জলবায়ু তহবিল বনাম সমরাস্ত্র, সুরক্ষার চেয়ে যুদ্ধে ব্যয় ২০ গুণ বেশি

অরুন্ধতী বসু

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২২, ১১:০২ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

চলতি বছরের এপ্রিলের শেষ এবং মে মাসের শুরুতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ভয়াবহ প্রভাবের সম্মুখীন হয় দক্ষিণ এশিয়া। এ অঞ্চলের বেশ কয়েকটি শহরে তাপমাত্রা পৌঁছে দাঁড়ায় ৫০ ডিগ্রির কাছাকাছি। উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ বিপজ্জনক বন্যা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এগুলোর জন্য মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দায়ী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক বাংলাদেশের সেলিমুল হক। জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক কার্যক্রমের সঙ্গেও  সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তার। সম্প্রতি সেলিমুল হকের চোখে পড়ে জাতিসংঘের অ্যাডাপটেশন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ম্যারিয়েন কার্লসেনের একটি টুইট। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতি নিয়ে আলোচনার বিষয়টি উত্থাপন করে কার্লসেন টুইটে লেখেন, এ সংক্রান্ত চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য আরও সময় প্রয়োজন। এর বিপরীতে সেলিমুল হক টুইট করে বলেন, সময় ফুরিয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। এর দরুন বিপর্যস্ত দরিদ্ররা। আলোচনা এখন আর এ খাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নয়। 

কার্লসেনের মন্তব্য আগামী নভেম্বরে মিশরের শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ২৭তম কনফারেন্স অব পার্টিস (সিওপি২৭) বৈঠকের ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ এজেন্ডায় চুক্তির ধীরগতির প্রক্রিয়ার আলোকে এসেছে। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত সিওপি১৫-এ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বার্ষিক অভিযোজন সহায়তা তহবিল গঠনে সম্মত হয়েছিল। 

এই তহবিলটি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোকে জ্বালানির উৎস পুনর্বীকরণ এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তার উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল। এই তহবিল বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয় ২০২০ সাল পর্যন্ত; কিন্তু ২০২১ সালের নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত সিওপি-২৬ বৈঠকের সময়ও উন্নত দেশগুলো তাদের এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি।

ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার আশ্বাস দিলেও সে অর্থে কোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিচ্ছে না। পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃত্বাধীন ধনী দেশগুলো কেবল অভিযোজনে অর্থায়নের বিষয়টিই প্রত্যাখ্যান করেনি, সেই সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে কিয়োটো প্রটোকলের মতো মূল চুক্তিগুলো। এ চুক্তিটি করা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। মার্কিন কংগ্রেস জলবায়ু সংকট প্রশমনে নেওয়া এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ অনুমোদনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে না ধনী দেশগুলোর কাছে। তারা অর্থায়ন করছে যুদ্ধে।

জার্মানির অর্থায়ন যুদ্ধে, জলবায়ুতে নয় : জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের সেক্রেটারিয়েটের আয়োজক জার্মানি। গত মাসে সিওপি২৭- এর সূচনা হিসেবে জার্মানির বন শহরে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর একটি সম্মেলন করে জাতিসংঘ। ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ নামে পরিচিত এজেন্ডায় অর্থায়ন নিয়ে নানা বাগ্বিতণ্ডার মধ্য দিয়ে সম্মেলনটির ইতি টানা হয়। সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ক্ষতিপূরণ নিয়ে আলোচনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। কানাডার ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্কের এডি পেরেযের ভাষ্য, ধনী দেশগুলো, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরা জীবাশ্ম জ্বালানি দ্বারা সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সামনের সারিতে থাকা মানুষ এবং সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টাকে অবরুদ্ধ, বিলম্ব ও দুর্বল করতে বন জলবায়ু সম্মেলনে এসেছিল।

জার্মানির মতো দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে দাবি করলেও আদতে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে না। এর পরিবর্তে জীবাশ্ম জ্বালানির উৎস হয়ে উঠছে এবং অভ্যন্তরীণ সামরিক খাতে তহবিল বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছে। একই সময়ে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হওয়া ঝড় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়ের সম্মুখীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সমর্থনে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জার্মান নির্বাচনের পর, গ্রিন পার্টির সঙ্গে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের নতুন জোট গ্রিন এজেন্ডা তুলে নেবে বলে আশা করা হয়েছিল সেনাবাহিনীর জন্য ১০০ বিলিয়ন ইউরো অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ। শীতল যুদ্ধ শেষের পর থেকে এটিই দেশের সামরিক খাতে সবচেয়ে বড় ব্যয় বৃদ্ধি। সেই সঙ্গে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশেরও বেশি সামরিক খাতে ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এর অর্থ দাঁড়ায়, সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ বেশি, জলবায়ু সংকট প্রশমন এবং সবুজ রূপান্তরের জন্য কম অর্থায়ন।

সেনা ও জলবায়ু বিপর্যয় : সামরিক খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থায়ন করছে পশ্চিমারা। তাদের এ পন্থা কেবল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না, উপরন্তু জলবায়ু বিপর্যয়কে উৎসাহিতও করছে। 

গ্রহের বৃহত্তম প্রাতিষ্ঠানিক দূষণকারী মার্কিন সেনাবাহিনী। বিশ্বজুড়ে দেশটিকে ৮০০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এর অর্থ, মার্কিন সামরিক বাহিনী দৈনিক ৩ লাখ ৯৫ হাজার ব্যারেল তেল ব্যবহার করে।

গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার অস্ত্রের জন্য ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। অস্ত্র বিষয়ক ব্যয়ে শীর্ষে রয়েছে ধনী দেশগুলো। এসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে শীর্ষ পর্যায়ে থাকলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেয়নি। যুদ্ধের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবেলা সংক্রান্ত তহবিল শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধে যেভাবে অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে, তা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিচ্ছে। জাতিসংঘের ‘হাঙ্গার হটস্পট’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ জলবায়ু পরিবর্তনের ৪৬ দেশের আরও ৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষকে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে  ফেলার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে উত্তর নাইজেরিয়া, মধ্য সাহেল, পূর্ব গণতান্ত্রিক কঙ্গো, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইয়েমেন এবং সিরিয়ায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার প্রধান উৎস ছিল সংঘাত ও সংঘটিত সহিংসতা। ইউক্রেনের যুদ্ধ কৃষিপণ্যের দাম বাড়িয়ে খাদ্য সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী গম বাণিজ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অবদান প্রায় ৩০ শতাংশ। সুতরাং ইউক্রেনের যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্তের সংখ্যা আরও বাড়বে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সংকট বিস্তৃত হবে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে। আফ্রিকা মহাদেশে ইতোমধ্যে একটি সিওপি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আরেকটি এই বছর অনুষ্ঠিত হবে। 

প্রথমে আইভরি কোস্টের অর্থনৈতিক শহর আবিদজানে মে মাসে মরুকরণ মোকাবেলায় জাতিসংঘের কনভেনশন আয়োজন হয়। পরবর্তী বৈঠক মিশরের শারম আল-শেখে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে এ মহাদেশের কিছু অংশে যে বিরাট ক্ষতি হয়েছে, তা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য এ সবই হলো প্রধান ফোরাম।

জলবায়ু পরিবর্তন ও যুদ্ধে অর্থায়ন নিয়ে সম্প্রতি এশিয়া টাইমসে এক নিবন্ধ লিখেছেন মুরাদ কুরেশি। লন্ডন অ্যাসেম্বলির সাবেক সদস্য এবং স্টপ দ্য ওয়ার  কোয়ালিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান চলতি বছরের সিওপি-২৭ সম্মেলন নিয়ে মোটেই আশবাদী নন। তিনি বলেছেন, বিশ্বের দেশগুলোর প্রতিনিধিরা যখন সিওপি২৭-এর জন্য নভেম্বরে শারম আল-শেখে মিলিত হবেন, তখন তারা পশ্চিমা প্রতিনিধিদের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে কথা বলতে শুনবেন। এরপর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার বিষয়ে সহমত পোষণ করে নানা প্রতিশ্রুতি দেবেন। সম্মেলনের কথা সম্মেলনেই শেষ। তারপর বিপর্যয় আরও বাড়িয়ে তোলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। জার্মানির বন শহরের প্রতিচ্ছবিই ফুটে উঠবে শারম আল-শেখে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh