উদ্বোধনের অপেক্ষায় স্বপ্নের সেতু

সেলিম আহমেদ

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২২, ১০:১৯ এএম

পদ্মা সেতু। ফাইল ছবি

পদ্মা সেতু। ফাইল ছবি

প্রমত্তা পদ্মার বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে সেতুটির নির্মাণকাজ। সেতুটিকে নিয়ে এখন আর স্বপ্ন নয়, বরং ছুঁয়ে দেখার ক্ষণ গুনছেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। এই প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হবে আগামী ২৫ জুন। ওই দিনই যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে সেতুটির দ্বার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে জাঁকজমক করতে নানা প্রস্তুতিও চলছে। 

সেতুতে গাড়ির চাকা ঘোরার সাথে পাল্লা দিয়ে পাল্টাবে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জীবনমান। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র, বাধা আর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নির্মিত হওয়া এই সেতুটি শুধু একটি সেতু নয়, এটি বাংলাদেশের সক্ষমতারও প্রতীক। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। আবারো প্রমাণ করেছে কোনো ষড়যন্ত্রের কাছে বাংলাদেশ মাথা নত করে না। আর এর নেপথ্যের কারিগর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার প্রচেষ্টা আর দৃঢ় মনোবলের কারণেই নির্মিত হয়েছে সেতুটি। 

জসীম শেখের বয়স ষাটের কাছাকাছি। বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরে। ঢাকায় ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছিলেন গ্রামের বাড়িতে। গত ৬ জুন বিকেলে তার সাথে কথা হয় মাওয়ার শিমুলিয়া ফেরিঘাটে। জসীম শেখ বলেন, যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখছি পদ্মার উপর একটি সেতু হবে। এই সেতুর জন্য আমরা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ কত যে ভোগান্তির শিকার হয়েছি, তা বলে বোঝাতে পারব না। সর্বনাশা এই পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ে কত শত মানুষকে জলে চাপা দিয়ে নিঃস্ব করেছে সেই সংখ্যাও গুনে বের করা সম্ভব নয়। তবে পদ্মা সেতু নিয়ে আর স্বপ্ন নয়, এবার ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষা। সেই অপেক্ষার প্রহর গুনছি আমরা। 

এই ঘাটেই কথা হয় জাজিরার বেলাল চৌধুরীর সাথে। স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষক বেলাল চৌধুরী বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের জন্য কতটা প্রয়োজনীয় বা কেন স্বপ্নের সেতু বলছি, তা বোঝাতে পারব না। এ ফেরিঘাটে অ্যাম্বুলেন্স আটকে মাকে হারানো সন্তান জানে পদ্মা সেতুর প্রয়োজন কী? ৩ ঘণ্টা দেরি হওয়াতে ইন্টারভিউ দিতে না পারা বেকার ছেলেটি জানে পদ্মা সেতুর প্রয়োজন কী? কুয়াশার কারণে ফেরি বন্ধ হলে ফ্লাইট মিস করা রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসী জানে পদ্মা সেতুর প্রয়োজন কী?

সারা বছর পরিচর্যার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরিঘাটের গরমে থেকে বস্তায় পচে যাওয়া সবজিগুলো দেখা কৃষকটি বলতে পারবে পদ্মা সেতুর প্রয়োজন কী? প্রচণ্ড ঝড়ে পদ্মায় ট্রলারসহ ডুবে যাওয়া সন্তানকে খুঁজে না পাওয়া বাবা-মা জানে পদ্মা সেতুর প্রয়োজন কী? তাই সেতু পার হওয়ার অপেক্ষার তর সইছে না আমাদের।

জসীম শেখ ও বেলাল চৌধুরীর মতো অপেক্ষার প্রহর আর কাটছে না দেশের দক্ষিণাঞ্চলের তিন কোটি মানুষের। প্রমত্তা পদ্মার বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ছুটে যাবেন এপার থেকে ওপারে- সেই আনন্দেই বিভোর তারা। দীর্ঘ দিনের লালিত সেই স্বপ্ন পূরণ হতে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চলতি মাসে ২৫ তারিখই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। 

এই পদ্মা সেতু এক সুতায় গাঁথবে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে। তাই তো দক্ষিণের ঘরে ঘরে এখন পদ্মা সেতুর কথা চলছে। 

বদলে যাবে ২১ জেলার চিত্র : পদ্মা সেতু ঘিরে ইতোমধ্যেই হাসি ফুটেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৩ কোটি মানুষের মধ্যে। তারা স্বপ্ন দেখছেন সোনালি ভবিষ্যতের। সেতুটি চালু হলে তা শুধু এ অঞ্চলের জনগণের জীবনমানকে এগিয়ে নেবে তা নয়, বরং এটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুরো বাংলাদেশের মানুষের জীবনকেই এগিয়ে নেবে। পুরো দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু হবে একটি নতুন মাইলফলক। 

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দুয়ার খুলবে। যোগাযোগ সহজীকরণের ফলে এখানকার মানুষের জীবনে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। এই সেতুর কারণে সারা দেশের সাথে সামাজিক-অর্থনৈতিক সেতুবন্ধ রচনা হবে। 

এ সেতুর কারণে শুধু শিল্প খাতেই নয়, সুফল পাওয়া যাবে কৃষি ও পর্যটন খাতেও। দক্ষিণাঞ্চলে এসব সম্প্রসারণ জাতীয় অর্থনীতিকে করবে আরো চাঙ্গা। দীর্ঘ দিন নৌপথের ঝক্কি আর সারা দিনের সময় অপচয়ের বদলে এখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এসব অঞ্চল থেকে পণ্যবাহী ট্রাক পৌঁছবে রাজধানীতে। 

পদ্মা সেতুর কারণে যে জেলাগুলো সরাসরি লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে সেগুলো হলো- খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী।

মাওয়া ফেরিঘাটে কথা হয় সবজি ব্যবসায়ী ফয়সাল মিয়ার সাথে। যশোর থেকে সবজি নিয়ে ঢাকার আড়তে বিক্রি করেন তিনি। ফয়সাল মিয়া বলেন, প্রায় দুই দশক থেকে সবজি ব্যবসা করি আমি। এই পদ্মায় ব্রিজ না থাকার কারণে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে আমাদের। এমনও হয়েছে যে, রাতে ট্রাকে মাল নিয়ে ফেরি আর জ্যামের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। পরে যখন ঢাকায় মাল পৌঁছেছে, তখন তার অনেকগুলোই নষ্ট হয়েছে। এখন সেতু হলে এ সমস্যাটা আর হবে না। আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাজধানীতে পৌঁছতে পারব।

খুলনার মাছ ব্যবসায়ী পাভেল আহমদ বলেন, মাছ চাষের জন্য খুলনা ও বাগেরহাট বিখ্যাত; কিন্তু এসব মাছ ঢাকার বাজারে নেওয়া ছিল বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। একদিকে যেমন যাতায়াত খরচ বেশি ছিল, অন্যদিকে ঢাকায় নেওয়ার আগেই রাস্তা ও ফেরিতে জ্যামের কারণে অনেক মাছ নষ্ট হয়ে যেত। এখন আর সেটি হবে না। সোনালি দিন আসায় আমাদের অঞ্চলের অনেক চাষিই মাছ চাষে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছেন। 

শরীয়তপুরের জাজিজার বাসিন্দা আব্দুল কাদির বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে আমাদের জীবনমানের যে উন্নয়ন হবে, তার প্রভাব কিন্তু ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। অনেক ব্যবসায়ীই ইন্ডাস্ট্রি করার জন্য জমি কিনে রেখেছেন। ইন্ডাস্ট্রি চালু হলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এছাড়াও ১০ বছর আগে আমাদের অঞ্চলে জমির মূল্য যা ছিল, এখন তা কয়েকগুণ বেড়েছে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকেও শরীয়তপুর যথেষ্ট লাভবান বলে বলে আমি মনে করি। 

এক নজরে পদ্মা সেতু : ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ২০০৪ সালের জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে। মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু করার চূড়ান্ত নকশা করা হয়।

২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়। পরে নকশা পরিবর্তন করে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ে। ২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আবারো আট হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সবশেষ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পুরো টাকাই সরকারি অর্থায়ন।

পদ্মা সেতু নির্মাণে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ অঙ্গীকার করেছিল বিশ্বব্যাংক; কিন্তু অনিয়মের অভিযোগ তুলে এই অঙ্গীকার থেকে সংস্থাটি সরে যায়। এ ধরনের কাজের শর্ত অনুযায়ী, মূল ঋণদাতা চলে গেলে অন্যরাও চলে যায়। কাজেই একে একে এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও চলে যায়। এরপর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পদ্মা সেতু নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির নাম চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের আওতাধীন চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি। আর এটির নকশা তৈরি করেছে আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএমের (AECOM) নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল। সেতুটি দ্বিতলবিশিষ্ট। এর নিচতলা দিয়ে চলবে ট্রেন আর উপরতলায় রয়েছে ৪ লেনের সড়ক।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh