করপোরেট খপ্পরে চালের বাজার, মুক্ত করতে দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত

আসাদ জোবায়ের

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২২, ০২:০৯ পিএম

এ কে এম খোরশেদ আলম
সভাপতি, বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন

এ কে এম খোরশেদ আলম সভাপতি, বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন

দেশে বোরো ধান কাটা হয়েছে কয়েক সপ্তাহ আগেই। চালের ভরা মৌসুম বলা যায় এ সময়কেই। তবু চালের বাজার অস্থির। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে সব ধরনের চালের দাম। চিকন চাল অতিক্রম করেছে ৭৫ টাকা।  কৃষক যে দামে ধান বিক্রি করছেন, তাতে এই চালের দাম ৬০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় বলে মনে করছেন বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম। তাহলে কেন এই মূল্যবৃদ্ধি? সম্প্রতি এসব বিষয় নিয়েই সাম্প্রতিক  দেশকালের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসাদ জোবায়ের।

এই ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে কেন?

এই প্রশ্ন আমারও, কেন এখন চালের দাম বাড়বে? এখন যে ধানের দাম তাতে কোনো অবস্থাতেই চিকন চাল ৬০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। আসলে এই বাজার আর আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্যম মানের ব্যবসায়ীদের হাতে নেই। এর পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করছে এখন বড় চার-পাঁচটি করপোরেট গ্রুপ। তাদের নাম সবাই জানে। তারা চাইলেই চালের দাম বাড়ে, আবার সরকার চাপ দিলে তারা ঘোষণা দিয়েই কমায়। ১০ টাকা দাম বাড়ানোর পর ২ টাকা কমানো হয়। মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় এটা কেন হবে? বাজার চলবে চাহিদা ও জোগানের উপর ভিত্তি করে; কিন্তু তা হচ্ছে না, গুটিকয়েক মানুষের খেয়াল-খুশিতে বাজার জিম্মি হয়ে পড়েছে। 

কিন্তু আপনি তো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। আপনাদের নিয়ন্ত্রণ কোথায়?

একটি পণ্যের জন্য একটিই অ্যাসোসিয়েশন থাকার কথা। আমাদের অ্যাসোসিয়েশন আগে থেকেই আছে। সেখানে ‘রাইস’ শব্দটি পরিষ্কার লেখা আছে; কিন্তু বড় কয়েকজন ব্যবসায়ী নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে ‘বাংলাদেশ অটো, মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতি’ নামে আরেকটি অ্যাসোসিয়েশনের নিবন্ধন নিয়েছে। এই সমিতির নামের মধ্যে ‘রাইস’ শব্দটি নেই; কিন্তু তারাই সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে, দাম নির্ধারণ করে। সরকার সরাসরি কোনো সংগঠনকে ডাকে না, বড় কয়েকজন ব্যবসায়ীকে ডাকেন। এটা খুব খারাপ প্র্যাক্টিস। এর ফলে সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমরা মূল্য নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারি না। আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বারবার চিঠি দিয়েছি, চাল উৎপাদকদের একটি সংগঠনের অধীনে আনা বাধ্যতামূলক করা হোক; কিন্তু সে দিকে সরকারের কোনো মনোযোগ নেই। তারা বসে বৈঠক করেন ব্যক্তির সঙ্গে, সংগঠনের সঙ্গে নয়। তাহলে বাজার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে?

চালের বাজারে একসময় চাষিরাই চাল বিক্রি করত। এরপর এলো চাতাল কল। এখন তা চলে গেছে করপোরেটের নিয়ন্ত্রণে। এর পেছনের ইতিহাস যদি বলতেন।

একটা সময় ধান কাটা-মাড়াই শেষে চাল করতে গিয়ে চাষি অনেক কষ্ট করতেন। সেই তুলনায় হাট-বাজারে গিয়ে দাম পেত না। এরপর অটো রাইস মিলের বিকাশ ঘটে ২০১০ সালের কাছাকাছি সময়ে। ফলে চাষিরা ধান কেটে এনেই মিলে দিয়ে দিতে পারে, বৃষ্টি-বাদল নিয়ে তাদের চিন্তা করতে হয় না। দামও তারা ভালো পায়। ওই সময়ে সারা দেশে অন্তত দেড় হাজার অটো রাইস মিল প্রতিষ্ঠা হয়। বাজারে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল। ফলে দীর্ঘদিন বাজার স্থিতিশীল ছিল। ২০১৫ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে এখানে করপোরেট নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। একের পর এক  ছোট ও মাঝারি অটো রাইস মিল হয় বন্ধ হয়ে যায়, নয়তো বড় মিলারদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। ফলে বাজার থেকে প্রতিযোগিতা উঠে যায়। ৫-৬টি বৃহৎ ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। তাদের খেয়াল-খুশিতে দাম বাড়ে-কমে। 

ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা কেন হাত গুটিয়ে নিল?

এটির জন্য একমাত্র দায়ী ব্যাংক ব্যবস্থা। এদেশে ব্যাংকগুলোর চরিত্রই হলো তেলা মাথায় তেল দেওয়া। বড় বড় করপোরেট গ্রুপগুলোতে তারা হাজার কোটি টাকা দিতে কার্পণ্য করে না। ঋণ রিশিডিউল করে দেয় বারবার, নানান অজুহাতে সুদ মওকুফও তারা করে দেয়। অন্যদিকে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের এক কোটি টাকার জন্য জেলে ঢুকানো হয়। এই নীতির ফলেই আজ চাতাল মিল মালিকরা পথে বসেছেন। ধান কেনার জন্য আমরা ব্যাংকে গিয়ে জুতা ক্ষয় করেও আমাদের গুদামের সক্ষমতার অর্ধেক ধান কেনার জন্য ৫০ লাখ, এক কোটি টাকা ঋণ পাই না। অন্যদিকে করপোরেট গ্রুপকে হাজার হাজার কোটি টাকা দেয় ধান কেনার জন্য। তাহলে আমরা কীভাবে মিল চালাব? বাধ্য হয়ে মিলাররা মিল ভাড়া দিয়ে দিচ্ছে বড় মিলারদের কাছে। 

সরকার অভিযানে নেমেছে, এতে কি অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে করেন?

আগুন লাগার উৎস যেখানে, পানিও ঢালতে হবে সেখানে। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া আগুনে পানি ঢেলে লাভ আছে? বড় মিলাররা দুই বছরের জন্য ধান মজুদ করেছে। আপনি কারওয়ান বাজারে চালের দোকানে অভিযান চালিয়ে কী করবেন? তারা কি চালের দাম ঠিক করে নাকি? এ সব আইওয়াশ অভিযানের কোনো মানে হয় না। ধরতে হবে রাঘববোয়ালদের। স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন; কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তার মানে কি তারা সরকারের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গেছেন? এদের নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে দেশে দুর্ভিক্ষ বাধিয়ে ছাড়বেন তারা। 

চাল আমদানির কথা ভাবছে সরকার। এতে কি দাম কমে আসবে বলে মনে করেন?

এই যে সরকার চাল আমদানির কথা বলছে, এখানেও ম্যানুপুলেশন আছে। এই বড় ব্যবসায়ীরা আগেই ভারতে গিয়ে চাল কিনে রেখেছে। এখন তারা দেশে চালের দাম বাড়িয়ে আমদানির পরিবেশ তৈরি করেছে। এখন সরকার অনুমতি দিলে তারা নিয়ে আসবে। সাধারণ চাল ব্যবসায়ীরা কিন্তু ভারতে গিয়ে চাল পাবে না। গত বছরগুলোতে আমি নিজে গিয়ে চাল কিনতে পারিনি। এবারও এটাই হবে। এদের আমদানি করার সুযোগ না দিয়ে প্রকৃত ও সাধারণ মিল মালিকদের সুযোগ দিলে ভোক্তারা উপকৃত হতো। যারা দেশে দাম বাড়াচ্ছে, তারাই যদি চাল আমদানি করে, তাহলে লাভ কী হবে? বাজারের চাবি তো তাদের হাতে।

চাল প্যাকেটে করে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এটাকে কীভাবে দেখছেন?

এটিকে আমি সমর্থন করি না। কারণ একটা প্যাকেটের মূল্য ২ থেকে ৩ টাকার বেশি হবে না; কিন্তু দাম বাড়ানো হয় ৫ থেকে ১০ টাকা। এটা তো অনৈতিক। আমি মনে করি, চালের আবার ব্র্যান্ড কী? চাল বস্তায় করে দোকানে যাবে, মানুষ দেখে-শুনে কিনবেন। 

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কি করণীয় আছে বলে আপনি মনে করেন? 

বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার দরকার নেই। বাজার এমনিতেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। প্রথমত অসাধু মজুদদারদের খুঁজে বের করতে হবে, শুধু চুনোপুঁটি ধরে আইওয়াশ করার দরকার নেই। দ্বিতীয়ত মাঝারি মিল মালিকদের ব্যবসায় ফিরিয়ে এনে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ঋণখেলাপি থেকে মুক্তি দিতে হবে। লোন রিশিডিউল করে নতুন করে ব্যবসার সুযোগ দিতে হবে। পর্যাপ্ত ধান কেনার জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ দিতে হবে। হাজারো প্রতিযোগী ব্যবসায়ী যখন বাজারে চাল সরবরাহ শুরু করবে, দাম এমনিতেই কমা শুরু হবে। উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক রীতি। এ জন্য দরকার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কঠোরভাবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। আমলারা বসে বসে মিটিং করে এটা করতে পারবে না। কারণ এই মজুদদারদের ক্ষমতা তাদের চেয়ে অনেক বেশি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh