সম্ভব হবে না।

উত্তরায় যার বাসা, তাকে যদি প্রতিদিন মতিঝিলে তার কর্মস্থলে যাওয়া-আসায় ১৮০ টাকা খরচ করতে হয়, সেটি কতজনের পক্ষে বহন করা সম্ভব? অনেকে হয়তো সিএনজি, অটোরিকশা বা প্রাইভেট কারের সাথে এই ভাড়ার তুলনা করবেন; কিন্তু সিএনজি, অটোরিকশা আর প্রাইভেট কারে কত শতাংশ মানুষ যাতায়াত করেন?

কলকাতা ও টরন্টোর চেয়ে বেশি 

প্রতিবেশী কলকাতা শহরের প্রধান গণপরিহন মেট্রোরেল। সেখানেও যে ভাড়া, তা ঢাকার মেট্রোরেলের প্রস্তাবিত ভাড়ার চেয়ে অনেক কম। যেমন উত্তর-দক্ষিণ রুটে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ এবং সর্বোচ্চ ২৫ রুপি। ২৫ রুপি দিয়ে ২০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে যাওয়া যায়। পূর্ব-পশ্চিম রুটে ন্যূনতম ভাড়া ৫ রুপি। এই ভাড়া দিয়ে সর্বোচ্চ দুই কিলোকিটার দূরত্বে যাওয়া যাবে। এই রুটে সর্বোচ্চ ভাড়া ৩০ রুপি। অর্থাৎ পূর্ব-পশ্চিম রুটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে একবার যাতায়াতে টিকিটের সর্বোচ্চ দাম ৩০ রুপি। এক বছরের জন্যও স্মার্ট কার্ড কেনা যায়, যার দাম ১০০ থেকে এক হাজার রুপি। 

পর্যটকদের জন্য রয়েছে বিশেষ কার্ড। যেমন ২৫০ রুপি দিয়ে একটি কার্ড কিনলে তিনি তিন দিন ইচ্ছেমতো ভ্রমণ করতে পারবেন। আর ৫৫০ টাকার কার্ড কিনলে ৫ দিন যত খুশি তত ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। 

কানাডার সবচেয়ে বড় শহর টরেন্টোতে ৩.২৫ ডলারের (বাংলাদেশি প্রায় ২৩০ টাকা) টোকেন কিনলে মেট্রোর এক নেটওয়ার্কে দুই ঘণ্টা ভ্রমণ করা যায়। 

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য থাকে সেবা, ব্যবসা নয়। সুতরাং যখন সেবার প্রশ্ন তখন সেখানে ভর্তুকি দিতে হয়। সেই ভর্তুকির টাকাও প্রকারান্তরে জনগণই দেয়। কারণ জনগণ যে ট্যাক্স ও ভ্যাট দেয়, সেই টাকারই একটি অংশ ভর্তুকির কাজে লাগে। সুতরাং সেতু ও মেট্রোরেল বানাতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে বলে সেখানে অনেক বেশি টোল ও ভাড়া নির্ধারণ করা হবে, সেটা যৌক্তিক নয়। কারণ সরকারের উদ্দেশ্য যেহেতু ব্যবসা করা নয় বরং নাগরিকের চলাচল নির্বিঘ্ন, সহজ ও আরামদায় করার ফলে সেখানে ভাবতে হবে রাষ্ট্রের সবচেয়ে কম আয়ের মানুষটিও কীভাবে ওই সেবাটি পেতে পারেন।

পদ্মা সেতুর টোল 

আগামী জুনের মাঝামাঝিতে স্বপ্নের পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় স্থাপনা নির্মাণ নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিরাট অহংকারের বিষয়; কিন্তু এই সেতু পার হওয়ার জন্য যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক বিতর্ক হচ্ছে। কারণ যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি এত দিনকার ফেরি সার্ভিসের দেড়গুণ এবং যমুনা নদীর ওপরে নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলের প্রায় দ্বিগুণ।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, সেতু বিভাগ পদ্মা সেতুর যে টোল নির্ধারণ করেছে সেটি কার্যকর হলে যাত্রীবাহী বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং মাঝারি ট্রাককে টোল দিতে হবে ২ হাজার ৮০০ টাকা। বর্তমানে পদ্মা নদী পার হতে ফেরিতে যানবাহন ভেদে ভাড়া দিতে হয় ৭০ থেকে ৩ হাজার ৯৪০ টাকা; কিন্তু পদ্মা সেতুতে যানবাহনভেদে টোল দিতে হবে ১০০ থেকে ৬ হাজার টাকার বেশি। এর মধ্যে কার ও জিপের টোল ৭৫০ টাকা, যা ফেরিতে ৫০০ টাকা; বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা, যা ফেরিতে ১ হাজার ৫৮০ টাকা; মাঝারি ট্রাকে ২ হাজার ৮০০ টাকা, যা ফেরিতে ১ হাজার ৮৫০ টাকা।

এছাড়া পদ্মা সেতু পার হতে বড় ট্রাক ৫ হাজার ৫০০, মাঝারি বাস ২ হাজার, ছোট বাস ১ হাজার ৪০০, পিকআপ ১ হাজার ২০০, মাইক্রোবাস ১ হাজার ৩০০ টাকা এবং মোটরসাইকেলকে ১০০ টাকা টোল দিতে হবে। শুধু তাই নয়, এই টোল ১৫ বছরের জন্য প্রযোজ্য হবে। প্রতি ১৫ বছর পরপর টোলের হার ১০ শতাংশ করে বাড়ানো হবে।

তবে এটা ঠিক, পদ্মা সেতু চালু হলে শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দিতে যানবাহনগুলোকে ফেরি পার হওয়ার জন্য যে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষায় থাকতে হয়, সেই পরিস্থিতির অবসান হবে। ফলে যাত্রীরা এই সেতু পার হয়ে কোথাও যেতে চাইলে একটা মোটামুটি সময় সম্পর্কে ধারণা রাখতে পারবেন যে, তিনি হয়তো ঢাকা থেকে চার ঘণ্টায় খুলনায় পৌঁছে যাবেন। পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি পুরো একদিনও যেভাবে ফেরিঘাটে অপেক্ষা করতে হয় এবং অনেক সময় পচনশীল দ্রব্য ঝুঁকিতে পড়ে, সেই পরিস্থিতি থাকবে না। ফেরি পার হতে গিয়ে বাসকে যে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় এবং আবহাওয়া খারাপ থাকলে অথবা ঈদের মতো উৎসবের সময় যে ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়, সেই পরিস্থিতির অবসান হবে। সুতরাং এর একটি অর্থনৈতিক মূল্য আছে।

সর্বনিম্ন আয়ের মানুষেই বিবেচ্য 

রাষ্ট্রের গণপরিবহন পরিকল্পনা হতে হবে সর্বনিম্ন আয়ের মানুষকে মাথায় রেখে। যেভাবে চাল-ডাল-আলু-তেল-নুন-আটা-ডিমের মতো নিত্যপণ্যের দামও সর্বনিম্ন আয়ের মানুষটিকে মাথায় রেখে নির্ধারণ করতে হয়; কিন্তু আমাদের দেশের বাজারে এ সব নীতি-নৈতিকতার কোনো ভাত নেই। যে যেভাবে পারেন জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়; কিন্তু জিনিসপত্র দোকানে অবিক্রিতও পড়ে থাকে না। কারণ প্রচুর মানুষের পকেটে পয়সা আছে। 

সুতরাং নিম্ন আয়ের কোন লোকটি চাল কেনার পরে ডাল বা তেল কিনতে পারলেন না, তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মাথায় তো চিন্তা নেই, এমনকি রাষ্ট্রেরও মাথাব্যথা নেই। নেই বলেই মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা আর উত্তরা থেকে মতিঝিলের ভাড়া ৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

তবে পদ্মা সেতুর টোল এবং মেট্রোরেলের প্রস্তাবিত ভাড়ার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো, এই দুটি মেগা প্রকল্প থেকে নাগরিকরা কতটা সুফল পাবেন? রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিআরটিসি বাসের যে দশা আমরা দেখি, ২-৩ বছরের মধ্যে মেট্রোরেলের চেহারা যদি সেরকম হয়ে যায়, তাহলে বিরাট অংকের এই প্রকল্পটি একটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে। তারও চেয়ে বড় কথা, রাজধানীতে মেট্রোরেলের সবগুলো রুট চালু হতে সময় লাগবে ২০৩০ সাল। 

এই সময়কালে রাজধানী ঢাকার লোকসংখ্যা আর কী পরিমাণ বাড়বে এবং মেট্রোরেল চালু হবার পরেও ঢাকা শহরের কত শতাংশ যানজট আসলে কমবে? প্রতিটি স্টেশনে নামার পরে যাত্রীদের যে চাপ তৈরি হবে, সেটি সামাল দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ফুটপাত কোথায়? মেট্রো স্টেশনকে ঘিরে কি ব্যক্তিগত বাহন, সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা ও মোটরসাইকেলের যে বিরাট জটলা লেগে যাবে, সেটির ব্যবস্থাপনা কী হবে? রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh