প্রস্তাবিত বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২২, ০৩:০৯ পিএম

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বাদ দিয়ে সরকারি চাকরির প্রতি শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রায় আগ্রহের কারণে ‘বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তাব করেছেন শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তার কথা অনুযায়ী প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, ভাইভা ইত্যাদি নামে বিভাগ থাকবে এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হবেন সরকারের অবসরপ্রাপ্ত আমলা।

তার অভিমত, এই বিশ্ববিদ্যালয় খুব জনপ্রিয় হবে, ভর্তির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা হবে। সরকারি চাকরির প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার কড়া সমালোচনা করে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখন বিসিএস চর্চায় আছি।’ 

আমি সত্তর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, থাকতাম ফজলুল হক হলে। আমার সময় পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত মাস্টার্স করেই বিসিএসের প্রস্তুতি নিত। তবে আমার পাশের রুমের এক সিনিয়র ছাত্রকে অনার্স পরীক্ষা দিয়েই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে দেখেছি, তিনি সাধারণ জ্ঞানের বই নিয়ে বাথরুমেও চলে যেতেন। তার প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল, কিন্তু তার মাস্টার্স পরীক্ষা আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি। ইদানীং নাকি প্রায় সকল ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে। এতে একাডেমিক লেখাপড়ার মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে বলে শিক্ষকদের অভিযোগ। কম মেধাবী কিছু ছাত্র-ছাত্রীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো রেজাল্ট করার সম্ভাবনা খুবই কম, তাদের লক্ষ্য থাকে কোনোভাবে দ্বিতীয় শ্রেণি পেলেই যথেষ্ট। এরা নিজেরা নোট করে না, অন্যের নোট পড়ে পরীক্ষা দেয়,  ক্লাসেও নিয়মিত নয়। বিসিএস পরীক্ষায় অধিক মনোনিবেশ করার কারণে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফল করতে সক্ষম হয় না। কিন্তু তাদের লক্ষ্য যদি বিসিএস হয় তাহলে একাডেমিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পাওয়ার আবশ্যকতা থাকে না। আবার অনেকে বিসিএসের প্রস্তুতি হিসেবে প্রাইভেট পড়িয়ে থাকে। এরা কিন্তু বিসিএস পরীক্ষায় ভালো করে থাকে। 

বিসিএস পরীক্ষার প্রতি আগ্রহ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই চাকরির কিছু ক্যাডারে ক্ষমতা-প্রতিপত্তি-সুযোগ-সুবিধা সব আছে। অধিকাংশ আমলার আচার-আচরণ জমিদার-সুলভ। আমি এক সময় উত্তরবঙ্গের প্রায় প্রতিটি ‘জেলা কৃষি ঋণ কমিটি’র সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিতাম। প্রায় মিটিংয়ে কমিটির সভাপতি ডিসি বা জেলা প্রশাসক দেরি করে সভায় উপস্থিত হতেন। বগুড়া জেলা সমন্বয় কমিটির বৈঠকেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাকে পাঠানো হতো। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক বগুড়ার নির্বাহী প্রধান জেনারেল ম্যানেজার উপস্থিত না থাকায় জেলা প্রশাসক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরের মিটিংয়ে নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট পূর্বে জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ রুহল আমিন আমাকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হন, গিয়ে দেখলেন একজন লোকও নেই।

নির্ধারিত সময় পার হওয়ার আরো পনেরো মিনিট অপেক্ষা করে জেনারেল ম্যানেজার একটি ছোট চিরকুট লিখে রাউন্ড টেবিলে সভাপতির চেয়ারের সম্মুখে চাপা দিয়ে মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে সোজা অফিসে চলে এলেন, আর কখনো তিনি জেলা প্রশাসকের অফিসে যাননি। ঠিক একই কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক মেধাবী কর্মকর্তা মরহুম আল্লাহ মালিক কাজেমী পারতপক্ষে সচিবালয়ের কোনো মিটিংয়ে যোগ দিতেন না। রুহুল আমিন এবং আল্লাহ মালিক কাজেমী দুজনই বাংলাদেশ ব্যাংকে সৎ ও মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কোনো একটি প্রেস কনফারেন্সে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের ভুল তথ্য শুধরিয়ে দেওয়ার কারণে রুহুল আমিনকে চাকরিচ্যুত করতে মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়। গভর্নর ড. ফখরুদ্দিন সমঝোতা করে তার চাকরি রক্ষা করেন, কিন্তু অবসর গ্রহণ পর্যন্ত প্রায় দুই বছর ডেপুটি গভর্নর রুহুল আমিনের অফিসে উপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ ছিল। 

বাংলাদেশ ব্যাংকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর পদে কয়েক বছর চাকরি করার পরও অনেককে ক্যাডার সার্ভিসে চলে যেতে দেখা যায়। এর প্রধান কারণ ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি। আমরা ২২ জন ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর পদে যোগ দিই, তিন বছর চাকরি করার পর কয়েকজন বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার সার্ভিসে চলে যায়, একজন ননক্যাডার সাবরেজিস্ট্রার পদে জয়েন করে। ১০ বছর পর একজনকে রংপুর জেলা প্রশাসকের অফিসে দেখতে পাই, সে ইউএনও।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন লাগছে?’ উত্তর এলো, ‘খুব ভালো।’ কেন ভালো সে বিষয়ে বলতে গিয়ে সে আক্ষেপ করে বলল, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকতে জরুরি প্রয়োজনে একদিন আমি ফোন করতে আমার বিভাগের জিএমের পিএর কাছে গেলাম, পিএ ফোন করতে দেননি, এখন চল তুই স্বচক্ষে দেখবি, রংপুরের যেখানে যাই না কেন, গেলে সবাই দাঁড়িয়ে যাবে, তাদের সেট দিয়ে ফোন করতে চাইলে তারা কৃতার্থ হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগে অনার্স এবং এম ফার্মে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই ড. মুনির উদ্দিন আহমেদ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে জয়েন করে অধ্যাপক হয়ে কয়েক বছর পূর্বে অবসরে যান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গাড়ি, টেলিফোন কিছুই পেতেন না, এমনকি বিভাগের চেয়ারম্যান হওয়ার পূর্বে অফিস কক্ষেও কখনো কোনো টেলিফোন দেখিনি। বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ  মনজুরুল ইসলামও কখনো একজন যুগ্ম সচিবের মতো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়াকে বেশ সম্মানজনক বলে ধরা হলেও এসব বিষয় থেকে পাস করা অনেক শিক্ষার্থী এখন পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন বিসিএস ক্যাডারের পদ। ডাক্তার এবং প্রকৌশলীরা আগে বিসিএস পরীক্ষা দিত তাদের জন্য নির্ধারিত বিশেষায়িত ক্যাডারে। কিন্তু এখন মেধাবী ডাক্তার ও প্রকৌশলীরা জেনারেল ক্যাডারে পরীক্ষা দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, পুলিশ, বিচার, কাস্টমস, আয়কর প্রভৃতি ক্ষেত্রে টিকে যাচ্ছেন, এই সকল বিভাগে কাজ করে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করছেন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হতে হলে পোস্ট-গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন অপরিহার্য; এই ডিগ্রি অর্জনে একজন চিকিৎসককে আরো পাঁচ/ছয় বছর লেখাপড়া এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে পরীক্ষায় পাস করতে হয়, কিন্তু বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে কাউকে পদোন্নতি পেতে এত ঝামেলা পোহাতে হয় না। বাংলাদেশে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি ছাড়া একজন ডাক্তারের কোনো মূল্য নেই। কারণ সবাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই খোঁজে।

একজন শিক্ষার্থীকে চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হিসেবে তৈরি করতে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, সেই চিকিৎসক বা প্রকৌশলী যখন অন্য পেশায় চলে যান, তখন তা রাষ্ট্রের জন্য বিপুল ক্ষতি। বিসিএস পরীক্ষা খুব সহজ নয়, এই পরীক্ষায় মেধাবীরা পরস্পর প্রতিযোগিতা করে থাকেন; তাদের মেধার অবমূল্যায়ন করার অবকাশ নেই, একেবারে অঘা কেউ বিসিএস উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন এমন নজির আমাদের হাতে নেই। ক্ষমতা কমবেশি সব মানুষকে অহঙ্কারী করে তোলে। স্নাতক পাস করার পর বিসিএস পরীক্ষার জন্য উপযোগী করতে বহু কোচিং সেন্টার রয়েছে, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় সেই সব কোচিং সেন্টারের ভদ্রচিত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।


জিয়াউদ্দীন আহমেদ
সাবেক নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh