খাদ্য সংকটেও যুদ্ধাস্ত্রের ঝনঝনানি

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২২, ১০:১১ এএম

সামরিক ব্যয় বৃদ্ধিই প্রাধান্য পায় ন্যাটো সম্মেলনে। ছবি: এপি

সামরিক ব্যয় বৃদ্ধিই প্রাধান্য পায় ন্যাটো সম্মেলনে। ছবি: এপি

করোনাভাইরাস মহামারিতে লকডাউনের সময় বৈশ্বিক অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। উৎপাদন কম হওয়ায় বেড়েছে দৈনন্দিন ভোগ্যপণ্যের দাম। এবার এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে খাদ্যপণ্যের রেকর্ড পরিমাণ দাম বৃদ্ধি। খরা ও যুদ্ধের কারণে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি আগেই সতর্ক করেছে- খাদ্যের দাম বৃদ্ধি বিশ্বের দরিদ্র মানুষের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবে এতে থেমে নেই সামরিক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, যা বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করছে। ভবিষ্যৎ যেখানে যুদ্ধ আর ক্ষুধায় আবদ্ধ।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়া এবং খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিশ্বে শস্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সম্ভাবনা আছে। এ কারণে বছরের পর বছর ধরে খাবারের উচ্চমূল্য বিরাজমান থাকার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। উত্তর আমেরিকা বিশ্বের মধ্যে বাণিজ্যিক শস্য চাষের বড় ক্ষেত্র। সবচেয়ে বড় কৃষি এলাকা কানাডার আলবার্তা থেকে শুরু করে ম্যানিটোবা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপশ্চিমাঞ্চলীয় নর্থ ডাকোটা পর্যন্ত বিস্তৃত। নর্থ ডাকোটাতেই এ বছর শস্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে ব্যাপকভাবে। যেখানে পরিকল্পনা ছিল প্রায় ৫ হাজার একর জমিতে শস্য ফলানোর; কিন্তু বৃষ্টির কারণে তা কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৩ হাজারে। অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশেরও বেশি স্থানে শস্য বপন করাই সম্ভব হয়নি।

খারাপ আবহাওয়ার কারণে চীন, ভারত, দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলেও শস্য উৎপাদন কম হয়েছে। সার স্বল্পতার কারণেও বিশ্বজুড়ে শস্যচাষ ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্বের আরেকটি প্রধান শস্য রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম, সয়াবিনসহ অন্যান্য খাদ্যশস্য কার্যত আটকে রয়েছে। ফলে দাম বৃদ্ধি এ বছরের শুরুতেই রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। এভাবে বিশ্বজুড়ে শস্য উৎপাদন ব্যাহত হতে আগে দেখা যায়নি। কৃষি ও শিল্প বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আর শিল্পোৎপাদন বাড়লেও খাদ্য উৎপাদন কমে এলে অর্থনীতিতে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে। কারণ খাদ্যপণ্যের দাম বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা দীর্ঘ সময়ের জন্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত চাহিদা-জোগানে টানাটানি অবস্থা থাকলে একটি ফসল উৎপাদনের মৌসুমেই তা কাটিয়ে ওঠা যায়। তবে আজ আমরা যেখানে যে অবস্থায় আছি, তা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন। এখানে শস্য উৎপাদনের পরিকল্পনা একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে; অপরদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সে পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। এ অবস্থা থেকে সহসাই বের হওয়ার সুযোগ নেই। অন্তত দুই থেকে তিন বছরে খাদ্যপণ্যের দাম কমে আসার সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। ইউক্রেন ও রাশিয়াÑ দুটি দেশই খাদ্যশস্যের বড় রপ্তানিকারক। দেশ দুটি থেকেই বিশ্বের মোট গমের ২৫ শতাংশ রপ্তানি হয়। সানফ্লাওয়ার বীজ ও তেলেরও অর্ধেক এই দুটি দেশে উৎপাদিত হয়। ইউক্রেন সারা বিশ্বের কাছে অনেক ভুট্টাও বিক্রি করে। যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং খাদ্যের দাম ভয়াবহভাবে বাড়ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান ডেভিড বিসলি বলেন, ‘এই যুদ্ধ শুরুর আগেই গত চার বছরে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা আট কোটি থেকে বেড়ে ২৭ কোটি ৭৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। নানা রকম যুদ্ধ-সংঘাত, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং করোনাভাইরাস মহামারিÑ সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর দুর্যোগ তৈরি হয়েছে। বর্তমান সংকটের কারণে কিছু দেশ বিশেষভাবে সমস্যায় পড়তে পারে। কারণ এসব দেশে কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে বেশ উচ্চমাত্রায় খাদ্যশস্য আমদানি করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর ফলে এখন বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। আপনি যখন ভাবছেনÑ পৃথিবীতে যে নরকের মতো পরিস্থিতি, তা আর কত খারাপ হবে! তখনই কিন্তু এটি আরও খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছে।’

দক্ষিণ আফ্রিকার এগ্রিকালচারাল বিজনেস চেম্বারের প্রধান অর্থনীতিবিদ ওয়ানডিল সিহলোবো বলেন, ‘স্বল্পমেয়াদে হয়তো হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটাই বড় সমস্যা; কিন্তু এরপর খাদ্য ঘাটতিও দেখা দিতে পারে। এই যুদ্ধ কতটা তীব্র আকার নেয় এবং কত দিন ধরে চলে, তার উপর নির্ভর করে, সামনের দিনগুলোতে আফ্রিকা মহাদেশে পাঠানো খাদ্য চালানে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকা এবং পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনি যদি বিশ্বে খাদ্যের দামের সূচকের দিকে তাকান, এ বছরের শুরুতে এটা কিন্তু কয়েক গুণ বেশি ছিল। অনেক মানুষ কিন্তু এরই মধ্যে সংকটে আছে। যুদ্ধ সেই সংকট আরও গভীর করেছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।’

তবে এত সংকটের মধ্যেও থেমে নেই সমরাস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধি। গত ২৮ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত চলা তিন দিনব্যাপী ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে ইউরোপে সামরিক বরাদ্দ বৃদ্ধির বার্তাই পেয়েছে প্রাধান্য। পশ্চিমা এই সামরিক জোটের প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গের মতে, আগামীর বিশ্ব ক্রমেই ‘অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক’ হয়ে উঠছে। তাই সামরিক বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ‘একটি বিপজ্জনক বিশ্বে আত্মরক্ষার সামর্থ্য অর্জনে প্রতিরক্ষা খাতে আমাদের আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে।’ 

দুই নতুন সদস্য ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি র‌্যাপিড রিঅ্যাকশন ফোর্সের শক্তি বাড়ানোর বিষয়ে সম্মত হয় ন্যাটো মিত্ররা। এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় আটগুণ বাড়িয়ে ৪০ হাজার থেকে ৩ লাখ করা হচ্ছে। বাহিনীর নতুন সদস্যরা নিজ দেশেই অবস্থান করবে। তবে রুশ সীমান্তবর্তী ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলে দ্রুত মোতায়েনে তাদের প্রস্তুত রাখা হবে। ওই অঞ্চলে সামরিক সরঞ্জাম ও গোলাবারুদের মজুদ বাড়ানোরও পরিকল্পনা আছে জোটটির। প্রথমবারের মতো অতিথি হিসেবে ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দেয়Ñ জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড।

ইউরোপে ন্যাটো বাহিনীতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বাইডেন বলেন, ‘অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন এই জোটের প্রয়োজনীয়তা বেশি। স্থল, আকাশ ও নৌÑ সব দিক থেকে ন্যাটোকে শক্তিশালী করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্পেনের রোটায় মার্কিন নৌবহরে ডেস্ট্রয়ারের সংখ্যা চারটি থেকে বাড়িয়ে ছয়টি করা হবে। পোল্যান্ডে ফিফথ আর্মি কোরের স্থায়ী সদর দপ্তর স্থাপন করা হবে। রোমানিয়ায় একটি অতিরিক্ত ব্রিগেড করা হবে। তিন হাজার যোদ্ধা ও আরও দুই হাজার সেনার এই ব্রিগেড পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করবে।’ বাইডেনের ঘোষণা অনুযায়ী, বাল্টিক দেশগুলোতে পালাক্রমে দায়িত্ব পালনের সময় বাড়ানো হবে। এফ-৩৫ স্টিলথ যুদ্ধবিমানের দুটি অতিরিক্ত স্কোয়াড্রন যুক্তরাজ্যে মোতায়েন করা হবে। জার্মানি ও ইতালির জন্য অতিরিক্ত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি অন্যান্য সামর্থ্য বাড়ানো হবে।

ন্যাটোর এত যুদ্ধ আয়োজনের বিপরীতে রাশিয়া-চীনও যে বসে থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য। তবে এতে যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়বে খাদ্য সংকট ও খাদ্যপণ্যের দাম।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh