তরুণ প্রজন্ম সাহিত্যের প্রতি কতটা আগ্রহী?

অনন্যা গোস্বামী

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২২, ০২:৪৭ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

“মানুষকে তিনি গল্পে গল্পে ফুটিয়ে তুলতে লাগলেন। পশু-পাখির জীবন হলো আহার-নিদ্রা, সন্তান পালন। মানুষের জীবন হলো গল্প। কত বেদনা, কত ঘটনা! সুখ-দুঃখ, রাগ-বিরাগ, ভালো-মন্দের কত ঘাত-প্রতিঘাত! ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার, একের সঙ্গে দশের, সাধনার সঙ্গে স্বভাবের, কামনার সঙ্গে ঘটনার সংঘাতে কত আবর্তন! নদী যেমন জলস্রোতের ধারা, মানুষ তেমনি গল্পের প্রবাহ। তাই পরস্পরের দেখা হতেই প্রশ্ন, এই ‘কী হলো হে? কী খবর? তার পরে?’ এই ‘তার পর’ এর সঙ্গে ‘তার পর’ বোনা হয়ে পৃথিবীজুড়ে মানুষের গল্প গাঁথা হচ্ছে। তাকেই বলি জীবনের কাহিনি, তাকেই বলি মানুষের ইতিহাস।”

‘লিপিকা’য় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত সহজ করেই না মানুষের ইতিহাসকে গল্পের নামে পরিচয় করালেন জীবনের আরশির সঙ্গে। আর এই গল্পই হলো সাহিত্য। মানুষের ইতিহাস ও অনুভবের বৃত্তান্তকে আঙুলের সুচে কালির বুননে সুতোবন্দি করার শিল্পই হলো সাহিত্য। এ এক জাগতিক যাত্রা যা প্রত্যেক মানুষের প্রাণের অজাগতিক বোধের একমাত্র শরীরী আশ্রয়। তাই সাহিত্য একই সঙ্গে সুপ্রাচীন এবং সুনবীন। সাহিত্য যতটা প্রাগৈতিহাসিক, ততটাই আধুনিকতম। সাহিত্যের অলিগলিতে প্রবীণ জীবনের সাক্ষ্য, আবার সাহিত্যেরই শিরায় শিরায় তরুণ প্রাণের প্রকাশ। সাহিত্য স্বয়ং চিরতরুণ, সাহিত্য আপনি-আপনাতে তারুণ্যের সারথি।

ল্যাটিন Littera শব্দ থেকে আসা literatura/litteratura শব্দের ফরাসি প্রতিশব্দ হলো Letters যার মূল প্রতিপাদ্য হলো অক্ষর। অর্থাৎ সাহিত্যের গোড়াটি নিবদ্ধ রয়েছে অক্ষরের শেকলে। এ সম্পর্কে সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা, ‘সাহিত্য বলতে বোঝায় যথাসম্ভব কোনো লিখিত বিষয়বস্তু। সাহিত্য শিল্পের একটি অংশ বলে বিবেচিত হয়, অথবা এমন কোনো লেখনী, যেখানে শিল্পের বা বুদ্ধিমত্তার আঁচ পাওয়া যায়, অথবা যা বিশেষ কোনো প্রকারে সাধারণ লেখনী থেকে আলাদা। মোটকথা, ইন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক বা মহাজাগতিক চিন্তা চেতনা, অনুভূতি, সৌন্দর্য ও শিল্পের লিখিত বা লেখকের বাস্তব জীবনের অনুভূতি হচ্ছে সাহিত্য।’

অল্প কথায় বললে, সাহিত্য হলো অক্ষরের রূপে অনুভূতির শৈল্পিক প্রকাশ। হতে পারে তা গদ্যে, পদ্যে, সংগীতে, পত্রে বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে। দুটো শব্দ বা সহস্রাধিক অক্ষর অর্থাৎ দৈর্ঘ্য তথা শব্দের বিস্তৃতি যেমনই হোক না কেন, সাহিত্যের নেই কোনো বয়োসীমা, কোনো ভৌগোলিক পরিধি। শিশুদের জন্য সাহিত্য হলো আবিষ্কার, তরুণের জন্য প্রেম, বয়সকালে আবার নির্ভার করতল। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সাহিত্যিকের বয়স বেড়েছে, বদলেছে স্থান ও কাল; কিন্তু বদলায়নি সাহিত্যের স্বাদ ও রূপ। সাহিত্য যুগে যুগে কালে কালে তৃপ্তি জুগিয়েছে মানুষের মনে ও মননে, জুটিয়েছে ভাবনার রসদ ও খোরাক।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সমাজে, বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতে সাহিত্যে উদ্ভব, বিকাশ, বিবর্তন ও পরিণতি এসেছে নানান ধাপে, নানান প্রক্রিয়ায়। বিবিধ সময়বণ্টনে সাহিত্যের মর্মকথা ও তার প্রতি মানুষের সাড়া প্রদানের ক্রমযাত্রাও বিচিত্র। একসময় যে সাহিত্য ছিল কেবলই মনের ভাব, ঘটনাবলি ও নানাবিধ নির্দেশনা লিপিবদ্ধ করার উপায়, ধীরে ধীরে সেই সাহিত্যই আরাধনা, শিল্প ও সৃষ্টির গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছে মানুষের অন্যতম বিনোদন, সঙ্গ ও আসঙ্গ। প্রয়োজন যেটাই হোক না কেন, সব মিলিয়ে মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবেই সাহিত্যের আবেদন স্বীকৃত হয়ে এসেছে এতকাল। 

তবে অতি আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে সাহিত্য তার আবেদন দ্বারা যান্ত্রিক ও বহুবিধ বিনোদনমাধ্যম, তথ্যের প্রাচুর্যপূর্ণ চিন্তার সমারোহ এবং নানামুখী যাপনের ঘনঘটায় মানুষকে, বিশেষ করে বর্তমানের নবীন ও তরুণ সদস্যদের জীবনে ও ভাবনার ভুবনে কতটুকু স্থান অধিকার করে আছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ উপলব্ধির বিষয় বটে।

আনেকেরই প্রশ্ন ও শঙ্কা, এখনকার তরুণেরা কি সাহিত্যবিমুখ? একসময়ের সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে গণ্য সাহিত্যগ্রন্থসমূহ তো এখন আর শোভা পায় না তরুণদের হাতে হাতে। বরং সেই স্থান দখল করেছে মুঠোফোনসহ হরেক রকম বৈদ্যুতিক প্রযুক্তিগত যন্ত্র। তাদের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে আছে কত না শিল্পমাধ্যম। ঘরে ঘরে তরুণদের পূর্বপ্রজন্মের সদস্যরা যদিও বই পড়া, গ্রন্থাগারে যাওয়া, নিত্যনতুন বা পুরাতন কাব্য, উপন্যাস, গল্প অথবা প্রবন্ধের পুস্তকে মনোনিবেশ করতে সচেষ্ট, তবে তরুণেরা কি সে পথে হাঁটছে নিতান্তই কদাচিৎ? যতটা বিনোদনের জোগান তারা পায় ক্রীড়ায়োজন থেকে, যতখানি মনোযোগ কাড়ে রোজকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা নৃত্য-গীতের উপাদান, ততটা আগ্রহ কি তারা অনুভব করে সাহিত্যের জগতের প্রতি? মুঠোর ভেতর রাখা চতুষ্কোণ পর্দার ভেতরও কি আঁকড়ে রাখা হয় গল্প-উপন্যাসের শরীর?

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়স্তরের শিক্ষার্থীদের মতামত, কিছু জরিপ ও তাদের ভার্চুয়াল আচরণবিধি (গুগল সার্চ, ফেসবুক গ্রুপ, ই-বুক রিডিং) লক্ষ করলে অবশ্য বোঝা যায়, সাহিত্য আজও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে তরুণদের কাছেও। কেবল পাঠ করা নয়, নিজেদের সৃষ্টির বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবেও তরুণ সমাজ দ্বারস্থ হয়ে থাকে সাহিত্যের। যদিও তাদের আগ্রহের বিষয় মূলত ক্ল্যাসিক তথা ধ্রুপদী সাহিত্য। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্র, নজরুল, সুকান্ত, রোকেয়া, তারাশঙ্কর, মানিক, শরৎ প্রমুখ সাহিত্যিকের রচনার অনুসন্ধানের হদিস পাওয়া যায় এখনো। অবাংলায় এখনো সতেজ আছে শেকস্পিয়ার, তলস্তয় কিংবা গোর্কির নাম। হালের সাহিত্যে সে অর্থে আবেগের টান কম মিলছে তরুণদের পক্ষ থেকে।

এমনকি শক্তি, বিনয় বা বুদ্ধদেবও আছেন বুদ্ধিজীবী গোত্রের লেখক-পাঠকদের গ্রন্থাগারেই সংরক্ষিত। কেননা সাহিত্য সময়ের সঙ্গে বদল করেছে তার ধারা ও অবকাঠামো। সাহিত্য আর আগের মতো সহজ, সরল, সাবলীল এবং কেবলই উপলব্ধির ধারক হিসেবে আবদ্ধ নেই। প্রহসনের সাহিত্য রূপ নিয়েছে অ্যাবসার্ট লিটারেচারে। রূপকথা, পৌরাণিক গল্প ও কল্পনার কাব্যিক কথামালা হয়ে উঠেছে জাদুবাস্তবতা। প্রচণ্ড স্পষ্ট ও জটিলতাহীন হাংরি জেনারেশনের তীব্র শব্দাবলির পথ পেরিয়ে আজকের সাহিত্য পাচ্ছে অ্যাবস্ট্রাক্ট ফরম্যাট। উপরন্তু রয়েছে সুনীল, সমরেশ, ফাল্গুনী, হুমায়ূন আহমেদ, সেলিনা হোসেন প্রমুখের বাজারচলতি গল্প-উপন্যাস বা আজকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর বিভিন্ন সংঘে প্রচলিত কাব্য ও কথামালা আদৌ সাহিত্য কিনা, সেই বিতর্ক। এই বিবর্তন ও রূপবদলে বর্তমান সাধারণ তরুণসমাজ খানিকটা দিকভ্রান্ত তো বটেই।

বাংলা একাডেমিতে তরুণ লেখক প্রকল্পের সেমিনার-ক্লাসে প্রয়াত কবি খোন্দকার আশরাফ এই বলে আক্ষেপ করেছিলেন যে, ‘বর্তমানের সাহিত্যে শব্দ নিয়ে খেলা হয় নিঃসন্দেহে। ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ব্যাকরণে নতুন শব্দবন্ধ, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প ও দর্শনের জন্ম হচ্ছে ঠিকই, তবে শব্দগুলো যেন পিলারের মতো নিজেদের জায়গায় একা একা দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো অনুরণনের সুতায় শব্দসমূহের মালাটা আর গ্রন্থিত হয়ে ওঠে না। তাই সাধারণ তরুণ পাঠকের কণ্ঠে শোভাবর্ধনের সৌভাগ্যবঞ্চিত হয় আজকের সাহিত্য।’ আজকের অধিকাংশ তরুণ পাঠকেরও বর্তমানের সাহিত্য নিয়ে এটাই আক্ষেপ যে সেগুলো দুর্বোধ্য বা বোঝা গেলেও মগজের কোষগুলোয় রেখে যায় না কোনো রেশ। এর সামান্য উদাহরণ পাওয়া যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কর্মরত তরুণ আবৃত্তিশিল্পী আহমেদ মাসুমের লেখায়, ‘বর্তমান যুগের কবিদের কবিতা নারীর মতোই দুর্বোধ্য লাগে। যতই পড়ি না কেন, বুঝি না কিচ্ছুটি।’

ভিন্ন দৃশ্যও দেখা যায় অতি-অহরহ। বাংলাদেশে ঢাকা শহরকেন্দ্রিক এবং বিভিন্ন জেলা শহরেও তরুণ লেখক-সাহিত্যিকদের ঘনঘটা উপেক্ষা করার মতো নয় মোটেই। চল্লিশের কল্লোল সাহিত্য, সত্তর ও আশির নতুন সমাজ আবাহনের সাহিত্য বা নব্বইয়ের রাজনৈতিক সাহিত্য নতুন রূপে নতুন সব তরুণ মুখের আদলে ঘোরাফেরা করে আমাদেরই শহরতলিগুলোতে। বিকেলের আড্ডাগুলোয় তরুণ সাহিত্যিকেরা পাঠচক্রে মগ্ন না হলেও পাঠালোচনায় উদ্যোগী হতে ভোলেন না। তাদের অভ্যন্তরীণ সাহিত্য-কোন্দলও চোখে পড়ার মতো। তবু এই সাহিত্যযাপনের নিমগ্নতায় সময় কাটে বেশ এখনকার তরুণ সমাজেরও।

সাধারণ তরুণ পাঠক সমাজ সাহিত্যানুরাগী না হলেও সাহিত্যবিমুখ তাদের বলা চলে না মোটেই। সময়ের তোড়ে উৎসাহের স্রোতে ভাটা পড়তেই পারে, তবে শব্দপ্রেমের প্রবাহ মোটেই থমকে দাঁড়ায়নি আজকের তরুণ সমাজের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের পারদে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh