প্রাগে যেভাবে বেড়ে উঠেছিলেন কাফকা

সুদেষ্ণা ঘোষ

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২২, ০৩:২৩ পিএম

ফ্রানৎস কাফকা। ছবি: সংগৃহীত

ফ্রানৎস কাফকা। ছবি: সংগৃহীত

বাবা ছিলেন কঠোর, সন্তানের উপর ছিল যার অসীম কর্তৃত্ব। পড়ালেখা করেছিলেন আইনে, অনিচ্ছার এক চাকরি করতেন বীমা কম্পানির আইনজীবী হিসেবে। ৩৪ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে বিষণ্ণতার মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়েছিলেন। মাত্র ৪১ বছরের জীবন হয়ে উঠেছিল অসহনীয়। সামাজিক উদ্বেগ যেন তার জীবনযাপনকে করে তুলেছিল আরও বেশি বিষণ্ণ, এবং ক্ষত-বিক্ষত করেছিল তার সত্তাকে। 

রূপান্তর গল্পের প্রধান চরিত্র এক ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা গ্রেগর সামসা, একদিন সকালে ঘুম ভাঙলে তিনি এক কিম্ভূতকিমাকার বিরাট পোকা রূপে নিজেকে আবিষ্কার করেন। তারপর থেকেই শুরু হয় অসহনীয় এক পরিস্থিতি। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার কারণে তার বিক্রেতার চাকরি হারান এবং ধীরে ধীরে গোটা পরিবারের সহানুভূতিও হারান তিনি। পরিবারে হয়ে ওঠেন অবাঞ্ছিত। এক সময় গ্রেগর সামসা মারা গেলেন, ঘরের পরিচারিকা ময়লার সঙ্গে বাইরে ফেলে দিয়ে আসেন আমাদের সামসাকেও। এই গ্রেগর সামসার মডেল হিসেবে অনেক আলোচক লেখককেই দেখেন। কেননা তার জীবনের বিচিত্র সকল অভিজ্ঞতার স্বরূপ গল্পের চরিত্রের মধ্যে আবর্তিত হয়েছে দারুণভাবে।

তিনি অদ্ভুত পক্ষপাতিত্ব, লজ্জা এবং অপরাধবোধ বা এমন বাজে অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন বারংবার। তার সৃষ্টি অন্য রচনা ‘দ্য ট্রায়াল’-এও ব্যাংক কর্মচারীকে এক সকালে গ্রেপ্তার করা হয়, বড় কোনো অপরাধ না করেই তিনি অপরাধী হয়ে যান। শেষ পর্যন্ত তিনি তার বিরুদ্ধে আসল অভিযোগ সম্পর্কেও জানতে পারেননি। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসের এই লেখক আর কেউ নন, ফ্রানৎস কাফকা। কাফকা লেখক হিসেবে নিজেকে দেখেননি, কী লিখেছেন না লিখেছেন তা নিয়েও যেন তার নিজের ভাবনা ছিল না একদমই। নিজের সমস্ত লেখাকে পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর কিছুকাল আগে কাফকা তার নিজের যাবতীয় লেখাপত্র, লিখে রাখা চিঠি আর স্মৃতিচারণামূলক বই বহুদিনের বন্ধু মাক্স ব্রডকে দেন। সেগুলো দেওয়ার সময় একটা অনুরোধও করেছিলেন তিনি, সব কিছুই যেন তার মৃত্যুর পর ধ্বংস করে ফেলা হয়। বন্ধু ব্রড তা করেননি। কাফকার জীবদ্দশাতে খুব কম রচনাই প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর পরই সিংহভাগ প্রকাশিত হয়। ফ্রানৎস কাফকার সাহিত্যকর্মই তার লেখক সত্তাকে চিরজীবী করেছে।

