প্রণব চক্রবর্তী
প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২২, ০২:২৭ পিএম | আপডেট: ১৯ জুন ২০২২, ০২:৩২ পিএম
প্রণব চক্রবর্তী
দার্শনিক টমাস হিল গ্রিনের কথা দিয়ে শুরু করা যাক। রাষ্ট্র ও আইনের প্রতি মানুষের আনুগত্যের কারণ কী? এর উত্তর নানারূপ। যেমন- শক্তির ভয়ে মানুষ রাষ্ট্রকে মেনে নেয়। কারও মতে, আনুগত্য প্রকাশের পেছনে সচেতন মনের ভূমিকা নেই, কেবল অভ্যাসই ক্রিয়াশীল।
উপযোগীবাদীদের ধারণা, এমন মান্যতায় মানুষের আনন্দ বর্ধিত হয়, সে জন্য মানুষ রাষ্ট্র ও আইনকে মানে। গ্রিন রাষ্ট্র ও আইন মানার প্রশ্নে স্পিনোজা, হব্স, লক, রুশোর অভিমতকে ভিত্তিহীন বলে মনে করেন। তার মতে, রাষ্ট্র মানুষের নৈতিক জীবন সৃজনে যতটা অবদান রাখতে পারে বা রাখে, তার ভিত্তিতেই মানুষ রাষ্ট্র ও আইনকে মান্য করে।
গ্রিনের মতে, মানুষের ইচ্ছা ও প্রজ্ঞার সামর্থ্যসমূহ যাতে সে অবাধে ব্যবহার করতে পারে বহিঃশক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজের সম্ভাব্য সন্তোষের মধ্যে ও নৈতিকতার ভিতর থেকে, সেটা সম্ভব করে তোলাই পৌর প্রতিষ্ঠানসমূহের কাজ। রাষ্ট্র এ দায়িত্ব আরো বড় পরিসরে পালন করে। মানুষ প্রজ্ঞা ব্যবহার করে আত্মপূর্ণতা লাভ করতে পারে। সামাজিক সংগঠনসমূহ এবং রাষ্ট্র তাকে এ কাজে সহায়তা দেয়। কিন্তু মানুষের নৈতিকতাবোধ, প্রজ্ঞা ও ইচ্ছাই এ ক্ষেত্রে মূল্যবান।
তাই রাষ্ট্রসহ যাবতীয় সামাজিক সংগঠনের প্রকৃত ভিত্তি হলো নাগরিকগণের নিজস্ব ইচ্ছা, বাইরের কোনো বলপ্রয়োগ নয়। গ্রিনের মতে, নৈতিক জীবনের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক একান্তই সহায়কমূলক, সৃষ্টিমূলক নয় অর্থাৎ মানুষের স্বাধীনতা ও নৈতিক জীবন অর্জনের প্রশ্নে, কল্যাণ হাসিলের বিষয়ে রাষ্ট্র জরুরি এবং তা প্রতিবন্ধকতা অপসারণকারী। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপ এ জন্য দরকার, কিন্তু তা মানুষের ইচ্ছার ভিত্তিতেই।
গ্রিনের কথামালা সাম্প্রতিক একটি ঘটনার ক্ষেত্রে নির্মোহভাবে যাচাই করা যায়। টিকিট ছাড়াই পাবনা থেকে ঢাকামুখী ট্রেনে উঠে এসি কামরায় বসেছিলেন তিন যাত্রী। ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরিদর্শক (টিটিই) এলে রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়েছিলেন তারা। তখন টিটিই বিনা টিকিটে ভ্রমণের জন্য জরিমানাসহ ভাড়া আদায় করেন। পাশাপাশি এসি কামরাও ছাড়তে হয় তাদের। এ ঘটনার পর ওই টিটিইকে মুঠোফোনে বরখাস্ত করার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। তিনি পশ্চিম রেলের সদর দপ্তর ঈশ্বরদীতে সংযুক্ত হন।
এখানেই ঘটনা শেষ হতে পারত। শেষ হতে দেননি সাংবাদিকরা। তারা এমন গুরুত্ব দিয়ে খবরটি পরিবেশন করেছেন যে শাসকদলের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীও অসন্তোষ প্রকাশ করতে ছাড়েননি। তবে রেলমন্ত্রী নিজে একজন আইনজীবী বিধায় দেরিতে হলেও ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে ঘটনার স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং অবশ্যই একটি ভালো কাজ করেছেন। কারণ ভুল স্বীকারে অগৌরবের কিছু নেই। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে টিটিই শফিকুল ইসলাম নির্দোষ সাব্যস্ত হয়ে ইতোমধ্যে কাজে যোগদান করেছেন। এর জন্য রেলমন্ত্রী ধন্যবাদ পেতে পারেন, কারণ ঘটনাটি ঝুলে থাকেনি।
যদিও প্রথমদিকে এই ঘটনার সমালোচনা শুরু হলে, ওই তিন যাত্রীর আত্মীয় হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে গণমাধ্যমের কাছে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করা যাত্রীরা আমার আত্মীয় নয়। ওদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে কেউ হয়তো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ঘটনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শুনেছি ওই টিটিই বিনা টিকিটের যাত্রীদের সাথে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করেছেন। ফলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
অবশ্য পরে পুরো ঘটনা জেনে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘আমার স্ত্রী আমাকে না জানিয়ে যেটা করেছে সেটা ঠিক করেনি।’ মন্ত্রীর বক্তব্যের পর তিন যাত্রীর পরিচয় জানা যায়, তারা রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মি আক্তার মনির আত্মীয়। স্ত্রীর ফোনে রেলের ট্রাভেলিং টিকিট এক্সামিনার (টিটিই) শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের ঘটনায় বিব্রতবোধ করেছেন তিনি।
রেলমন্ত্রী বলেন, ‘ভুলভ্রান্তি হলে মানুষ তো সেভাবেই দেখবে। আমার কোনো ইনভলভমেন্ট এখানে ছিল না। বলা হচ্ছে যে মন্ত্রীর কারণে এমনটা ঘটেছে। আমার যদি কিছু করার থাকত তাহলে তো সরাসরিই করতে পারতাম। কারও সাহায্যের তো দরকার হবে না। মেসেজটা যেভাবে গেছে সেটা সঠিক না।
খুব সাদামাটা একটি ঘটনা, হয়তো উপেক্ষিত হতে পারত। কিন্তু গ্রিনের ভাষায়, নৈতিক জীবনের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক একান্তই সহায়কমূলক, সৃষ্টিমূলক নয় অর্থাৎ মানুষের স্বাধীনতা ও নৈতিক জীবন অর্জনের প্রশ্নে, কল্যাণ হাসিলের বিষয়ে রাষ্ট্র জরুরি এবং তা প্রতিবন্ধকতা অপসারণকারী। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপ এ জন্য দরকার, কিন্তু তা মানুষের ইচ্ছার ভিত্তিতেই। তাহলে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে মানুষ নৈতিকতার চর্চা সব পর্যায়ে হোক এটি দেখতে চান। সম্ভবত এই কারণে ঘটনা নজরদারি ছাড়াও এর ফলে নিয়ম বিরুদ্ধভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কিনা তাও তারা যাচাই করেছেন। এটিই নাগরিক সমাজের ইচ্ছা। এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
পৃথিবীর অনেক দেশেই ক্ষমতাধরদের নিকটাত্মীয়রা বুঝে বা না বুঝে অনেক ধরনের কাজে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন; যা কখনো কখনো দল বা রাজনীতির জন্য নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনে। ‘মিস্টার বা মিসেস পার্সেন্ট’ জাতীয় নামের উদ্ভব এই কারণেই। একজন ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদের জন্য তার স্বামী বা স্ত্রী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার অনুপ্রেরণা ক্ষমতাসীনের জন্য অধিকতর সাফল্য বয়ে আনতে যেমন পারে, তেমনি সমূহ ক্ষতির কারণও হতে পারে।
এ ধরনের উদাহরণ বাংলাদেশে যেমন রয়েছে অন্যান্য দেশেও কম নয়। যেহেতু আলোচ্য প্রসঙ্গটি একটি ইতিবাচক পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে, তাই প্রাসঙ্গিক বাজে উদাহরণগুলো এখানে উল্লেখ করা সঠিক নয় বলে মনে করি।
পরিবারে স্ত্রীর ভূমিকা নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই বলেই তিনি ‘বেটার হাফ’ হিসেবে স্বীকৃত। অতএব কোনো কর্মকাণ্ডে তিনি যেন ‘বিটার হাফ’-এ পরিগণিত না হন এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের মতো দেশে ক্ষমতায় যিনি থাকেন তার কারণে তার স্ত্রী বা স্বামী কিছু বিশেষ সুবিধা সাধারণভাবে পেয়ে থাকেন যা উন্নত দেশে কল্পনাও করা যায় না। এর অতিরিক্ত সুবিধা তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়ম ব্যত্যয়ী যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিড়ম্বনায় ফেলে দিতে পারে। এটি সবার অনুধাবন করা প্রয়োজন।
পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তাদের স্পাউসরা যাতে নিয়মমাফিক আচরণ করেন, এজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের জন্য বিশেষ কোর্সের আয়োজন করে থাকে। পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাব এসব বিষয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিলে অনেক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টিই হবে না।
এই ঘটনা টিটিই তথা সরকারি কর্মচারীদের জন্যও একটি বড় সতর্ক ধ্বনি। গড়পড়তা সরকারি কর্মচারীদের উপর সাধারণ মানুষ আস্থাহীনতা প্রকাশ করলেও তাদের অধিকার রক্ষায় জনতা একাট্টা ছিলেন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমও যোগ্য ভূমিকা পালনে শৈথিল্য দেখায়নি। টিটিই তথা সরকারি কর্মচারীদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করে এই আস্থার জবাব দিতে হবে। তাহলেই সূচিত হতে পারে গণতান্ত্রিক অধিকারের দৃশ্যমান স্রোতোধারা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক