আতিক-তাপসের দুই বছর

অঙ্গীকার কেবলই কাগুজে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২২, ১০:২৪ এএম

মো. আতিকুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। ছবি: সংগৃহীত

মো. আতিকুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দুই মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব গ্রহণের পর দুজনই পার করলেন দুই বছর।

ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ২০২০ সালের ১৩ মে এবং দক্ষিণে শেখ ফজলে নূর তাপস তিন দিন পর ১৬ মে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই জুটি নগরবাসীর কাছে তাদের দেওয়া অঙ্গীকার যেন কাগুজে প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কোনোটিই সম্পূর্ণভাবে তারা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হননি বলে মনে করছেন নগর বিশ্লেষকরা।

জানা গেছে, নির্বাচনী ইশতেহারে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল একটি সুস্থ, প্রাণবন্ত ও আধুনিক শহর গড়ে তোলার জন্য ৩৮টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে দক্ষিণের মেয়র তাপস নির্বাচনী ইশতেহারে প্রায় ৫০টি প্রতিশ্রুতি নিয়ে একটি ঐতিহ্যবাহী, সুন্দর, প্রাণবন্ত সুশাসিত ও উন্নত ঢাকা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিলেন; কিন্তু দুই বছরের ব্যবধানে এখন পর্যন্ত দুই মেয়র তাদের অধিকাংশ অঙ্গীকারই বাস্তবায়ন করতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছেন। উভয় মেয়রই ঢাকার ভয়ানক যানজটের উন্নতি, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ এবং মশার উপদ্রব নির্মূলসহ সাহসী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন; কিন্তু তারা এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই সম্পূর্ণরূপে পূরণ করতে সক্ষম হননি।

প্রার্থীদ্বয়ের প্রতিশ্রুতি : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধা দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নির্বাচনের আগে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নির্বাচিত দুই নগর পিতা ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও মো. আতিকুল ইসলাম। 

এর মধ্যে, ৯০ দিনের মধ্যে মৌলিক চাহিদা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস। অন্যদিকে আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন উত্তরের নগর পিতা আতিকুল ইসলাম। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণকে একটি আধুনিক সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছিলেন সরকার দলীয় এ দুই মেয়র।

আতিকুলের প্রতিশ্রুতি : নগরবাসীর জন্য সুস্থ, সচল ও আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম নির্বাচনী ইশতেহারে ৩৮টি প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছিলেন। মাদকমুক্ত ঢাকা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে অবশ্যই ঢাকাকে জলজট, যানজট, মাদকমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন।

তাপসের প্রতিশ্রুতি : ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রপ্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস উন্নত ঢাকা গড়তে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে উন্নত ঢাকা গড়ে তোলাসহ নির্বাচনী ইশতেহারে ৫০টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। রাস্তাঘাটের অবকাঠামো উন্নয়ন, পয়ঃনিষ্কাশন, বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা ছাড়াও প্রার্থীর ইশতেহারে ‘ঐতিহ্যের, সুন্দর, সচল, সুশাসিত ও উন্নত ঢাকা’ গড়ার বিষয় প্রাধান্য পায়।

যানজট দূরীকরণ : দুই মেয়রই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি ছিল নগরীর ট্রাফিক পরিস্থিতির উন্নয়ন, যা বাস্তবে এর অবনতি হয়েছে দুই বছরে। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৮ সালে যানজটের কারণে কর্মঘণ্টার ক্ষতি ছিল ৫০ লাখ ঘণ্টা, যা ২০২২ সাল নাগাদ প্রতিদিন ৮২ লাখে উন্নীত হয়েছে এবং আর্থিক ক্ষতির কারণে তা ১০১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৩৯ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।

ডিএনসিসি মেয়র আতিকুলের নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকারে বোর্ডের সব স্টেকহোল্ডারদের সাথে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অন্তর্ভুক্ত ছিল; রাস্তা পারাপারের জন্য পুশ বোতাম সংকেত ইনস্টল করা; স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য ডেডিকেটেড পরিবহন চালু করা; বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন নাগরিকদের জন্য সরকারি সুবিধা এবং তাদের জন্য গণপরিবহন নিশ্চিত করা; পার্কিং লট স্থাপন এবং বৈদ্যুতিক বাস চালু করা- যার সবই এখন পর্যন্ত অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।

আবার ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার তাপস দ্রুত চলমান যানবাহন, ধীরগতির যানবাহন এবং পায়ে হেঁটে চলা মানুষের জন্য আলাদা রাস্তা তৈরির পাশাপাশি রাস্তা পারাপারের উন্নতির জন্য গণপরিবহন আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- যা অনেকটাই অপূর্ণ রয়ে গেছে।

তবে উভয় সিটি করপোরেশন এ পর্যন্ত বিআরটিএর সহযোগিতায় বাস রুট যৌক্তিককরণ পরিসেবা চালু করেছে, তাও শুধুমাত্র একটি রুটে। তাদের আরো তিনটি রুটে পরিসেবা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা নগর পরিবহন, যে নামে বাস রুট রেশনালাইজেশন চলছে, একই কোম্পানির বাসগুলো সিটি করপোরেশন বা কোনো নির্দিষ্ট সংস্থার নিয়ন্ত্রণে চলে গেলেই যানজট কমানো সম্ভব হবে।

মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘নগরীর প্রতিটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল বাসের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করেছি। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেব।’

নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর আদিল মুহম্মদ খান বলেন, ‘যে ডেডিকেটেড বাস সার্ভিস যে কোনো শহরের যানজট কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজধানীর অসহনীয় যানজটের অন্যতম কারণ হলো প্রাইভেট কার। গণপরিবহনের মান উন্নত না হলে ঢাকায় যানজট নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ যদি আগামী দু-এক বছরের মধ্যে ঢাকা নগর পরিবহনের অধীনে প্রায় ৪০০০-৫০০০ বাস চালু করতে পারে, তাহলে যানজট সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।’ 

জলাবদ্ধতা দূর করা : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মেয়রের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি নগরীর খালগুলো ওয়াসা থেকে সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। তবে উভয় পক্ষই এখনো খালের জল প্রবাহের তেমন উন্নতি করতে পারেনি। অর্জন করতে পারেনি সমস্ত জলাশয়ের নিয়ন্ত্রণ। যার ফলস্বরূপ সামান্য বৃষ্টিতেও নগরীতে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতার। 

যদিও ডিএসসিসি মেয়র তাপসের দাবি এই বর্ষাকালে নগরবাসী ৩০ মিনিটের মধ্যে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে, যা তার মতে এক ঘণ্টা সময় লাগত। অন্যদিকে বিগত বছরের তুলনায় নগরীতে জলাবদ্ধতা কমেছে বলে দাবি করেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল।

২০২০ সাল থেকে জলাবদ্ধতার হটস্পটগুলো ১৪২ থেকে ৪২-এ নেমে এসেছে দাবি করে ডিএনসিসি মেয়র বলেন, ঢাকা উত্তরের জলাবদ্ধতা দ্রুত মোকাবেলায় ১০টি এলাকার জন্য ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ঢাকার খাল-নদী উদ্ধারে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে তেমন কোনো লাভ হবে বলে আমি মনে করি না। এছাড়া এমন সনাতনী পদ্ধতিতে খাল উদ্ধার করে জলাবদ্ধতা থেকে ঢাকাকে বাঁচানো সম্ভব নয় বলেও তিনি জানান।

কাটেনি মশার আতঙ্ক : মশা নিয়ন্ত্রণে গত অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকা থেকে ২০ কোটি টাকা এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ৮০.৫ কোটি টাকা বরাদ্দ থেকে ৫৫.৫ কোটি টাকা ব্যয় করতে সক্ষম হয়েছে।

এ দিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ডিএনসিসির জন্য ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা রয়েছে, ঢাকা দক্ষিণের জন্য ৩৫.৩০ কোটি টাকা। তবে তহবিলের বেশিরভাগই কীটনাশক কেনার জন্য বলে জানা গেছে।

গত বছর দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড করেছে। ২০২১ সালে ২৮,৪২৯ জন ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এবং ১০৫ জন মারা গিয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, মশাবাহী রোগ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব গত বছরের চেয়ে এ বছর আরো ভয়াবহ হতে পারে। 

কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, চলতি বছরেও আমরা শুনতে পাচ্ছি প্রতিদিন প্রায় ১০-১২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন, যা ভালো খবর নয়।

তিনি আরো বলেন, প্রাণঘাতী ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা নির্মূলে সিটি করপোরেশন যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ভাইরাস ট্র্যাকিং করা এবং রোগীদের অবস্থান অনুযায়ী, ওষুধ প্রয়োগ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

সতর্ক করে দিয়ে এই কীটতত্ত্ববিদ আরো বলেন, এডিস মশা দ্বারা সৃষ্ট আরেকটি মারাত্মক রোগ চিকুনগুনিয়াও এ বছর হতে পারে। আর এ জন্য আগে থেকেই আমাদের সচেতন হওয়া দরকার। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয় বলেও অভিযোগ তার।

ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অনেক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে উত্তর সিটি করপোরেশনে একটি দ্রুত অ্যাকশন টিম কাজ করছে।

অপরদিকে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গু রোগীর বাসা ও আশপাশের ৪০০ গজের মধ্যে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : ঢাকার দুই মেয়রই রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের পুরোপুরি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি তাদের মেয়াদের দুই বছরের মধ্যেও ব্যর্থ হয়েছে। যদিও বেশ কয়েকটি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) স্থাপন করা হয়েছে, তবে সংখ্যাটি অপর্যাপ্ত। এসটিএস জোনের বাইরেও বর্জ্য ডাম্পিং হয় এবং প্রায়শই খোলা থাকে।

ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার তাপস বলেন, দক্ষিণ সিটি এ পর্যন্ত ৫১টি এসটিএস স্থাপন করেছেন এবং আরো ১১টির কাজ চলছে।

ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, উত্তর সিটির অধীনে সব ওয়ার্ডে এসটিএস রয়েছে এবং বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ চলছে। ২০২৩ সালের মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নতি দৃশ্যমান হবে বলে তিনি আশাবাদী।

বায়ু ও শব্দদূষণ হ্রাস : গত কয়েক বছর ধরে ঢাকা সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় থাকলেও সিটি করপোরেশনের কোনোটিই বায়ু বা শব্দ দূষণ কমানোর জন্য তেমন কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল জানান, বায়ুদূষণ কমাতে ইলেকট্রিক বাস চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। একই লক্ষ্যে পানি স্প্রে করতে দুটি ‘হাই-টেক’ সজ্জিত স্প্রে কামান ব্যবহার করা হয়।

আবার ডিএসসিসি মেয়র শেখ তাপস বলেন, বায়ুদূষণে পরিবহনে ব্যবহৃত জ্বালানি ৮০ ভাগ দায়ী, ইটভাটা ১০ ভাগ এবং বাকি ১০ ভাগ কারখানা ও অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে হচ্ছে। তাছাড়া যানজটই শব্দ দূষণের প্রধান কারণ এবং এটির উন্নয়নে কাজ চলছে। 

তিনি আরো বলেন, এলোমেলোভাবে হর্ন বাজানো বিধিনিষেধ কার্যকর করা হবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh