পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে ছুটে চলা সাজেক ভ্যালি

ফারজানা রহমান

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২২, ১২:৪৩ পিএম

সাজেক ভ্যালি। ছবি- সংগৃহীত

সাজেক ভ্যালি। ছবি- সংগৃহীত

রাঙামাটির ছাদ বলে পরিচিত ১৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত সাজেক ভ্যালি। রুইলুই (১৭২০ ফুট উচ্চতায়) ও কংলাক পাড়া (১৮০০ ফুট উচ্চতায়) কেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে এই উপত্যকা।

রাঙামাটি জেলার সবচেয়ে উত্তরের বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত ত্রিপুরা, লুসাই আর অল্প কিছু চাকমা ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের বসবাস এই সাজেক ভ্যালিতে। এখানকার অধিবাসীদের প্রধান ভাষা ত্রিপুরা। তবে এরা পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলেন বাংলা ভাষায়। এরা খুবই পরিশ্রমী। এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা পর্যটনকে কেন্দ্র করে। সাজেক ভ্যালিকে অনেকেই বলে থাকে মেঘের রাজ্য। একটু দূরে ভারতের মিজোরাম রাজ্য। অনেক রাতে সেখানকার আলো দেখে এ দেশ থেকেও স্বপ্ন বুনতে এখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ছেলে-মেয়েদের পড়তে পাঠিয়ে দেয় মিজোরামে। সাজেক ভ্যালিতে পানির জোগান আসে সমতল থেকে। তাই বৃষ্টি এখানে আরাধ্য। বৃষ্টির পর যখন রিসোর্টগুলো মেঘে ঢেকে ফেলে, তা সত্যি এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা করে! মনে হবে আপনি যেন মেঘের রাজ্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন। 

শহরের একঘেয়েমি জীবন থেকে নিস্তার পেতে কিছুটা সময় এই মেঘের দেশে বেড়িয়ে আসতে পারেন। শহরের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একান্ত কিছুটা সময় কাটাতে চাইলে স্বপ্নের মতো রঙ-বেরঙের কটেজগুলোর বারান্দায় বসে প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে উপভোগ করতে পারবেন মুগ্ধ করা সকাল, বিকেল ও সন্ধ্যা। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার পাহাড়ে ঘটে রঙ বদলের খেলা। সঙ্গীকে নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে যান কংলাক পাড়াতে। মূলত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের জীবনযাত্রা দেখার সুযোগ এখানেই। যারা নিরিবিলি থাকতে চান, তারা সাজেক জিরো পয়েন্ট থেকে একটু এগিয়ে যে কোনো কটেজ বেছে নিতে পারেন। প্রাকৃতিক পরিবেশে নিরিবিলি সময় কাটাতে এই কটেজগুলোর বিকল্প নেই। 

সমতল থেকে ঢাল বেয়ে উপরে উঠে প্রথমে রুইলুই পাড়া। তারপর সাজেক রিসোর্ট চোখে পড়বে, গোল আকৃতির বলে স্থানীয়রা একে গোল ঘর বলে থাকেন। অধিকাংশ কটেজ রুইলুই পাড়াতে গড়ে উঠেছে বলে খাবার হোটেলগুলো এই এলাকায় অবস্থিত। খাবারের জন্য আপনাকে এ সব হোটেলের উপর নির্ভর করতে হবে। খাবারের দাম আপনার আয়ত্তের মধ্যে থাকবে। তবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের খাবার, বিশেষ করে বেম্বো চিকেন (বাঁশের মধ্যে মুরগি রান্না), কচি বাঁশের বিভিন্ন পদ চাইলে আগে থেকে বলে রাখতে হবে। রাতের জন্য এখানে প্রায় সব হোটেলে বারবিউকিউয়ের ব্যবস্থা আছে। 

সাজেকের সকাল দেখতে চাইলে আপনাকে ঘুম কাতুরে হলে চলবে না। কটেজের বারান্দায় বসেই দেখতে পারেন সকালের পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য। তবে ঝুলন্ত বারান্দা পেয়ে গেলে তার মজাই আলাদা। প্রায় প্রত্যেক কটেজের এই দৃশ্য সম্পূর্ণ রুমগুলোর চাহিদা পর্যটকদের কাছে সব সময় বেশি থাকে। তাই এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে একটু আগেভাগেই পরিকল্পনা করে নেওয়া ভালো। 

তাছাড়া রুইলুই পাড়া থেকে একটু নেমে আসলে চোখে পড়বে লুসাই গ্রাম। দেখে নিতে পারেন লুসাই ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের জীবনযাত্রার কিছু ছবি। তার জন্য আপনাকে ব্যয় করতে হবে মাত্র ত্রিশ টাকা। সামনে পড়বে হেলিপ্যাড। এই হেলিপ্যাডে এসে আপনি পেয়ে যাবেন সাজেক জিরো পয়েন্ট। এর কাছ ঘেঁষে নেমে গেছে ঝাড়ভোজ নামে একটি ছোট পর্যটক কেন্দ্র। চাইলে ছোট ছোট ছাউনিতে বসে প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে আড্ডা দিতে পারেন। আর দোলনায় দোল খেতে খেতে দূরে মিজোরামের পাহাড় দেখতে দেখতে সব অবসাদ দূর করে কিছুটা সময় উপভোগ করতে পারবেন। এই এলাকায় বাঁশের ছোট ছোট পাত্রে নানা রকমের চা পাওয়া যায়। সাজেকে গেলে অবশ্যই এটা খেতে ভুলবেন না কিন্তু।

রুইলুই পাড়াতে পা দেওয়ার পর সামনে পড়বে কৃত্রিম পাহাড় আর ব্রিজ দিয়ে তৈরি একটা পর্যটন কেন্দ্র। সেনাবাহিনী এটা দেখাশোনা করে। এখানকার দোলনাগুলো পাহাড়ের ঢালে বসানো। তাই দোল খেতে খেতে খুব সহজেই আপনি উপভোগ করতে পারবেন দূরের পাহাড়ের সৌন্দর্য।

সাজেক রাঙামাটি জেলায় হলেও যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। প্রায় ৫৪ কিলোমিটার দূরে হলেও পথে বাঘাইছড়ি রেজিমেন্টের এসকর্ট নিয়ে যেতে হয়। দিনে দুবার সকাল দশটায় এবং দুপুর তিনটায় এই এসকর্ট পাওয়া যায়। তাই চাইলেই আপনি যখন তখন সাজেকে ঢুকতে পারবেন না। পাহাড়ি পথে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই ব্যবস্থা। পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে ছুটে চলা এই পথে প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারি।

ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি যাওয়ার অনেক বাস আছে কলাবাগান অথবা আরামবাগ থেকে। রাতের বাসে গেলে ভোরবেলা নেমে যাবেন শাপলা চত্বরে। খুব সহজেই পেয়ে যাবেন চাঁদের গাড়ি নামে পাহাড়ি পথে চলা বারো অথবা দশ জনের জিপ গাড়ি। যাওয়া-আসা চুক্তিতে এরা ভাড়া খাটে। সিএনজি নিয়েও যেতে পারেন। 

সাজেক ভ্যালিতে যেতে চাইলে আপনি পাবেন বিভিন্ন ট্যুর গ্রুপকে। এরা বিভিন্ন সময় প্যাকেজ ট্যুর পরিকল্পনা করে। বাজেটের মধ্যে এই ট্যুর গ্রুপ অথবা দশ/বারো জন মিলে ছোট দলে বেরিয়ে পড়তে পারেন সাজেক ভ্যালির উদ্দেশে। মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতে কাটিয়ে দিলেন দুটো দিন। আর এই ভালোলাগার অনুভূতি অনেক দিন আপনাকে ভরিয়ে রাখবে আগামীর পথচলায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh