যাত্রীবান্ধব গণপরিবহণের অপেক্ষায় বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২২, ০১:১৬ এএম

ট্রেনের টিকেট কিনতে গিয়ে ‘প্রতারণার শিকার হন’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি। ফাইল ছবি

ট্রেনের টিকেট কিনতে গিয়ে ‘প্রতারণার শিকার হন’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি। ফাইল ছবি

উন্নত যোগাযোগের জন্য বাস্তবায়িত হচ্ছে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো বড় বড় প্রকল্প। কিন্তু এর মাঝেই যাত্রী কল্যাণের বিষয়টি ঘুরেফিরে আটকে যাচ্ছে অজানা বৃত্তে। কেন? গত ১৩ জুন ট্রেনের টিকেট কিনতে গিয়ে “প্রতারণার শিকার হন” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি। পরে ৭ জুলাই থেকে তিনি অবস্থান নেন কমলাপুর রেল স্টেশনে।

ছয় দফা বাস্তবায়নে তার স্মারকলিপির জবাবে দাবি মানার আশ্বাস দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট নন রনি। তিনি বরং বলছেন, “একজন বাবা বাচ্চাদেরকে যেভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বোঝান, রেলের মহাপরিচালকও সেভাবে তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন।”

তিনি বলেন, “উনার কথার টোন আমার ভালো লাগেনি। উনার কাছে নাকি কেউ অভিযোগও জানায়নি।” অভিযোগ জানাতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দুর্নীতি চালিয়ে নিতে অভিযোগ জানানোর পথ রেল কর্তৃপক্ষ বন্ধ করতে চায়।”

এক প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন রনি জানান, আন্দোলনের বিষয়টি শুরুতে তার মাথায়ও আসেনি। কেবল চেয়েছিলেন, তার সাথে যেটা ঘটেছে, সেটা যেন আর কারো সাথে না ঘটে। এর জন্য তিনি নানাভাবে চেষ্টা করে গেছেন, শেষ পর্যন্ত অবস্থান নিয়েছেন কমলাপুরে। দুইদিনের মাথায় পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করলে এটি আন্দোলনে রূপ নেয়।

এরই মাঝে রনির অভিযোগের ভিত্তিতে শুনানির পর গত ২০ জুলাই রেলওয়ের টিকেট বিক্রির দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানি সহজ ডটকমকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এই জরিমানার টাকার ২৫% পাবেন রনি।

এদিকে বিষয়টিতে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। শুনানির এক পর্যায়ে ট্রেনের ছাদে যাত্রী পরিবহণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশও দিয়েছে আদালত। বিষয়টি এখনো বিচারাধীন থাকায় আদালত থেকে যাত্রী কল্যাণে আরও নির্দেশনা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তবে রনি এখন আর নিজের কথা ভাবছেন না। তিনি ভাবছেন দেশের সব যাত্রীর কথা। তাই আন্দোলনের মাধ্যমে রেল খাতে অব্যবস্থাপনা দূর করেই ঘরে ফিরতে চান তিনি। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী একবার আশ্বাস দিক যে, দাবিটি মানা হবে। এরপর আমরা তার পাশে থেকে এমনভাবে কাজ করবো, যাতে তার স্টেটমেন্ট ব্যর্থ না হয়।”

“প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিলে আমরা ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকরা বসে সমাধানের পথ বের করবো। আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবো। আমি ছাড়ার পাত্র নই।”

রেল মন্ত্রণালয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলনের। মন্ত্রণালয়ে থাকার সময় এবং তার পরে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন, শামিল হয়েছেন অন্যদের সাথেও। কালোবাজারি দূর করা, টিকেট যার ভ্রমণ তার নীতি প্রয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় তিনি।

তিনি মনে করেন, “টিকেটের কালোবাজারি দূর করতে না পারলে যাত্রীকল্যাণের বড় অংশই নিশ্চিত হবে না। টিকেটের টাকা ‘রিফান্ড’ নিশ্চিত করতে হবে এবং সম্ভব হলে সেটাও অনলাইনে করতে হবে।”

তার মতে, যার নামে টিকেট কেনা হবে, তাকেই ভ্রমণ করতে হলে কালোবাজারি দূর হবে। তার দাবি, “এনআইডি ভ্যারিফিকেশন করে টিকেট দিতে হবে। অনবোর্ড সেভাবেই টিকেট চেক করতে হবে।”

তিনি বলেন, “যাত্রীর নামে টিকেট কিনতে হলে কালোবাজারিরা কার নামে কিনবে, কার কাছে বিক্রি করবে। এই পয়েন্টকে কাজে লাগিয়েই এটা বন্ধ করতে হবে। ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়া এই দুর্নীতি অন্য কোনোভাবে, যেমন, কালোবাজারিদের ধরে বন্ধ করা সম্ভব না।”

পদ্ধতিগত পরিবর্তনের কথাই ঘুরে ফিরে বলেন মাহবুব কবির। তিনি বলেন, “এক সময় রেলের তেল চুরি হতো। ফুয়েল ট্র্যাকার বসানোয় এখন ট্রেনে কতটুকু তেল আছে, সেটা অফিসে বসেই দেখা যায়। সেসব ট্রেনে তেল চুরি বন্ধ হয়ে গেছে।”

হাইকোর্টের আদেশে আশার নতুন দিশা পাওয়ার কথা জানিয়ে মাহবুব কবির বলেন, “আমার বিশ্বাস, আগামী ঈদে এখনকার পরিস্থিতি থাকবে না।” রেলের টাইম ঠিক করা, গতি ঠিক করার মতো কাজও সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ট্রেনে যাত্রী দুর্ভোগ সম্পর্কে বলেন, “ট্রেনে দীর্ঘদিন যাবত একটা ভয়ানক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কালো বিড়ালের কবল থেকে যতক্ষণ রেলকে মুক্ত করা যাবে না, ততক্ষণ জনগণের প্রত্যাশিত রেল হবে না।”

তিনি বলেন, “ক্রয়-বিক্রয়ে লুটপাট এবং টিকেটের কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে। চলমান আন্দোলনে জনগণকে আরও সম্পৃক্ত করতে হবে। আন্দোলনকে বড় করে বড় ধাক্কা দিতে না পারলে এটা সম্ভব হবে না।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বালতির তলা ফুটো করে উপর থেকে পানি ঢাললে যে অবস্থা হয়, রেলে গত এক যুগ ধরে এভাবেই কিন্তু বিনিয়োগ হচ্ছে। সে কারণে সুফল মিলছে না।”

সড়ক যোগাযোগে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতেও অনেক কাজ বাকি বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, “বেসরকারি পরিবহণ মালিকদের উপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ কারণে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নৈরাজ্য বন্ধ করা, জনগণের প্রত্যাশিত গণপরিবহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। আমরা মনে করি, সরকারের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। বেসরকারি মালিকদের বাস থাকবে। কিন্তু সরকারের নিয়ন্ত্রণে তা পরিচালিত হবে।”

ঢাকায় কোম্পানির অধীনে বাস চালানোর যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ওপরও জোর দেন তিনি।

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক মো. শামসুল হক বলেন, “উন্নয়ন থেকে ফোকাসটা সরিয়ে যাত্রীবান্ধব অপারেশন এবং ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়া উচিত। সরকারের সব পর্যায়ে সবাই ‘উন্নয়ন ফোকাসের’ মধ্যেই আছে। রেল তো চাইতেই পারে, আরো লক্ষ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু এর আগে গত ১০ বছরের বিনিয়োগের মূল্যায়ন হওয়া উচিত।”

তিনি বলেন, “সবাই সিস্টেমের বেনিফিশিয়ারি। ট্রান্সফার অব টেকনোলোজির নামে যে দপ্তরের প্রজেক্ট, এই অনুমোদন প্রক্রিয়ায় যতগুলি সংস্থা জড়িত, প্রত্যেকেই ভাগবাটোয়ারায় সরাসরি যুক্ত।”

“মন্ত্রী যখন বলেন, রেল প্রফিটের জন্য বসেনি। পরের প্রশ্ন হলো, উনি যখন প্রকল্প নিয়েছেন, তখন কি বলেছেন যে, আমি যদি এই প্রকল্প নেই, তাহলে আমি লোকসানে পড়বো? এই লোকসান ধরেই প্রকল্প পাস করানো? তা বলেন নাই। সুন্দর সুন্দর কথা বলেই কিন্তু প্রকল্পের অনুমোদন নিয়েছেন। এখন কেউই এটার দায়িত্ব নিচ্ছে না। না মন্ত্রণালয়, না সংসদীয় কমিটি, না প্ল্যানিং কমিশন।”

“প্রজেক্ট পাস হওয়ার পর আমি যখন চালাতে পারি না, তখন আমি সুন্দরভাবে বলে ফেলছি, রেল এখানে প্রফিটের জন্য বসে নাই। এই ধরনের স্পর্ধার কথা যখন রাষ্ট্রের সামনে বসে, তখন বুঝতে হবে, চেইন অব কমান্ডের মধ্যে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার কেউ নাই।”

তিনি আরো বলেন, “এখানে রাজনৈতিক একটা দৃঢ় প্রত্যয় লাগবে যে, এত হাজার কোটি টাকা দিলাম, ১০-১২ বছর পর এখন মূল্যায়নের সময় এসেছে। সব কাজ করতে হবে দায়বদ্ধভাবে। শিখিয়ে যাওয়া কথা বলে সরকার কিন্তু আর বেশিদিন যেতে পারবে না।”

গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক মো. শামসুল হক বলেন, “তিনটা মাধ্যমের মধ্যে রেল বিনিয়োগ বঞ্চিত ছিল, সেখানে সরকার দয়াপরবশ হয়ে, বিচক্ষণ হয়ে বিনিয়োগ করেছে। অনেক উন্নয়ন দিয়েছে। এখানে ডেলিভারি এন্ডে পারফর্ম্যান্স দেখা ম্যান্ডেটরি হয়ে গেছে। জবাব না পেলে আর বিনিয়োগ দেওয়া উচিত হবে না। এই কথাগুলো যারা বলবেন, তাদের ইনার স্ট্রেন্থ নেই। কারণ তারাও বেনিফিশিয়ারি।”

তিনি বলেন, ‘“এত উন্নয়ন দেখছে, কিন্তু সার্ভিস তলানিতে চলে গেছে। রেলকে প্রচুর রিফর্ম করতে হবে। রেল শতভাগ সরকারি। সরকার এখানে সেবা দিতে পারে না। এটা সরকারকে আগে বুঝতে হবে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি রেলের বেসরকারিকরণের কথাও বলেন। তিনি বলেন, “একটা বাস কোম্পানি থাকলে ঢাকার ড্রাইভাররাও ভদ্র হয়ে যাবে। বড় বড় কোম্পানিকে অনুমোদন দিয়ে রেগুলেশন শক্ত করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। গ্রামীণফোনের মতো কোম্পানি যদি এখানে থাকতো, তাহলে তাকে ডেকে এনে হাজার কোটি টাকা জরিমানা করা যেতো। কোম্পানি তাদের ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষতিকেও বিবেচনায় নিতো।”

গণপরিবহণের ভোক্তাদের সক্রিয় হওয়ার আহ্বান

গণপরিবহণ ব্যবহারকারী ভোক্তাদের সক্রিয় ও সচেতন হওয়া ছাড়া যথাযথ সেবা নিশ্চিত হবে না বলেও আলোচনা এসেছে ঘুরে ফিরে। সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন বলেন, “ট্রেনের টিকেট কেনার চেষ্টার পর টাকা কেটে নিয়েছে, টিকেট পাওয়া গেল না। পরিষ্কার ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন। অসংখ্যভাবে ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘিত হয়।”

“ট্রেনে স্ট্যান্ডিং টিকেট দেওয়াও অবৈধ। এতেও নিয়মিত যাত্রীর অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। ১৮৯০ সালের ট্রেন আইন অনুসারে প্রতিটা বগিতে সুনির্দিষ্ট করা যাত্রীর বাইরে আর যাত্রী নেওয়ার সুযোগ নেই। সরাসরি কোনো যাত্রী তুলতে পারবে না বা এমন কোনো কাজ করতে পারবে না, যাতে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠে।”

“যে কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সেটার প্রমাণসহ ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করা যেতে পারে।”

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, “১০টা সেবার ক্ষেত্রে আমাদের কার্যক্রমের আওতা আছে, যার মধ্যে পরিবহণ খাতও রয়েছে। বিমান-রেলওয়েকেও আমরা আগে নোটিশ করেছিলাম। কোনো অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়।”

তিনি বলেন, “প্রমাণসহ অভিযোগ করতে হবে। রনি সহজের কাছ থেকে টিকেট কিনেছে। কিন্তু টাকা কেটে নিলেও সে টিকেট পায়নি। সেই টিকেট আবার কালোবাজারে বিক্রি হয়েছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “রনি যে সেবাটা ক্রয় করেছে, তার অ্যাকাউন্ট থেকে বিকাশে পেমেন্ট গিয়েছে। সেই টিকেটটা যে আনসোল্ড দেখিয়েছে, সহজ একটা মেইল করেছে যে, রিফান্ড দেবে। এ সবই প্রমাণ। কেস টু কেস ডকুমেন্ট আলাদা হতে পারে। বৈধভাবে একটা টিকেট কাটলেন। আপনি চড়তে পারলেন না। তখন আপনি যে ঢুকতে পারেননি, সেই ছবি তুলে রাখা বা ভিডিও রাখা যেতে পারে।”

তিনি বলেন, “আমরা যে জরিমানা করি, তার ২৫% অভিযোগকারী পায়।”

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh