গাজী তানজিয়া
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২২, ০১:৪২ পিএম
গাজী তানজিয়া
গত এক দশকে বাংলাদেশের নারীর পোশাকে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। তা যতটা না নারীর নিজের প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশি অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমল দিতে গিয়ে।
নারীর শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র যত বিস্তৃত হচ্ছে, নারীকে তার প্রয়োজনে যত বাইরে যেতে হচ্ছে, তত সে পোশাকের রাজনীতিতে আরও শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ছে। নারীর পোশাকের প্রতি এই কঠোরতা মধ্যবিত্ত সমাজে যতটা জোরালো, নিম্নবিত্তের ভেতরে ততটা না, পোশাক শ্রমিক ও অন্য নারী শ্রমিকদের পোশাকের দিকে নজর দিলেও তা দেখতে পাই।
তাহলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত নারীদের ক্ষেত্রে পোশাকের এই বাধ্যবাধকতা কিসের? কারণ কি একটাই যে এরা বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠছে, বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে ছাপিয়ে যাচ্ছে!
নারীর পোশাক কী হবে, তা কে নির্ধারণ করবে? উদার গণতন্ত্র বলে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নারীর। দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বের বহু সমাজে ও শাসনপ্রণালিতে পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্য এতই প্রবল যে, নারীরা নয়, তাদের পরিবার বা সমাজ, প্রায়ই রাষ্ট্রও তাদের হয়ে এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকে। আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানুষ নারীদের পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ স্থির করতে ব্যস্ত। সেই উদ্যোগ সচরাচর নারীর শরীর আবৃত রাখার উদ্যোগ। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, নারীশরীর আবৃত রাখা চলবে না, এমন বিধানও কিন্তু প্রকারান্তরে তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। মেয়েরা কী পরবেন, সেটা তারাই ঠিক করবেন। এর উপর নিশ্চয়ই কোনো কথা চলতে পারে না। তবে এ দেশে রাস্তাঘাটে মেয়েরা যে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হন সেখানেও এক শ্রেণির মানুষ তাদের পোশাককে দায়ী করতে শুরু করেন। ফলে মেয়েদের পোশাক নিজস্ব রুচি-পছন্দের বাইরেও অন্যের রুচির দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়।
নারীর কাছে ‘পররুচি’র অর্থ আসলে পুরুষের রুচি, যার ভিত্তিতে তাদের পরিধান নির্ধারিত হয়ে থাকে। পোশাকের স্বাধীনতার বা স্বাচ্ছন্দ্যের নামে মেয়েরা যা পরেন, পরতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, আজও তা সুকৌশলে পুরুষশাসিত সমাজই নির্ধারণ করে দেয়। ধর্ম, বর্ণ এবং শিষ্টাচার বিধান দিয়ে থাকে, কোন পোশাকে একটি নারী সমাজের লোকচক্ষুর সামনে এসে দাঁড়ালে তা হবে শোভন। এটি পোশাকের বাহুল্য, দৈর্ঘ্য বা স্বল্পতার প্রশ্ন নয়, যদিও দৈনন্দিন তর্কাতর্কি বিষয়টিকে ক্রমাগত সেই দিকেই ঠেলতে থাকে। নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে স্থান এবং কালবিশেষে সামাজিক নিয়মাবলি শালীনতার সীমানা বার বার নির্ধারণ করে দেয়, এবং মেয়েদের সেই নিয়ম মেনে নিয়ে নিজেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে হয়।
নারী কী ধরনের পোশাক পরবে এটা মূলত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে করপোরেট ওয়ার্ল্ডও ঠিক করে দেয়। ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে নির্ণয় করেন নারী কতটা কাপড় খুলবে, বা কতটা ঢাকবে। আমাদের দেশেও সম্প্রতি নারীর পোশাক ও সাজসজ্জা নিয়ে মোরাল পুলিশিং দেখা যাচ্ছে। এই পুলিশিংয়ে পুরুষের পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত নারীদেরও দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ নরসিংদী রেল স্টেশনের ঘটনা উল্লেখযাগ্য।
