আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : অমর গীতিকবির প্রস্থান

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২২, ১০:২০ এএম | আপডেট: ২৯ মে ২০২২, ১১:৪১ এএম

দীপংকর গৌতম

দীপংকর গৌতম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে তিন সাংবাদিক অনুজকে ‘আপদ, বিপদ, মুসিবত’ নামে ডাকতেন, সেই ত্রয়ীর শেষ ব্যক্তি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে যেন শব্দবন্ধটি শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু প্রয়াত এ বি এম মূসাকে বলতেন আপদ, প্রয়াত ফয়েজ আহমদকে বলতেন বিপদ আর সদ্যপ্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে বলতেন মুসিবত। এই কথাটি মিথের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছিলেন ইতিহাসের একটি অধ্যায়। পড়াশোনা আর অভিজ্ঞতা মিলিয়ে একজন পরিপূর্ণ মানুষ।

বিশেষত তার ইতিহাস, সংস্কৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান ছিল এতই প্রখর যেকোনো সময়, যেকোনো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত। বর্ণনা রীতি, ভাষার ব্যবহার, যুক্তির প্রখরতা, সেই সঙ্গে বাংলার লোকজ গল্পের মিশেল তার লেখা ও বলা দুটিকেই করেছিল জনপ্রিয়। তিনি মানুষের চাহিদা, ভাষা, সময় বুঝতেন। তার সময়জ্ঞান কতটা যথাযথ ছিল সেটা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।’ গীতিকবিতাটি দেখলে স্পষ্ট হয়।

তিনি লেখার আগেই তার পাঠককে নির্বাচন করতেন। যে কারণে পাঠক অপেক্ষায় থাকত তার কলামের জন্য, কবে সামনের রাজনীতির ধারণাটা পাওয়া যাবে। ইতিহাস তার ঠোঁটস্থ ছিল, এর যথাযথ কারণও ছিল। 

আবদুল গাফফার চৌধুরীর বাবা ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী ছিলেন রাজনীতি সচেতন ও ব্রিটিশশাসিত ভারতের কংগ্রেস নেতা। তিনি বরিশাল জেলা কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সদস্য ছিলেন অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির। তদানীন্তন কংগ্রেস নেতা, মতিলাল নেহরুর সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছেন ওয়াহেদ চৌধুরী। 

মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়ার একটি রাজনীতি সচেতন শিক্ষিত পরিবার থেকে এসেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। যেকোনো মানুষের বিকশিত হওয়ার জন্য পরিবার সবচেয়ে বড় একটা ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, তার পরবর্তী দাঙ্গা, পাকিস্তানিদের বাঙালির ওপর শাসন ত্রাসন সবই প্রত্যক্ষ করেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে পাকিস্তানবিরোধী স্বাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’য় লেখালেখি শুরু করেন। এসময় তিনি কলকাতায় ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবেও কাজ করতেন। অর্থাৎ বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামের মূল সময়টাকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন একদম কাছে থেকে। তাই তিনি সবকিছু চমৎকারভাবে বর্ণনা করতে পারতেন, বলতে পারতেন। 

১৯৭৪ সালে গুরুতর অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য আবদুল গাফফার চৌধুরী পাড়ি জমান লন্ডনে। তখন থেকে প্রবাসজীবন শুরু হলেও তার চিন্তা-ভাবনার পুরোটা জুড়ে ছিল বাংলাদেশ।

সারাজীবন সোচ্চার ছিলেন লেখালেখি নিয়ে। ভাষা দিবসের গানের গীতিকবি হিসাবে যেমন, তেমনি পরিচিত ছিলেন একজন কলামিস্ট হিসাবে। একটি জীবন কাটিয়ে দিলেন- শুধুই লিখে। কী মানসিক শক্তি নিয়ে এ কাজটা তিনি করতেন তা ভাবা যায় না। তার লেখার বিষয়, দর্শন বা তথ্য উপাত্ত নিয়ে অনেকেরই কথা থাকতে পারে। কিন্তু তারপরও তিনি একটি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন-শুধু লিখে। আবদুল গাফফার চৌধুরী জীবনে আর কিছু চাননি। শুধু সাংবাদিক হতে চেয়েছিলেন। তিনি তার সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তার নাম মানেই এক কলম সৈনিকের, একজন সৃষ্টিশীল মানুষের নাম। তিনি দল নিরপেক্ষ ছিলেন না, আওয়ামীপন্থি লেখক হিসাবে তার পরিচিতি ছিল। 

তবে তিনি তার দলের গঠনমূলক সমালোচনা করতে সামান্য দ্বিধা করতেন না। ভাষা কাঠামো নির্মাণে তার প্রাতস্বিকতা ছিল। স্বল্প শিক্ষিত একজন মানুষ যেমন তার লেখা পড়ে- মুগ্ধ হতো, আবার শিক্ষিত মানুষও। সহজ ভাষায় যুক্তি দিয়ে তার মতকে তুলে ধরায় জুড়ি ছিল না। 

একজন কলামিস্ট যে কালের কত্থক তা অনিরুদ্ধ (সন্তোষ গুপ্ত), গাছপাথর (অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী), নির্মল সেন ও গাফফার চৌধুরীর লেখায় বোঝা যেত। গানের পাশাপাশি বাংলা কথাসাহিত্যের আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন অনন্য। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত তার দুটি গল্পগ্রন্থ কৃষ্ণপক্ষ এবং সম্রাটের ছবিকে এ দেশের কথাসাহিত্যে একটি ভিন্ন ধারার বিনির্মাণ বললে অত্যুক্তি হবে না। 

এছাড়াও ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘সম্রাটের ছবি’, ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’, ‘বাঙালি না বাংলাদেশি’সহ তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৩০। তিনি কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘একজন তাহমিনা’, ‘রক্তাক্ত আগস্ট’ ও ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’- এর একটা বইও ফেলনা নয়। একথা বহুজন বিদিত যে প্রয়াত নির্মল সেন ও গাফ্ফার চৌধুরী যদি রাজনীতি আর সাংবাদিকতা ছেড়ে শুধু সাহিত্যচর্চা করতেন তবে সাহিত্যে অনেক ধ্রুপদী বিষয়-আশয় যুক্ত হতো। 

তার লেখা ছিল সহজবোধ্য তাতে তথ্য, তত্ত্ব ও রসবোধের সাথে বর্ণনা রীতি ছিল অসাধারণ। লেখাকে সহজবোধ্য করতে প্রচলিত গল্পের ভাষায় তিনি রাজনীতির শক্ত বিষযগুলোর গেরো খুলে দিতেন। রাজনীতিক মোনায়েম সরকারের চামেলীবাগের বাসায় আমি তার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। আবদুল গাফফার চৌধুরী যে গুণটার কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তাহলো- যে কাউকে প্রথম দর্শনেই এত দ্রুত আপন করে তার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতে কাছে টেনে নিতেন, অভিভূত হতে হতো। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পড়াশোনা, জানাশোনা ও অভিজ্ঞতার সাথে অবিশ্বস্য রকমের স্মরণশক্তি ছিল। যে কারণে যত মানুষ থাক,বক্তা তিনি একাই। তার প্রজ্ঞা, মেধা ও অভিজ্ঞতার মিশেলে তৈরি পাণ্ডিত্যের কাছে অন্য কেউ বলার সুযোগ পেতেন না, বা বলতে চাইতেন না। এটা ছিল তার জ্ঞানলব্ধ আলোচনার শক্তি। কত পাণ্ডিত্য থাকলে এ কাজটা করা যায় তা বলে শেষ করা যাবে না। প্রয়াত নির্মল সেন, ফয়েজ আহমদের মধ্যেও এ গুণ দেখেছি।

যত সমালোচনাই থাকুক, এটাই সত্য যে গাফফার চৌধুরীর পাঠক ছিল ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশে অন্য কোনো কলামিস্টের এত বিপুলসংখ্যক ও সব শ্রেণীর পাঠক ছিল বলে জানা নেই। সাংবাদিকতার সেই সোনাঝড়া দিনগুলোতে অনিরুদ্ধ (সন্তোষ গুপ্ত), গাছপাথর (অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী), অনিকেত (নির্মল সেন) ও গাফ্ফার চৌধুরীর লেখার জন্য সবাই অপেক্ষা করতো। ‘সেই রাম নেই সেই অযোধ্যাও নেই’। আজ আর কারো কলামের জন্য কারো অপেক্ষা আছে কি না জানি না।

পত্রিকা পাঠকের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। পড়ার অভ্যেসটা একদম হ্রাস পেয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত পাঠক যার নাম দেখলে কলামটা পড়তো, তিনি ছিলেন ভাষা সৈনিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট গাফ্ফার চৌধুরী। তার পাঠক ছিল ভুবন জোড়া। ইতিহাসের অলিগলি দিয়ে চলার কারণে তিনি ছিলেন ইতিহাস সচেতন। দর্শন সংস্কৃতির মিশেলে তার কলামে রাজনীতির ব্যাখ্যা করতেন। হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। একটি শতাব্দীর প্রায় পুরোটা সময় তিনি পরিভ্রমণ করেছেন এবং বিস্ময়ের দিক হলো লেখাকে পেশা করে কাটিয়ে দিয়েছেন। 

গাফ্ফার চৌধুরী চলে গেছেন। করোনায় গত দু’বছরে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন করার শক্তি ক্রমশ কমছে। মৌলবাদ শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত আফগানিস্তান, পাকিস্তান সবখানে বাড়ছে। এমন সময়ে গাফ্ফার চৌধুরীর চলে যাওয়াটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। 

আবদুল গাফফার চৌধুরীর কিডনির অবস্থা দেখে ডাক্তাররা বলেছিলেন, হয়তো সাত মাস বাঁচতে পারেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে একটা লেখায় বলেছিলেন- আশা করছিলাম দেশে তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে নতুন মুজিববাদী দল গড়ে উঠবে। ১৯৫৪ সালে যেমন একজন শেখ মুজিব মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমনি এই অন্ধকার যুগেও একজন নতুন শেখ মুজিবের দেখা পাব। তার সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বলীয়ান এক তরুণ প্রজন্মের আবির্ভাব দেখে যেতে পারব। যদি না পারি-এই আশঙ্কা নিয়েই রোগশয্যায় শুয়ে দিন কাটাচ্ছি। যাতে দৈহিক শান্তির মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে পারি, সেজন্য আমার পাঠকদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করছি। (‘রেখো মা দাসেরে মনে’, আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২১,) তারও আগে তিনি যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, যাওয়ার সময় অনেককেই আক্ষেপের স্বরে বলেছিলেন তিনি আর হয়তো ফিরবেন না। সেই ফিরলেন কিন্তু কফিনে। 

গাফ্ফার চৌধুরী একটিই গীতি কবিতা লিখেছিলেন। এরপরে আর না লিখলেও তার আয়ু বাংলা ও বাঙালির সমান। তিনি নিজেকে অতিক্রম করেছিলেন তার লেখা দিয়ে। তার জীবন ও সংগ্রামের  প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও গবেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh