ভুয়া সনদধারী শিক্ষকদের হাসি বনাম মেধাবীদের দীর্ঘশ্বাস

এম এ মাসুদ

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২২, ০৮:৪৭ পিএম

এম এ মাসুদ

এম এ মাসুদ

প্রবাদ রয়েছে, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।' আর মেরুদণ্ড তৈরির গুরুদায়িত্ব পালন করেন শিক্ষকরা। এজন্যই তাদের অপর নাম মানুষ গড়ার কারিগর। সঠিক পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটান ওই শিক্ষকরা, শেখান নৈতিকতা। শিক্ষকদের সঠিক পাঠদান, দিক নির্দেশনা ও পরিচর্যায় বেড়ে ওঠে তারা সুনাগরিক হিসেবে। পরিণত হয় দক্ষ মানব সম্পদে। ফলস্বরূপ উন্নত হয় পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতি।

শিক্ষা একটি জাতির শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম নির্ণায়ক। তাই জাতির উন্নয়নে নৈতিকতা ও বিবেকবোধসম্পন্ন মেধাবী মানুষগুলোকে শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসা অপরিহার্য। কেন না, নৈতিকতা ও বিবেকবোধসম্পন্ন মেধাবী শিক্ষকেরাই কেবল পারেন উদার ও নৈতিকতাবোধসম্পন্ন বিভিন্ন পেশাজীবী উপহার দিতে।

দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত কোনো এক নিবন্ধে পড়েছিলাম, উনিশ শতকের দিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্তসহ অনেক শিক্ষানুরাগী নাকি বিশ্বাস করতেন নিখাদ শিক্ষার জন্য শক্ত মেরুদণ্ডের শিক্ষক অপরিহার্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো সেই মৌলিক বিষয়টি আমরা গুরুত্বহীন করে ফেলেছি।

২৪ অক্টোবর, ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী কলেজ ও মাদ্রাসায় (আলিম, ফাজিল, কামিল) প্রভাষক পদে নিয়োগের শর্ত ছিল কামিল দ্বিতীয় শ্রেণিসহ সকল পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি/বিভাগ এবং প্রভাষক(সাধারণ/বিজ্ঞান) পদে দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার্স ডিগ্রীসহ সকল পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি/বিভাগ থাকতে হবে। অথচ দেখেছি, কামিল কিংবা মাস্টার্সে তৃতীয় শ্রেণিসহ একাধিক পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণি পাওয়া কিংবা আদৌ মাস্টার্স না করা এমন ব্যক্তিও একাডেমিক রেজাল্ট গোপণ কিংবা সনদ জাল করে মোটা অংকের উৎকোচ, প্রভাব খাটিয়ে বা কমিটিকে ম্যানেজ করে প্রভাষক পদে ঢুকে পড়েছেন। ফলে ২০০৫ সালের(১ম নিবন্ধন) পর প্রভাষক পদে যে সমস্ত শিক্ষক যোগদান করেছেন তারা অনুপাত প্রথার যাতাকলে পড়ে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক বা সহকারি অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি(উচ্চতর গ্রেড) থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ওইসব অবৈধ নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য যারা কিনা আগে এমপিওভুক্ত হওয়ার যুক্তিতে জ্যেষ্ঠ হয়েছেন। হয়েছেন উপাধ্যক্ষ। হয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। নিবন্ধন নিয়ে যোগদান করা এক প্রভাষক ১২ বছরের অধিককাল সময় ধরে একই পদে চাকুরি করে আসলেও তাকে পদোন্নতি দিচ্ছেন না অধ্যক্ষ। ভুয়া সনদ জেনেও বাংলার ওই জ্যেষ্ঠ প্রভাষককেই পদোন্নতি দিবেন তিনি। তার ভাষায়, 'ভালো চোখ কানা করবো না।' বিষযটি মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাও জানেন। তারপরেও পদোন্নতির জন্য ফাইল পাঠান। কারণ এখানেও উৎকোচ।

এদিকে, ২০০৫ সালে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) নামে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার আগে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো উৎকোচের বিনিময়ে। মেধার মূল্যায়নের পরিবর্তে হতো উৎকোচের মূল্যায়ন। খুব সম্ভবত এমন উপলব্ধি থেকে এবং মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে ২০০৫ সালে গঠিত হয় এনটিআরসিএ। শুরু হলো পরীক্ষা নেওয়া ও ৫ বছর মেয়াদী সনদ দেওয়া। কিন্তু নিয়োগের দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান ও কমিটির ওপর থাকায় নিবন্ধন পাশ করা চাকরি প্রত্যাশীরা আশায় বুক বাধলেও তা গুড়ে বালিতে পরিণত হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া এনটিআরসিএ কর্তৃক সম্পন্ন না হওয়ায় বন্ধ হয়নি উৎকোচ নেওয়ার প্রবণতা। উপরন্তু নিবন্ধন সনদ জাল করে নিয়োগ পেয়েছেন বা নিয়োগ নিয়েছেন অনেকেই। ফলাফল 'যে লাউ, সেই কদু অবস্থা' বিরাজমান ছিল।

এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় নাম সর্বস্ব শিক্ষাগত যোগ্যতা, কম্পিউটার শিক্ষা, নিবন্ধন এবং অভিজ্ঞতার সনদ নিয়ে অতীতে সহকারি শিক্ষক ও প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন অনেকেই। বছর কয়েক আগে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনামে দেখেছিলাম '৬০ হাজার শিক্ষকের সনদ জাল!'

গত ২৮ মে, দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ১ হাজার ১৫৬ জন শিক্ষকের সনদ জাল। তাঁদের মধ্যে ৭৯৩ জন এনটিআরসিএর শিক্ষক নিবন্ধনের ভুয়া সনদ দেখিয়েছেন। অন্যদের মধ্যে ২৯৬ জনের কম্পিউটার শিক্ষার সনদ এবং ৬৭ জনের বিএড, গ্রন্থাগার, সাচিবিক বিদ্যা ও অন্যান্য বিষয়ের সনদ জাল।

রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে এনটিআরসিএর ভুয়া সনদ দাখিল করা শিক্ষক রয়েছেন ৪৪৩ জন। ঢাকা ও ময়মনসিংহে ৩৬৬ জন, খুলনা ও বরিশালে ২৫১ জন এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ৯৬ জন শিক্ষকের সনদ জাল।

জালিয়াতি বন্ধ করার উপায় কী, জানতে চাইলে মাউশির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, জাল সনদের মাধ্যমে এমপিওভুক্তি ঠেকানোর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে অনলাইনেই সনদ যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা। এটি শুরু হয়েছে।(দৈনিক প্রথম আলো)।

নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কমিটির পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়োগ পাওয়া নাম সর্বস্ব শিক্ষাগত যোগ্যতার শিক্ষক ও প্রভাষকরা পদোন্নতির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা মেধাবীদের। শুধু তাই নয়, এই ভুয়া সনদধারী বিপুলসংখ্যক শিক্ষক নিবন্ধনকৃত চাকুরি প্রত্যাশী মেধাবী বেকার যুবদের শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। বঞ্চিত করেছেন তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে। আর শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন সুশিক্ষা থেকে। যা প্রকৃত পক্ষে সরকারের শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের পথে অন্তরায়।

গত ১৩ জুন, শিক্ষক নিবন্ধন ও নিয়োগ নিয়ে এক নিবন্ধে শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল লিখেছিলেন, 'যে শিক্ষকরা জাল সনদ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন, তাঁরা ক্লাসে চুরি-ডাকাতি-প্রতারণা করানোর বাইরে আর কী পড়ান- আমার জানার খুব কৌতূহল।'

সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা অন্যায় করতে পারেন না এবং ন্যায় বোধের উৎস হচ্ছে জ্ঞান এবং অন্যায় বোধের উৎস হচ্ছে অজ্ঞতা। সক্রেটিসের উক্তি অনুসারে বলা যেতে পারে যাঁরা একাডেমিকসহ বিভিন্ন ভুয়া সনদ নিয়ে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন তাঁদেরকে নিছক চাকুরিজীবী বলা গেলেও জ্ঞানী বলা যায় না। কারণ শিক্ষক হতে হলে মেধাবী হতে হয়, জ্ঞানী হতে হয়। কাজেই ভুয়া সনদ বানিয়ে বা তথ্য গোপন করে উৎকোচ দিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে, প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কমিটির যোগসাজশে ঢুকে পড়লেই শিক্ষক হওয়া যায় না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, 'বড়জোর মুদি দোকানী হওয়া যায়।' নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে চাই মেধাবী শিক্ষক।

সুতরাং সময় এসেছে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের সনদ যাচাইয়ের। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা সনদ যাচাইয়ে যে সহযোগিতা করবেন না তা সহজেই অনুমেয়। কারণ সরিষার ভিতর ভূত। একাডেমিকসহ সকল সনদ যাচাইয়ের মাধ্যমে ওই ৬০ হাজার ভুয়া সনদধারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে নিবন্ধিত মেধাবীদের যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, তেমনি শিক্ষার্থীরাও পাবেন কাঙ্খিত শিক্ষা। বাস্তবায়ন সহজ হবে প্রত্যাশিত শিক্ষানীতি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh