আস্থা অর্জনের চ্যালেঞ্জে ইসি!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২২, ০৮:৫৭ এএম

নির্বাচন ভবন। ফাইল ছবি

নির্বাচন ভবন। ফাইল ছবি

গণতন্ত্রে ভোট বা নির্বাচন মানে উৎসব; কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দেশের সাধারণ জনগণের কাছে ভোটের উৎসব হারিয়ে গেছে। এখন কোনো নির্বাচনে আশানুরূপ ভোটার উপস্থিতি দেখা যায় না। ভোটের রাজনীতির চিত্র ক্রমেই বিবর্ণ থেকে বিবর্ণতর হচ্ছে। ভোট ব্যবস্থায় পর পর দুটি বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। 

এ অবস্থায় ভোটারদের কেন্দ্রমুখী হওয়ার পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করছিল, সেসব বিষয়ের সংকট নিরসনে চ্যালেঞ্জে নেমেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটার ও প্রার্থীদের আস্থা অর্জন করে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সর্বজনগ্রহণযোগ্য করার প্রত্যয় ইসির। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শীর্ষ রাজনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে এই ইসি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। তাই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সামলে সব দলকে নিয়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন নির্বাচন কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এ দিকে গত ১৭ জুলাই থেকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের কর্মপদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এ সংলাপ চলবে ৩১ জুলাই পর্যন্ত। সংলাপ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে পদ ছেড়ে চলে যাব। আমাদের অনুরোধ করতে হবে না। আমরা আমোদ-ফুর্তি করতে আসিনি। এ নিয়ে বিএনপিসহ কোনো রাজনৈতিক দলের চিন্তা করতে হবে না। সব বিতর্ক এড়িয়ে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে সবার মতামতের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এ সময় তিনি সব দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে অনিয়ম ও পেশিশক্তির প্রভাব কমবে।

তিনি আরও বলেন, একটি দল ৩০০ আসনে এককভাবে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে সেটা গণতন্ত্র না। এর ফলে স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নির্বাচনে রাজনৈতিক ঐক্য দরকার। ঐক্য গঠনে যে কোনো অরাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অবদান রাখতে পারেন বলে মনে করেন সিইসি। 

ইভিএম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন আছে। এগুলো নিরসনে কাজ করা হবে। এ সময় তিনি আরও বলেন, কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কাজ করছে না। কারও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার মানসিকতা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। মাঠের সহিংসতা বন্ধ করার দায় ইসির নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর। ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনের দায় বর্তমান কমিশনের নয়। সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা না করলে নির্বাচনের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে বলে জানান তিনি। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কমিশনসহ গোটা নির্বাচনব্যবস্থা আস্থার সংকটে পড়েছে। আর সে সংকট হচ্ছে গভীর থেকে গভীরতর। নির্বাচন নামের ব্যবস্থাটির সঙ্গে এর মূল অংশীজন ভোটারদের সংযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। ফলে গণতান্ত্রিক সমাজের প্রথম ধাপ নির্বাচনই এখন বড় প্রশ্নের মুখোমুখি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, জনগণ নিজের ভোট নিজে দিতে পারাকে এক ধরনের অধিকার আদায় বলে বোধ করতেন। সারা বছরের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার একটি প্রতিশোধ হিসেবে নির্বাচনকে বেছে নিতেন। নির্বাচনের পর তাদের সব মুশকিলের আসান হতো না বটে, তবে তারা আরেকটি নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকতেন। রাজনীতিকরাও মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণের কথা বলে ভোট চাইতেন।

বিএনএফের প্রেসিডেন্ট মুক্তিযোদ্ধা এস এম আবুল কালাম বলেন, শুরু থেকেই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করতে হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ অনেক কঠিন হবে বলে আমাদের ধারণা। দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ অবস্থায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইসির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, এই নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর হাতের পুতুল হয়েই থাকবে। আজ দেশের জনগণের ভোটের অধিকার নেই। এখন আইন করে তা ছিনতাই করা হয়েছে। এখন ভোটের কেন্দ্র পাহারা দিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার কায়েম করতে পারে না। তাই আওয়ামী লীগের আনুগত্য ইসি দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের সামনে প্রশাসন বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো অসহায় হয়ে পড়েছে। তাই বর্তমান সরকারের অধীনে ইসি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা আছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। সব ক্ষেত্রে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, রাজনীতিবিদদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। তাই দেশের জনগণের কাছে কারও জবাবদিহিতা নেই। জাতীয় পার্টি আবারও প্রহসনের নির্বাচন চায় না। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ইসির পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলকে আলোচনার জন্য ডাকা হলে, আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সংলাপে অংশ নেব।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনী ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি নানা কারণে ভেঙে পড়েছে। এই ভেঙে পড়া নির্বাচন পদ্ধতিকে পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস করে এবং নির্বাচনের প্রতি জনআস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে বর্তমান ইসির জন্য আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ। আর যদি তারা তা করতে ব্যর্থ হন- তাহলে ফলাফল কারও জন্যই সুখকর হবে না। তবে আগামী নির্বাচন নিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে ইসির এ সংলাপ অনেকটা ইতিবাচক বলে তিনি মনে করেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে কোনো নির্বাচন কমিশনই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। এই নির্বাচন কমিশনের কোনো ক্ষমতা নেই। কী হবে তাদের সঙ্গে সংলাপ করে? সরকার পরিবর্তন না হলে কোনো লাভ হবে না। সে জন্য বিএনপি ইসির কোনো সংলাপে বা আলোচনায় যাবে না। 

তিনি আরও বলেন, মূল প্রশ্ন হলো সরকার। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকলে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগও দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। তাই এ সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সব দাবিকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ নিজের মতোই পথ চলছে। এ নির্বাচন কমিশন তাদের সাজানো পথেই চলছে; কিন্তু ভোটের অধিকার আদায়ে জনগণ এবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে ছাড়বে।

সম্প্রতি কুমিল্লার নির্বাচন পরিচালনা ব্যবস্থা থেকে ইসির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা চুনোপুঁটিদের আচরণবিধি মানানোর বিষয়ে কঠোর হলেও রাঘববোয়ালদের বিষয়ে কঠোর হতে ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জনগণ চায় এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হোক। তাই নির্বাচন কমিশনের উপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা না ফিরলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কখনোই সম্ভব নয়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh