এম এ মাসুদ
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২২, ০৮:০৬ পিএম | আপডেট: ২০ জুলাই ২০২২, ০৩:১৫ পিএম
এম এ মাসুদ
সারাবিশ্বে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক বিষয়। করোনা মহামারী শুরুর পর প্রায় দুই বছরে স্বাভাবিকের তুলনায় পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। তবে এই হার যেন বাংলাদেশে অনেকটাই বেশি। এমনিতেই মহামারির ধকলে বেসামাল মানুষ। সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বল্গাহীনভাবে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি যেন নিম্ন ও স্থির আয়ের মানুষের ওপর বসিয়েছে আর এক ঘা।
মানুষের আয় বা ক্রয়ক্ষমতা যদি বাড়ে তবে পণ্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি মেনে নিতে খুব একটা কষ্ট হয় না। যদিও উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে দেশ, তারপরেও দেশে অনেক মানুষ রয়েছ দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্য। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯-র প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা ২০ দশমিক ৫ এবং অতি দারিদ্র্যের সংখ্যা ১০ দশমিক ৫ শতাংশ।
এছাড়া রয়েছে নানা পেশার স্থির আয়ের মানুষ। যে
কোনো পরিমাণ মূল্য বৃদ্ধিই এসব মানুষের ওপর পড়ছে বিরুপ প্রভাব। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়
ভোগ কমিয়ে দিতে হচ্ছে স্থির আয় ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষকে। দৈনিক, সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক
আয় দিয়ে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে অনেকের। অসীম অভাবের মধ্যে কোন অভাবটি আগে পূরণ
করবেন সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে খাচ্ছেন হিমসিম। কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন দৈনন্দিন ভোগ
ব্যয়। কাঁটছাট করতে হচ্ছে সন্তানদের শিক্ষা ব্যয়সহ নানান আবদার। চাহিদা পূরণ করতে না
পেরে দেখা দিচ্ছে পরিবারের সদস্যদের মনোকষ্ট। নিম্নমূখী হচ্ছে জীবনযাত্রার মান। মূল্যবৃদ্ধির
সময় ধনীদের আয় ও মুনাফা বাড়ে। তাই ধনীরা টের না পেলেও দারিদ্র্য, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও
স্থির আয়ের মানুষ মূল্য বৃদ্ধিতে দিশেহারা। মূল্য বৃদ্ধির এ প্রভাব গিয়ে পড়ে সমাজেও।
আর্থিক সংকট মোকাবেলায় অনেকে অবৈধ উপার্জনের পথ বেছে নিতে পারে।
মূল্যবৃদ্ধিকালীন ধনীরা আরো
ধনী এবং গরিবরা আরো গরিব হয় বলে সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে আয় বৈষম্য। লিটারে ১৫ টাকা ডিজেলের
মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়েছে পরিবহন খাতসহ বিভিন্ন খাতে। প্রভাব পড়েছে জমি
চাষ ও সেচ কার্যে। দাম বাড়িয়েছেন জমি চাষ ও সেচ প্রদানে নিয়োজিত পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর
ও সেচ পাম্প মালিকরা।
লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতির
হার। ১৯ জুলাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মে মাসের ভোক্তা মূল্যসূচকের
(সিপিআই) হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়েছে- জুন মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে
৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা গত মে মাসে ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। সাধারণ মূল্যস্ফীতির হারও মে
মাস থেকে বেড়েছে জুন মাসে। জুন মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬
শতাংশ, যা গত মে মাসে ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য বলছে, গত জুন
মাস শেষে দেশে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশে। আর খাদ্যবহির্ভূত
মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য কিনতে গিয়েই সবচেয়ে বেশি চাপে
রয়েছে মানুষ। আবার শহরাঞ্চল ও গ্রামের মানুষের মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি গ্রামাঞ্চলে।
কারণ, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি।
সদ্য প্রকাশিত বিবিএসের দেওয়া
তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ০৯ শতাংশে।
আর একই সময়ে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি
পৌঁছেছে প্রায় ৯ শতাংশে। জুন শেষে গ্রামে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯৩
শতাংশ। শহরাঞ্চলে এ হার ৭ শতাংশের ওপরে রয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো দাম যেভাবে
বাড়ে, সেভাবে কমে না কেন?
সহজ উত্তর- শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধের কারণে দাম বৃদ্ধি নয়। দাম বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীরও
হাত। যারা ভোক্তাদের স্বার্থ নয়, বরং নিজেদের হীন স্বার্থে সমাজ বিরোধী কর্মকান্ডে
লিপ্ত রয়েছে। মজুতদার, কালোবাজারি, মুনাফাখোর,
চোরাকারবারি অধিক লাভের আশায় দেশের অভ্যন্তরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর অবৈধভাবে
মজুত করে বা বাজার থেকে সরিয়ে ফেলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে তেল, চালসহ নিত্যপণ্যের
দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।আবার, যুদ্ধজনিত কারণে পণ্যের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ব্যবধান
থাকায়ও মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে যোগান স্বাভাবিক থাকলেও অনেক সময় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট
করে যোগানে ঘাটতি দেখিয়ে মূল্যবৃদ্ধির মতো কাজটি করে থাকেন। এছাড়া রয়েছে সুষ্ঠু বাজার
ব্যবস্থাপনার অভাব। অবৈধ আয় উপার্জনকারীদের ক্রয় ক্ষমতা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি যা
প্রকারান্তরে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাজার তদারকি ব্যবস্থায়
ঘাটতিও মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী।
মূল্য বৃদ্ধির এমন প্রবণতা
থেকে বেড়িয়ে আসতে নজর দিতে হবে কৃষিতে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ, উন্নত বীজ, সার ও সেচের
ব্যবস্থা করতে পারলে উৎপাদন বাড়বে ও দাম আয়ত্বের মধ্য থাকবে খাদ্যশস্যের। দাম কমবে
অনেক সংশ্লিষ্ট পণ্যেরও। রক্ষা হবে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ভারসাম্য। ভোজ্যতেলের চাহিদা
পূরণে ব্রাজিল, আর্জেনটিনা ও যুুুুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া
থেকে পাম তেল আমদানি করতে হয়। তাই দাম নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। আমদানিকৃত
সয়াবিন তেলের উপর নির্ভরতা কমিয়ে দিয়ে দেশে তৈলবীজ জাতীয় ফসল উৎপাদনে জোর দিতে হবে।
নির্ভরতা বাড়াতে হবে উৎপাদিত সরিষার তেলের উপর। এতে দেশের কৃষকেরা যেমন উপকৃত হবেন
তেমনি সাশ্রয় হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার।
গত ১৭ জুলাই বিভিন্ন পত্রিকায়
প্রকাশিত তথ্য বলছে ৫৩ ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম কিছুটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
কিন্তু দাম কার্যকরী হওয়ার আগেই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা এমন খবরও আসছে পত্রিকায়।
গত ৫ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে
বৈঠকের পর ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ভেজিটেবল
অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন' প্রতি লিটার বোতলজাত
সয়াবিনের দাম ৩৮ বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা হওয়ার খবর চাউর হওয়ার আগেই মানুষের পকেট ফাঁকা করে অধিক মুনাফা লুটিয়ে নিতে
দুই, তিন দিন পূর্বেই বাজার থেকে তেল উধাও করেছিলেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। লুকিয়ে ফেলেছিলেন
গর্তেও। গত রবিবার (১৭ জুলাই) আন্তর্জাতিক বাজার ভোজ্যতেলের দাম কমায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে দাম পুনঃনির্ধারণ করে সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি ১৪ টাকা
কমিয়ে ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। যা ১৮ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক
হলো দাম বৃদ্ধির সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার আগেই তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে মুনাফা লুটতে কু-বুদ্ধির
পরিচয় দেন বটে, কিন্তু দাম কমলেও আগে কেনার অজুহাত দেখিয়ে নতুন নির্ধারিত দামে সাধারণ
মানুষের কাছে বিক্রি করতে অসাধু ব্যবসায়ীদের সুবুদ্ধির উদয় হয় না। এর আগে গত ২৬ জুন
তেলের দাম লিটারে ৬ টাকা কমিয়ে ১৯৯ টাকা করা হয়েছিল। তবে সরকার দাম কমানোর ঘোষণা দেয়ার
পর দীর্ঘ দিন ধরেই আগের দাম লিটারে ২০৫ টাকা দরে কিনতে বাধ্য হন ক্রেতারা। এমন মুনাফা
লুটতে দেখা যায় এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রির ক্ষেত্রেও।এভাবে অবৈধ ব্যবসায়ীরা সরকারের
ভালো অর্জনগুলোকেও ফিকে করে দিচ্ছে।
সে যাই হোক, ব্যবসায়ীরা যাতে
নিজেদের খেয়ালখুশি মতো পণ্যের দাম নিতে না পারে সেদিকে নজরদারি জোরদার করা জরুরি। পাশাপাশি চোরাচালানকারীরা যাতে পণ্য পাচার এবং মজুতদাররা
যাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা লুটতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
গ্রহণ করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। মূল্য বৃদ্ধির ধকল থেকে রেহাই পেয়ে খেয়ে-পরে,
চিন্তামুক্তভাবে যাতে বাঁচতে পারেন নিম্ন ও স্থির আয়ের মানুষ রাষ্ট্রের নিকট এতটুকুই
প্রত্যাশা।
লেখক : এম এ মাসুদ, কান্দি গার্লস আলিম মাদ্রাসা, পীরগাছা, রংপুর