কাফকা নিজের বাবার রূঢ় আচরণের জন্য দোষারোপ করেছেন বাবাকে। সম্ভবত কাফকার সাহিত্যকর্মগুলোতে যে নেতিবাচক ও আত্ম-ধ্বংসাত্মক মূলভাব প্রদর্শন করেছে, সেটির শিকড় হয়তো প্রাগে, তারই নিজের পরিবারে, শৈশবেই প্রোথিত। আজকের শহর প্রাগ, সেখানে পা রাখলে কাফকার স্মৃতিচিহ্নগুলো খুব যে হৃদয়কে আন্দোলিত করবে তেমনটি নয়। এশিয়ানদের নয় এ স্বভাব ইউরোপীয়রা নিজেদের অতীত-ঐতিহ্য সংরক্ষণে যথেষ্ট সচেতন; কিন্তু এই প্রাগে এসে তারা কিছুটা ব্যতিক্রম। কাফকাকে অডেন বলেছেন, ‘বিংশ শতকের দান্তে’। জার্মানভাষী বোহেমিয়ান লেখক কাফকাকে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়। তার রচনা, বাস্তবতা এবং কল্পনাপ্রসূত উপাদানগুলোকে মিশেল করে তার নায়কেরা প্রতি-নায়ক, যারা সামাজিক-আমলাতান্ত্রিক শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরাজিত। এই লেখক কাফকার জন্মভিটির কোনো অস্তিত্ব এখন নেই।

১৮৯৭ সালে বাড়িটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ২০০০ সালে এখানে ফ্রানৎস কাফকা স্কয়ার স্থাপিত হয়। এ ছাড়াও ওল্ড টাউনে দুসনি ও ভেজেনস্কয়া সড়ক দুটি যেখানে মিলিত হয়েছে, সেখানে ফ্রানৎস কাফকা সৌধ গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে এলে চোখে পড়বে ব্রোঞ্জনির্মিত ১২ ফুট লম্বা একটি ভাস্কর্য; কাফকার আদলে তৈরি। ঢোলা কোটের ভিতরে ছোটখাটো রুগ্ন একজন মানুষের অবয়ব। এটিরই একটি ১২ ইঞ্চি সংস্করণ কাফকা সোসাইটির বার্ষিক পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হয়ে থাকে।

‘রূপান্তর’ সৃষ্টি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তৈরি হলেও এটি যে স্থানে বসে লেখা, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ঠিকানাটি হচ্ছে ৩০ নম্বর, পারিজস্কা। কাফকা স্কয়ার থেকে জায়গাটি নিকটেই। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ধ্বংস করা হয়। বর্তমানে এখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। প্রাগে কাফকার যৌনজীবন সম্পর্কিত তথ্য রয়েছে এবং তা স্বাভাবিকভাবেই বিতর্কিত। ওল্ড টাউন স্কয়ারের বাইরে ৬ নম্বর, সেখানে কামজিকোভাতে একটি প্রায় অদৃশ্য গলি রয়েছে। এখন এখানে রাশিয়ান পর্যটকদের জন্য একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে, নাম-য়ূ কারভেনেভো পাভা, বাংলায় ‘লাল ময়ূরের ডেরা’। তবে পূর্বে এই জায়গায় একটি উঁচুমানের পতিতালয় ছিল। এখানে মোটামুটি বিত্তবান লোকজনেরই আনাগোনা ছিল। কাফকা এই পতিতালয়ে প্রায় নিয়মিতই আসতেন। তবে গবেষকরা এই ব্যাপারে নিশ্চিত নন যে কাফকা এখানে রতিক্রিয়া কখনো সম্পন্ন করেছেন কিনা। 

সমালোচকরা মনে ধারণা করেন, এখানে কাফকা বারবনিতা, দালাল, দোকানদার এবং অন্য খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলেই সময় পার করতেন। কাফকার লেখার মূলে রয়েছে মানুষ ও মানুষের মননরীতি; যা গড়ে উঠেছিল তার এই শৈশব-যৌবনের প্রিয় শহর প্রাগে। আজকের সারাদুনিয়ার সাহিত্যমোদীরা যে কাফকার জীবন নিয়ে এতটাই উদ্বেলিত, আমরা এর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখি-কাফকা তার জীবনের কাছে বারংবার ফিরে গেছেন, যেখানে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন, স্বীকৃতি পাননি, অধিকার হারিয়েছেন। এজন্যই হয়তো নিজেকেই বানিয়েছেন সব শ্রেণির মানুষের বৃহৎ প্রতিনিধি।

ফ্রানৎস কাফকার ব্যক্তিগত জীবন তার সৃষ্টিগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে, বিভিন্ন উপাদানে ঋদ্ধ করেছে। এ কারণে বিংশ শতকের প্রভাববিস্তারী লেখক কাফকার শহর প্রাগ পাঠক-ভক্তদের নিকট এক বিশেষ কৌতূহল ও আগ্রহের বিষয়। কারণ এ শহরই কাফকাকে বানিয়েছে কাফকার মেটামরফোসিস বা রূপান্তরিত এক বিশেষ চরিত্র।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh