হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনে ভারতের মসজিদ

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২২, ০৩:৫৪ পিএম

নব্বইয়ের দশকে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া ছিল হিন্দুত্ববাদের দিল্লি জয়ের মহড়া। ছবি: পিটিআই

নব্বইয়ের দশকে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া ছিল হিন্দুত্ববাদের দিল্লি জয়ের মহড়া। ছবি: পিটিআই

রাম জন্মভূমি ও মন্দিরের অস্তিত্ব দাবি করে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে পাঁচশ বছরের পুরনো অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। যার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শুরু দেশভাগের আগে থেকেই। সে মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের মোহর লাগার পর এটি আরো স্পষ্ট হয় যে, এ সময়ে ভারতের বিচার বিভাগও মসজিদ ভাঙার সহায়ক ভিন্ন কিছু নয়। 

সম্প্রতি একের পর এক মসজিদ ও মুসলিম স্থাপনার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করাকে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর হামলার কৌশল হিসেবে নিয়েছে। 

সম্প্রতি ভারতে মুসলিমদের বেশ কিছু মসজিদ ও স্থাপনা নতুন করে হিন্দুত্ববাদীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- উত্তর প্রদেশের জ্ঞানবাপি মসজিদ, দিল্লির কুতুব মিনার, মথুরার শাহী ঈদগাহ মসজিদ, আগ্রার তাজমহল ও আজমিরের বিখ্যাত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগাকে নিজেদের ধর্মীয় পীঠস্থান দাবি করেছে হিন্দুত্ববাদীরা।

জ্ঞানবাপি মসজিদ নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, সেখানকার অজু করার পুকুরে শিবলিঙ্গ মিলেছে এবং মসজিদটির একাংশ তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়। হিন্দুদের বেশ কিছু মন্দির ভেঙে কুতুব মিনার তৈরি করা হয়েছে বলেও দাবি তাদের। মথুরার শাহী ঈদগাহ মসজিদকে কৃষ্ণের জন্মস্থান, তাজমহলকে তেজো মন্দির দাবি করেছে তারা। তাজমহলের নিচের ২২টি ঘর খুলে দেওয়ার দাবি তুলেছেন বিজেপির অযোধ্যা ইউনিটের মিডিয়া ইনচার্জ রজনীশ সিংহ। এমনকি আজমিরের বিখ্যাত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগাকেও হিন্দু মন্দির বলে দাবি করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। এসব ঘটনা গত মাসের এবং এর মধ্যে তাজমহল বাদে বাকি চারটি স্থাপনা নিয়ে আদালতে গেছে তারা।

ভারতে উপাসনার স্থান (বিশেষ বিধান) আইন অনুযায়ী, দেশভাগের পর কোনো উপাসনালয়ের রূপান্তর নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও হিন্দুত্ববাদীদের আপিল কিংবা পিটিশনকে আমলে নিয়ে নিম্ন আদালত থেকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা একে হিন্দুত্ববাদী যোগসাজশ হিসেবে দেখছেন। প্রাবন্ধিক অধ্যাপক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, অযোধ্যার রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কে রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জাস্টিস রঞ্জন গগৈসহ পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ। সে বেঞ্চ বলেছিল, উক্ত রায় সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে দেখাই বাঞ্ছনীয় এবং এই রায় ১৯৯১ সালে প্রণীত উপাসনার স্থান (বিশেষ বিধান) আইনের মূল প্রতিপাদ্যটির ব্যত্যয় নয়। আইনটির চার নম্বর ধারায় বলা হয়, ভারতের কোথাও কোনো ধর্মস্থানের চরিত্র ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে অপরিবর্তনীয় বলে বিবেচিত হবে। রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলা একমাত্র ব্যতিক্রম। কেননা এ মামলার বয়স স্বাধীনতার চেয়েও পুরনো এবং এই আইনের তথা রায়ের স্পিরিট অতঃপর পবিত্রতার সাথে পালিত হবে, নতুন করে আর কোনো ধর্মস্থান নিয়ে অনুরূপ বিতর্ক মাথাচাড়া দেবে না- এমন কথায় বিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় পেয়ে যাওয়ার পরই বিশ্বহিন্দু পরিষদের সেই আলোচিত স্লোগান এখন প্রতিফলিত হচ্ছে- ‘ইয়ে তো সিরফ ঝাঁকি হ্যায়/ কাশী মথুরা বাকি হ্যায়।’

ভারতীয় কলামিস্ট উমাং পোদ্দার বলেন, ‘ভারতের আদালতগুলো মসজিদ-মন্দির বিতর্ককে সামনে এনে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে পুষ্টি জুগিয়ে চলেছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘অযোধ্যার বাবরি মসজিদ, বারানসির জ্ঞানবাপি মসজিদ, মথুরার শাহী ঈদগাহ মসজিদ, দিল্লির কুতুব মিনার কিংবা মধ্য প্রদেশের কামাল-উদ-দীন মসজিদ-সবক্ষেত্রেই এটা সত্য যে, আদালতের রায়ের মধ্য দিয়েই বিতর্ক জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। নিম্ন আদালত এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।’

বিষয়টিকে নরম করে ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু ধর্মীয় স্থানগুলো দখলে নিতে আদালতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে হিন্দুত্ববাদীরা। ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত বলেন, ‘প্রতিটি মসজিদের একটি ইতিহাস আছে, যা আমরা পরিবর্তন করতে পারি না। সেই ইতিহাস আমরা লিখিনি, না বর্তমানের হিন্দু বা মুসলিম এটা লিখেছে। এটা অতীতে ঘটেছে। যখন ইসলাম আসে, তারা ভারতীয়দের মনোবল ভাঙতে একাধিক মন্দির ধ্বংস করেছিল।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘এটাও এক ধরনের পূজা (নামাজ)। তারা আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে এসেছে। আমরা কোনো ধরনের পূজার বিপক্ষে নই।’ তবে আদালতকে ঢাল হিসেবে দাঁড় করিয়ে আরএসএস প্রধান বলেন, ‘যে বা যারা এই মসজিদ মামলার সাথে যুক্ত তাদের উচিত একত্রে বসে পারস্পরিক সম্মতিতে একটি উপায় খুঁজে বের করা। মানুষ আদালতের দ্বারস্থ হলে আদালতের রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ না করে সেই রায় মেনে নিতে হবে।’

মুঘল যুগের জ্ঞানবাপি মসজিদ সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদীরা বারানসির দেওয়ানি আদালতে দুটি মামলা দায়ের করেছে, যা থেকে বিতর্কের শুরু। ১৯৯১ সালে ‘স্বয়ম্ভূ ভগবান বিশ্বেশ্বর’-এর ভক্তদের দিয়ে বারানসি দেওয়ানি আদালতে প্রথম মামলা দায়ের করা হয়। তারা দাবি করেন, জ্ঞানবাপি মসজিদ প্লটটিতে মূলত একটি মন্দির ছিল এবং সেখানে পূজা করার অনুমতি চেয়েছিল। অযোধ্যা রাম জন্মভূমি বিবাদে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের পর ডিসেম্বর, ২০১৯ সালে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। বারানসিভিত্তিক একজন আইনজীবী নিম্ন আদালতে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তিনি এটি নির্মাণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। বারানসি আদালত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে (এএসআই) একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। জ্ঞানবাপি মসজিদ পরিচালনাকারী আঞ্জুমান ইন্তেজামিয়া মসজিদ কমিটি এবং সুন্নি কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ড সেই আদেশের বিরোধিতা করেছিল। বিষয়টি তখন এলাহাবাদ হাইকোর্টে নিয়ে যাওয়া হলে এএসআইকে মসজিদের জায়গার সমীক্ষা করার নির্দেশ দেওয়ার আদেশের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।

২০২১ সালের মার্চে ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবড়ের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ ধর্মীয় উপাসনায় আইনের বৈধতা পরীক্ষা করতে সম্মত হয়েছিল। আগস্টে পাঁচজন হিন্দু নারী বারানসি আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করেছিলেন, যাতে জ্ঞানবাপি কাঠামোর অভ্যন্তরে প্রতিদিনের প্রার্থনা পরিচালনা করার অনুমতি দেওয়া হয়। গত এপ্রিলে বারানসি আদালত সাইটটি পরিদর্শনের নির্দেশ দেন। একই সাথে আদালত একটি ভিডিওগ্রাফি সমীক্ষার নির্দেশ দেন। এর পরই সেখানে নামাজ আদায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই মাসের শুরুতে জ্ঞানবাপি মসজিদ কমপ্লেক্সের আদালত-নির্দেশিত ভিডিওগ্রাফি জরিপ সম্পন্ন হয় এবং হিন্দু পক্ষের একজন আইনজীবী দাবি করেন যে, কূপের ভেতরে একটি শিবলিঙ্গ পাওয়া গেছে। ভিডিওগ্রাফি সমীক্ষার জন্য বারানসি আদালতের আদেশকে আঞ্জুমান ইন্তেজামিয়া মসজিদ কমিটি এলাহাবাদ হাইকোর্টের সামনে চ্যালেঞ্জ করেছিল; কিন্তু উচ্চ আদালত সেই আদেশকে বহাল রাখেন।

মুসলিম কৌঁসুলি পক্ষ আদালত নিযুক্ত সার্ভে কমিশনার অজয় কুমার মিশ্রের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ করে এবং দাবি করে যে, তিনি আদালতের অনুমতির বাইরে মসজিদের ভেতর থেকে ভিডিওগ্রাফি করার চেষ্টা করেছিলেন। তারা মসজিদ কমপ্লেক্সের ভিডিওগ্রাফি জরিপকে উপাসনা স্থান আইন, ১৯৯১-এর লঙ্ঘন বলেও অভিহিত করেন। এরপর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে নামাজ আদায়ের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। মুসলিমদের আইনজীবী নিজাম পাশা বলেছেন, ‘জরিপের অনুমতি ধর্মীয় বিতর্ক উসকে দেওয়ারই নামান্তর।’

ভারতের পার্লামেন্টের মুসলিম আইনপ্রণেতা আসাদুদ্দীন ওয়াইসির মতে, সাত দশক আগে বাবরি মসজিদের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছিল, এবারো তা-ই ঘটছে। জ্ঞানবাপি মসজিদের ঘটনা নিয়ে ওয়াইসি টুইটারে লিখেছেন, ‘এটা ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসের হুবহু পুনরাবৃত্তি। আদালতের এ সংক্রান্ত আদেশ মসজিদের ধর্মীয় প্রকৃতিই বদলে দিয়েছে। এটা ১৯৯১ সালের আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh