প্রণব চক্রবর্তী
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২২, ১১:৩৪ এএম | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২২, ১১:৪৩ এএম
প্রণব চক্রবর্তী
শিক্ষকনির্ভর
শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিতি থাকলেও সময়ের পরিসরে আমরা তা থেকে সরে আসতে বাধ্য
হয়েছি। এখন অভিভাবকরা এই কার্যক্রমে জড়িত, কোনো প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই। সন্তানের সঙ্গে তাদেরকেও শিক্ষার্থী বনতে
হচ্ছে, সন্তানের স্কুলের ব্যাগ
কাঁধে নিয়মিত যাওয়া আসা করতে হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কোচিং সেন্টারে। অধিকাংশ
ক্ষেত্রে মায়েদের দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হচ্ছে এক্ষেত্রে।
শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে আর আগের মতো শিক্ষাদানের ব্যবস্থা না থাকায় কোচিং বা গৃহশিক্ষকের
দ্বারস্থ হতে হচ্ছে ব্যাপক ক্ষেত্রে। শিক্ষার বাণিজ্যায়নে শ্রেণিশিক্ষক নির্ভরতার
সঙ্গে কমে গেছে তাদের প্রতি পূর্বের সমীহবোধও। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে এসেছে
মারাত্মক ফাটল। যে শিক্ষক পিতা-মাতার অনুরূপ সম্মানিত স্থানে অবস্থান করছিলেন,
অনেকেই স্খলনের শিকার হয়ে
সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। ফলে সন্তানসম শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিকৃতিতে রূপ পেয়েছে। যা বিস্তৃত হয়েছে প্রাথমিক পর্যায় থেকে
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। এই সংকট ধর্মীয় শিক্ষায়তনেও ঢুকে পড়েছে।
রাজনৈতিক
সম্পৃক্ততা দীর্ঘদিন থেকে প্রবল হওয়ায় শিক্ষক ও ছাত্ররা ভিন্ন মতের অঙ্গনে অবস্থান
নিয়েছেন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় পরাক্রমশালীদের
অংশগ্রহণ। উন্নয়ন কাজের সুবাদে এখানে অনেক অর্থ ব্যয় হচ্ছে শিক্ষা উন্নয়নে,
চলছে শিক্ষক ও কর্মচারী
নিয়োগে প্রকাশ্য বাণিজ্য। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় যুক্ত থাকা অত্যন্ত
লাভজনক বিবেচিত হচ্ছে।
এই বিশৃঙ্খল
পরিবেশ প্রগতিবিরোধী শক্তি লুফে নিয়েছে। দেশজুড়ে অনেক শিক্ষক তাদের হিংসা-দ্বেষের
মুখোমুখি পতিত হয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছেন। মনে রাখতে হবে, দীর্ঘ মূল্যবোধে
প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রক্রিয়ার বিকৃতি কঠোরভাবে বন্ধ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে তার প্রতিক্রিয়া মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া বিচিত্র নয়।
শিক্ষকদের নাজেহাল করার বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে এটিও সারা দেশে
দুষ্কৃতকারীদের হাতিয়ার হয়ে যেতে পারে। অতএব এই ঘটনাগুলো যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা
প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীদের
পোশাক নিয়ে তারা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন
না করা তথা জাতীয় সংগীত পরিবেশন থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু প্রগতিবাদী কিছু শিক্ষক
প্রকারান্তরে তাদের প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়ে এটি নিজস্ব সংস্কৃতির আবেদন হিসেবেও
চিহ্নিত করতেও পিছপা হননি। ভেবেছিলেন তিনি তো আর আক্রান্ত হবেন না। কিন্তু সেই
স্বপ্ন তারা নিজের চোখেই খান খান হতে দেখছেন এখন।
বাংলাদেশে শিক্ষক
সমিতিগুলো মোটেও দুর্বল নয়। কিন্তু শিক্ষার ইতিবাচক উন্নয়নে তাদের অবদান
উল্লেখযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকরা বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে
ক্লাস নিতে ব্যস্ত। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক বা পরিচালনা পরিষদে প্রকাশ্যে ছড়ি
দোলাচ্ছেন প্রতিক্রিয়াশীলরা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকে গবেষণা প্রায় হারিয়ে
যাচ্ছে। তাতে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। কলেজ ও বিদ্যালয়ে টিউশনের পসরা
মেলে রাখা হয়েছে। এই শৃঙ্খলাহীন পরিবেশ লুফে নিয়েছে প্রগতিবিরোধীরা।
এই অবস্থায়
নারায়ণগঞ্জে প্রধান শিক্ষককে একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি যখন কানে ধরিয়ে জিঘাংসা উপভোগ
করেন শিক্ষক সমাজ তখন মুখে তালা দিয়ে থাকেন। জাতির মেরুদণ্ড গড়ার কারিগরদের নিজেদের
মেরুদণ্ডহীনতা লুফে নিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলরা। বিভিন্ন উপায়ে তারা বাস্তবায়ন করছে
তাদের এজেন্ডা। নরসিংদী রেলস্টেশনে একজন ছাত্রীর পোশাক নিয়ে হেনস্তার কলকাঠি
নেড়েছেন একজন বর্ষীয়ান মহিলা। প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতের দৈর্ঘ্য পরিমাপ এতেই অনুমান
করা সম্ভব। এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। নওগাঁর এক শিক্ষিকাকে হিজাব সংক্রান্ত ব্যাপারে
ফাঁসানোর চেষ্টা থেকে বোঝা যায় এগুলো পরিকল্পিত কার্যক্রম।
সনাতন
ধর্মাবলম্বী শিক্ষকদের উপর এই আঘাত করলে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জোরালো হবে না ভেবে এ
ধরনের কাজ হচ্ছে যা শক্ত হাতে দমনে এগিয়ে আসতে হবে, বিশেষত শিক্ষক সমিতিগুলোকে। অভিভাবকদের আস্থায়
নেওয়ার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় মিথস্ক্রিয়ার আয়োজন করতে হবে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক
দলগুলোকেও এটি গভীরভাবে ভাবতে হবে।
উন্নয়নের মহাসড়কে
চলা এই দেশকে কাঁচা রাস্তায় নামিয়ে টানার যে কোনো অপচেষ্টা শক্ত হাতে রুখতে হবে।
শিক্ষার পরিবেশ উন্নত হয়েছে, বদলেছে শিক্ষার
ধরনও। কিন্তু শিক্ষক নিগ্রহ কমেনি। বিভিন্ন অজুহাতে শিক্ষকদের অপরাধী সাব্যস্ত
করার প্রচেষ্টা দেশ জুড়ে চলছে। আপাতদৃষ্টিতে এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এসব যে
খুব পরিকল্পিত উপায়ে করা হচ্ছে তাতে আর সন্দেহ নেই। শিক্ষার্থী ছাত্রীদের
উত্ত্যক্ত করছে। তাকে শাসন করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেই শিক্ষার্থী এতই
বেপরোয়া যে শাসনকারীকে পিটিয়ে মেরে ফেললেন। মারা গেলেন শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার।
এর আগের সপ্তাহে
নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন
কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয় প্রশাসন ও পুলিশের উপস্থিতিতে।
একজন শিক্ষার্থী ধর্ম অবমাননা করেছেন এমন অভিযোগ ওঠার পর শিক্ষক স্বপন কুমার ওই
শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন এমনই অভিযোগ বিশৃঙ্খলাকারীদের। এই ঘটনার কয়েক মাস আগে
মুন্সীগঞ্জের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে ধর্ম
অবমাননার অভিযোগ তোলে তারই শিক্ষার্থীরা। তাকে জেলে যেতে হয়। একই সময়ে আরেক শিক্ষক
আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে একইভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ আনা হয়।
সমাজে মূল্যবোধের
ভাঙচুর এখন স্পষ্ট। একজন শিক্ষকের গলায় জুতার মালা দেওয়া অর্থাৎ তার চূড়ান্ত
মানহানি। কিন্তু দুর্বৃত্তরা অপরাধ করে জেল খাটা শেষে আবার ফুলের মালা দিয়ে
সংবর্ধিত হয়ে এ সমাজেই নেতৃত্ব দিচ্ছে।
ছয় বছর আগে
নারায়ণগঞ্জের স্কুলশিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠ-বস করার প্রতিবাদে
সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা কান ধরার ছবি দিয়েছিলেন, দেশের নানাপ্রান্তে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত
হয়েছিল। তারপরও শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হচ্ছেন বারবার। কখনো নিজেদের শিক্ষার্থীদের হাতে,
কখনো দলবদ্ধ কথিত
অনুভূতিশীল গোষ্ঠীগুলোর হাতে।
বর্তমানে
লাঞ্ছনাকারীদের একটা বড় অংশ বয়সে কিশোর। এই কিশোররা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা
গোষ্ঠীর সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। অপরাধপ্রবণতা নিয়ে মাঝে মাঝে কথা বলেন
দায়িত্বশীলরা, কিন্তু দায়িত্ব
নিয়ে অপরাধ-রোধের ব্যবস্থা নিতে আগ্রহ দেখান না। ফলে কিশোর-অপরাধ বাড়ছে দ্রুততার
সঙ্গে। শিক্ষক নিগ্রহের এই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলেও আমরা সবাই যদি উদাসীন হয়ে পড়ি
তবে শিক্ষার ইনস্টিটিউশনগুলো রক্ষা সম্ভব হবে না।
নাগরিক সমাজকে
এখন ভাবতে হবে, তারা কি হাত পা
ছেড়ে দিয়ে তামাশা দেখবেন না সামাজিক প্রত্যাশা প্রকাশ্যে তুলে ধরবেন? যেমন প্রকাশ্য ছিনতাই বা ইভটিজিংয়ে এখন পাশের
মানুষটি আর ‘রা’ করে না। ফলে দুর্বৃত্তায়নে সুবিধা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের
ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সুধীজনকে অন্তর্ভুক্তকরণ, ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা এ
সময়ে জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষকদের নিজেদের সাধারণ দোষ-ত্রুটি পরিহার করে ‘রোল মডেল’
হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে উপস্থাপনের প্রয়াস নিতে হবে। শিক্ষক সমিতিগুলোকে এ
বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
আগে যে সামাজিক
নিয়ন্ত্রণ ছিল তা এখন শহর বা গ্রামে আর অবশিষ্ট নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের
শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কটি শেষ করার জন্য একটি মহল উঠেপড়ে
লেগেছে। এদের প্রতিহত করার বিকল্প নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি নইলে থেমে
যেতে বাধ্য হবে। আর সেটি হবে আমাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ।
লেখক- কথাসাহিত্যিক