একুশ শতকের প্রথমার্ধে সারাবিশ্বে যখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রবল হয়ে উঠেছে, দেশে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদী সরকারগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে; তখনই নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক জোর-জবরদস্তির একটা রূপ সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। সে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে হোক বা উন্নয়শীল বা তৃতীয় বিশ্বে। প্রথম বিশ্বে নারীর হিজাব পরায় বাধা দেওয়া বা মুসলিমপ্রধান দেশে হিজাবে ঢাকতে বাধ্য করার প্রবণতার মধ্য দিয়ে পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। তবে পুরুষদের এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে যতটা না ধর্মীয় প্রভাব আছে, তার চেয়ে বেশি কাজ করে অর্থনৈতিক প্রভাব। অনেক সময় মনে হয়, গত কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের দেশে এত ব্যাপক হারে বোরকা হিজাবের প্রচলন কেন হলো? এর একটা কারণ হতে পারে, আমাদের দেশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি করে থাকে।
ওইসব ব্যক্তিগণ সেখানে গিয়ে যে সংস্কৃতি দেখেন সেটাকে প্রভুর সংস্কৃতি এবং গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। যেহেতু একটি পরিবারের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ওই ব্যক্তির হাতে সুতরাং ওই ব্যক্তির পছন্দ ও নির্দেশ অনুযায়ী তার পরিবারের নারীরা চলবেন এটাই স্বাভাবিক। এবং একই সঙ্গে তাদের অধস্তন আত্মীয়-স্বজনও ওই পোশাক ও আচরণকে অনুকরণীয় মনে করেন। তাছাড়া নারীর শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক অংশগ্রহণ ও সেখানে পুরুষের বিরূপ আচরণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার স্বার্থে আমাদের মতো দেশের নারী নিজেকে পর্দার আড়ালে ঢেকে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে শুধু পোশাক নারীকে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা কর্মক্ষেত্রে যে খুব একটা অনুকূল অবস্থান দিতে পারছে বা নিরাপত্তা দিতে পারছে এটা ভাবা ঠিক হবে না।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া যৌন নির্যাতন এর বড় প্রমাণ। যেখানে নির্যাতিত ছাত্রীটি তার বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও করা হয় এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এর আগে সিলেটেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যেখানে এক নববধূ তার স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গেলে কিছু ছাত্র তাকে ধর্ষণ করে। অর্থাৎ নারীকে দমনের প্রধান উপাদান হলো তার সম্ভ্রমের উপর আঘাত, দ্বিতীয়ত তার পোশাক। নারী নিপীড়নের আদিমতম পন্থা হলো, তার বস্ত্রহরণ। যা প্রকারান্তরে নারীকে দমনের এক সহজ প্রক্রিয়া পুরুষের জন্য।
দেশে ধর্ষণসহ যৌন হয়রানির কোনো ঘটনা ঘটলে আক্রান্ত নারীর পোশাক নিয়ে বিভিন্ন মহলের নানা মন্তব্য লক্ষ করা যায়। তবে নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণ হলো নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখার মানসিকতা। আগে বলা হতো নারীকে পণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে অনেকে নারীকে শুধু পণ্য নয়, ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখছে। এই ধরনের মানসিকতাই নারীর প্রতি সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে।
অনেক সময়ই যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর ‘নারীর পোশাক’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যতটা সরব আলোচনা হয়, নির্যাতক, নিপীড়ক বা ধর্ষকের বিচারের দাবিতে ততটা অবস্থান লক্ষ করা যায় না। যদিও নারীর পোশাকের সঙ্গে এসব ঘটনার সরাসরি কোনো সম্পর্ক থাকে না। তদুপরি নারীর আপাদমস্তক আবৃত পোশাককেও যে পুরুষতন্ত্র খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে তাও না। এই উপমহাদেশে অপমানজনকভাবে একটি খোঁচা মারা হয়। ছেলেরা যারা একটু লাজুক, একটু ভীতু, তুলনামূলকভাবে কম অগ্রসর তাদের পরিচিতজনরা ভর্ৎসনা করে বলে ‘তুমি ঘোমটা পরে বাসায় বসে থাকো।’
এই কথাটি যারা বলেন তারা ঘোমটা পরে বাসায় বসে থাকা নারীদের অত্যন্ত পরিশীলিত, ভদ্রতার স্কেলে সর্বোচ্চ নাম্বার দিয়ে সকল নারীকে সেই মানদণ্ডে বিচার করলেও ‘ঘোমটা’ বিষয়টি তাদের নিজেদের কাছেই অপমানজনক। যেন নারীদের অপমানিত থাকাই নিয়তি, তাদের টানটান মেরুদণ্ড, ঘোমটাবিহীন সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ব থাকতে নেই। টানটান ব্যক্তিত্ব, নির্লিপ্ততা, রক্ষাকবচ বা অভিভাবক হওয়ার অধিকার যখন একজন নারী আয়ত্ত করেন, তখন তাকে হেয় করার জন্য বা তার অগ্রযাত্রায় বাধা দেওয়ার জন্য তার পোশাকটাই থাকে প্রথম লক্ষ্যবস্তু। পরিস্থিতি ভেদে একে খুলে দিতে বা আরও আবৃত করাতেই যেন পুরুষতন্ত্রের বিজয় নিহিত।
লেখক: কথাসাহিত্যিক