আসিমের যুদ্ধবিমান

নাবীল অনুসূর্য

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২২, ০২:৫৬ পিএম

আসিম রহমান

আসিম রহমান

আসিম রহমানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার ধানমন্ডিতে। শৈশব-কৈশোরের দুরন্ত দিনগুলো মূলত মা নারমিন রহমানের সঙ্গেই কেটেছে। খুব একটা কাছে পাননি বাবা ইকবাল রহমানকে। তিনি ছিলেন পেশায় মেরিন মাস্টার। সবাই যাকে বলে জাহাজের ক্যাপ্টেন।

তাই বেশিরভাগ সময় থাকতেন জাহাজে জাহাজে। সাগরে, বিদেশ বিভূঁইয়ে। স্ত্রী-সন্তান থেকে দূরে। বাবার মতো ছেলেরও ছিল ‘জাহাজ’ নিয়ে আগ্রহ। তবে বাবার মতো সাগরের জলে ভেসে বেড়ানো জাহাজের প্রতি নয়। তার সব আকর্ষণ ছিল আকাশের বুকে উড়ে বেড়ানো উড়োজাহাজ নিয়ে। বিমান কীভাবে ওড়ে, এই বিস্ময়ের কোনো কূল-কিনারা করতে পারত না ছোট্ট আসিম। শেষ পর্যন্ত বাবাই তার ব্যবস্থা করেন।

তখন আসিমের বয়স সবে ১২ বছর। বাবার সঙ্গে যাচ্ছিলেন জেদ্দায়। সে উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে চড়েছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটা ফ্লাইটে। উড়োজাহাজ নিয়ে ছেলের আগ্রহের কথা ভালোভাবেই মাথায় ছিল ইকবাল রহমানের। তাই কথা বলেন একজন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টের সঙ্গে। ছোট্ট ছেলেটার আগ্রহের কথা শুনে রাজি হয়ে যান পাইলট। মাত্র ১২ বছর বয়সেই বিমানের ককপিটে ঢুকে পড়েন আসিম। সেটা ছিল একটা বোয়িং-৭৭৭ বিমান। অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলেন ককপিটের সবকিছু। সে দিন বিমান নিয়ে আগ্রহ বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল তার। তারপর একদিন ঠিকই বিমান ওড়ার রহস্যভেদ করতে পড়া শুরু করেন অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। মাঝে অবশ্য পাড়ি দিতে হয়েছে অনেকটা পথ। ১৯৯৫ সালে ভর্তি হন সানবিমস স্কুলে। সেখান থেকে এ লেভেল পাস করেন ২০১০ সালে। তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। জর্জিয়া প্রদেশের আটলান্টা শহরে।

ওদিকে যত দিন গেছে, বিমানের প্রতি তার ভালোবাসাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। আর তাই স্নাতকের বিষয় বেছে নিতে কোনো দ্বিধা করেননি। ২০১১ সালে ভর্তি হন অ্যারোস্পেস, অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। একে তো পছন্দের বিষয়। তার উপর ক্যারিয়ার গড়ার জন্যও এটা দুর্দান্ত বিষয় ছিল তার জন্য। ভর্তি হন জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। সারাবিশ্বে এটি পরিচিত জর্জিয়া টেক নামে। আসিমের পছন্দের বিষয়ে পড়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এটি। অন্যান্য বিষয়ের মতো অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে স্নাতক পড়তে ৪ বছর লাগে। যথাসময়ে তা শেষ করেন আসিম। তারপর নামেন ক্যারিয়ার গড়তে। চাকরির যুদ্ধে। অবশ্য সংগ্রাম তেমন একটা করতে হয়নি তাকে।

২০১৫ সালে স্নাতক শেষ করেন। সে বছরের ডিসেম্বরেই যোগ দেন সফটওয়্যার কোম্পানি প্রফিটসোর্ডে। সফটওয়্যার সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে; কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল অন্য। বিমান, মহাকাশযান ও স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ করা। একজন আদর্শ অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার যেমনটা করে থাকেন। এগুলোর নকশা প্রণয়ন, প্রোটোটাইপ বানানো, সেগুলোর উপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন, সেসব প্রযুক্তি সত্যিকারের মডেলে প্রয়োগ করা, নির্মাণ প্রক্রিয়া তদারক করা ইত্যাদি। সোজা  কথায়, বিমান-মহাকাশযান উড্ডয়ন থেকে শুরু করে আকাশ সীমার নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা।

সে জন্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি আসিমকে। বছর তিনেক পরেই আসে সুযোগ। লকহিড মার্টিনে যোগ দেওয়ার। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বাণিজ্যিক নগর ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি কোম্পানি। কাজ করে মহাকাশযান, যুদ্ধবিমান, আগ্নেয়াস্ত্র, নিরাপত্তা ইত্যাদি প্রযুক্তি পণ্য নিয়ে। এসবের দিক দিয়ে এটা পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে এসব প্রযুক্তি পণ্যের অন্যতম শীর্ষ জোগানদাতা তারা। নিজেদের বাৎসরিক বিক্রির অর্ধেকই করে মার্কিন নিরাপত্তা বিভাগের কাছে। পাশাপাশি দেশটির আণবিক শক্তি বিভাগ ও নাসার সঙ্গেও কাজ করে নিয়মিত। বিশেষ করে তাদের যুদ্ধবিমান খুবই বিখ্যাত। আসিমের জন্য এটা ছিল তার স্বপ্নপূরণের প্রথম পদক্ষেপ। কারণ বিমানের মধ্যে ফাইটার জেটের প্রতিই তার আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। আর লকহিড মার্টিনের জেটগুলো রীতিমতো ভুবন বিখ্যাত। কাজেই সেখানে যোগ দিতে দুইবার ভাবেননি আসিম। খুশি মনে রাজি হয়ে যান। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে যোগ দেন প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে।

তবে তখনো বাকি ছিল তার স্বপ্নটাকে ছোঁয়ার। মাস চারেক বাদেই সেটাও পূরণ করে ফেলেন। ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যুক্ত হন কোম্পানিটির এফ-৩৫ প্রোগ্রামে। যে প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে নির্মিত হচ্ছে লকহিড মার্টিন এফ-৩৫ লাইটনিং ২। বিশ্বের সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমানগুলোর অন্যতম। চালানো যায় যে কোনো ধরনের আবহাওয়ায়। যুদ্ধ বিমানটিতে বন্দোবস্ত আছে সম্ভাব্য সব ধরনের বিপদ মোকাবেলা করার। আক্রমণ, প্রতিরক্ষা বা যোগাযোগ-কম যায় না কোনো ক্ষেত্রেই। ব্যবহার করা হয়েছে প্র্যাট অ্যান্ড হুইটনি এফ-১৩৫। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ফাইটার ইঞ্জিন। বর্তমানে লং রেঞ্জের সুপারসনিক এই যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে মার্কিন ও অস্ট্রেলিয়ার বিমানবাহিনী। আরও ব্যবহার করছে মার্কিন নেভি ও মেরিন কোর। আসিম নকশা করেছেন এটির নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রাংশের।

অবশ্য এখানেই থেমে থাকতে চান না আসিম। চাকরির পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন উচ্চতর পড়াশোনা। স্নাতকোত্তর করছেন জর্জিয়া টেকে। বিষয় লিডারশিপ ইন ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিং। আপাতত মনোযোগ সেখানেই। দুই বছরের মধ্যে সেটা শেষ করতে চান। যেন লকহিড মার্টিনের আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে পারেন কাঁধে। সেখানেও অবশ্য দায়িত্বের ভার বেড়েছে। গত ডিসেম্বরে হয়েছেন সিনিয়র ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ার। লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হলে আসিমের কাঁধে সে ভার যে সামনে আরও বাড়বে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh