কবিতার কবি আবুল হাসান

শহীদ ইকবাল

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২২, ০২:৫৭ পিএম

কবিতার কবি আবুল হাসান- শহীদ ইকবাল

কবিতার কবি আবুল হাসান- শহীদ ইকবাল

আমাদের কবিতায় ‘কবিতার প্রথম শহীদ’ আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫)। কবিতা ছিল যার অচিকিৎস্য অসুখ। ১৯৬৫-১৯৭৫ পর্যন্ত আবুল হাসান সাংবাদিক ও লেখকরূপে ঢাকায় বসবাস করেন। তখন কবিখ্যাতি তার কবিসমাজের (শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ প্রমুখ) নজরে আসে। 

আবুল হাসান স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিক রূপরীতির রচয়িতাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। শামসুর রাহমান বলেন : ‘এই কবির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কবিতায় ভরপুর ছিল। যেন হাওয়ায়, ধুলোয়, গাছের পাতায়, পাখির ডানায়, নদীর জলে, দিনের কোলাহলে, রাত্রির নিস্তব্ধতায় তিনি কবিতা পেয়ে যেতেন।’ [ভূমিকাংশ : আবুল হাসান রচনাসমগ্র (১৯৯৪)] তাঁর কবিতায় আত্মপ্রেম, নৈঃসঙ্গ্যবোধ, বিচ্ছিন্নতা কিংবা স্মৃতিকাতর বেদনার্ত আত্মা দিব্যত্ব অর্জন করে। কবিতাশরীরে অন্তহীন স্বপ্নচারিতা প্রবিষ্ট। আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন : ‘ওর কবিতা লেখার ধরণটি ছিলো অনেকটা স্বভাবকবিদের মতো : প্রাকৃতিক, স্বসমুত্থ, অনির্বাচিত।’ স্বপ্নকাতরতায় মগ্ন কবিমন বাউল-বীক্ষণে প্রকাশিত, “পাখি হয়ে যায় প্রাণ” :

দূরে বসে প্রবাহের অন্তর্গত আমি, তাই নিজেরই অচেনা নিজে

কেবল দিব্যতাদুষ্ট শোনিতের ভারা ভারা স্বপ্ন বোঝাই মাঠে দেখি,

সেখানেও বসে আছে বৃক্ষের মতোন একা একজন লোক,

যাকে ঘিরে বিশজন দেবদূত গাইছে কেবলি

শতজীবনের শত কুহেলী ও কুয়াশার গান!

পাখি হয়ে যায় প্রাণ ঐ কুহেলী মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত! 

“আবুল হাসান” নামটি নিয়ে রচনাসমগ্র (প্র.প্র. ১৯৯৪) তে তাঁর প্রথম কবিতা, কাব্যের নাম রাজা যায় রাজা আসে(ডিসেম্বর ১৯৭২)। ভূমিকাটি শামসুর রাহমানের। উপর্যুক্ত পংক্তিমালায় বৃক্ষ=একা একজন লোক, দেখেন কবি নিজেই (‘আমি’) যিনি প্রশ্নশীল এবং ‘অনিচ্ছুক দাস’। যেখানে ভালোবাসা খুব কাক্সিক্ষত কিন্তু তা অনেক দূর। কবির সময়খণ্ডে দৃঢ় অপরূপ সুন্দর, শুভপ্রদ। কবিতার-কাঠামোতে তা কালোত্তীর্ণ, পেরোয় শতজীবন কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজপ্রবাহে সে ‘নিম্নমানের মানুষ’। যে সময়ে আবুল হাসান সমাজ-মানুষের কাছাকাছি, তখন বাবা হয়ে গেছেন ব্যর্থ মানুষ, এ মধ্যবিত্ত পরিবারের নিজে নিরুদ্দিষ্ট বড় ভাইয়ের মতো, আর দীর্ঘশ্বাসের সিদ্ধান্তে ‘মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম/ পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলোনা!’

এ অর্থে আবুল হাসান প্রভূতরূপে ঘন সুন্দর নিরঙ্কুশ সত্যে দাঁড়াতে চান। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রসংঘ, রাজনীতিক প্রতিহত হয়ে চলে বৃষ্টিতে, দুঃখময়ী মাতৃভাষায়, প্রিয়ার চুম্বনে, মায়ের বাগানে, চামেলীর গন্ধে। রাজা যায় রাজা আসে কাব্যে সিদ্ধান্ত আসে “শান্তিকল্যাণ”-এর, ঠিক হয়ে যায় “নিঃসন্দেহ গন্তব্য”-র দিকচিহ্ন। এ কাব্যে প্রেমিক কবি, নৈঃসঙ্গ্য-পীড়িত-ক্লান্ত-দীর্ণ (“ক্লান্ত কিশোর তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়”)। কবিভাষাটি আবেগময়। 

কিন্তু নিজের দার্শনিক দৃঢ়তা অর্জিত, ব্যক্তিত্বমগ্ন। পূর্বজের প্রভাব মেলে, ষাটে পাশ্চাত্যচিন্তার ধারা স্থিত হয়ে যাচ্ছিল- সেটি এদেশের নির্মল প্রকৃতিতে এক ধরনের বাস্তবতার ভেতর দিয়েই গ্রহণ হতে থাকে, আবুল হাসান নিকট বন্ধুদের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠলেও নিজ পথে স্বচিন্তা ধারণ করে এগুতে থাকেন। শহীদ কাদরীকে উৎসর্গিত কবিতা “গাছগুলো”, রফিক আজাদকে “অগ্নি দহন বুনো দহন”, আবদুল মান্নান সৈয়দকে “শিকড়ে টান পড়তেই”  আর নির্মলেন্দুর হাতে যে তুমি হরণ করো দিয়ে দিলেন কিন্তু নিজ শক্তিটুকুতে যে অনন্য তা বুঝিয়ে দেন। ‘সর্বৈব মন্বন্তরের মধ্যে বসেও আবুল হাসান, ষাটের দশকের সবচেয়ে স্বপ্নপীড়িত কবি, স্বপ্ন দেখেছেন পূর্ণতার, পরিতৃপ্তির, স্বাস্থ্যের ও সম্পন্নতার। এ এক দুর্লভ ক্ষমতা, যে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত ছিলেন ষাটের অনেক কবি। (আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ) 

যে তুমি হরণ করো (এপ্রিল ১৯৭৪) কাব্যে আবেগ সংলগ্ন মেধায় আরও নান্দনিক, কবিভাষা নির্মিত। অভিজ্ঞতা প্রাচুর্যময় আত্মপ্রেম যুক্ত দেশপ্রেমে, রিল্কীয় রক্তক্ষরণের প্রাবল্য-মিশ্রিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মারী-মন্বন্তর অতিক্রমী পথভ্রষ্ট মানুষ-শেষপর্যন্ত জয়ীই সে:

উদিত দুঃখের দেশ তাই বলি হে কবিতা, দুধভাত তুমি ফিরে এসো,

সূর্য হোক শিশিরের ভোর, মাতৃস্তন্য হোক শিশুর শহর!...

এইভাবে নতজানু হতে চাই ফলভারনত বৃক্ষের শস্যের শোভায় দিনভর

তোমার ভেতর ফের বালকের মতো ঢের অতীতের হাওয়া

খেয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চাই।

এর ভেতরে বিচ্ছিন্ন নয় ব্যক্তিসত্তা, বেড়ে ওঠে তাপিত বিষণ্নতা, অমোঘ অনুতাপ। কবির শব্দ-প্রতীক-উপমানচিত্র অধ্যাত্ম বিষণ্ন আভায় সৌকর্যমণ্ডিত। “কবির ভাসমান মৃতদেহ”, “কুরুক্ষেত্র আলাপ”, “গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর”, “নিঃসঙ্গতা”, “নির্বিকার মানুষ”, “ভুবন ডাঙায় যাবো” কাব্যের আকর্ষণীয় কবিতাগুলোর অন্যতম। তীক্ষè প্রতীকী আর দার্শনিক অভিপ্রেত পংক্তি ‘একটি ভিক্ষুক হাসতে থাকবে ভিক্ষুনীর অর্ধকোল জুড়ে’, ‘দেখেছি দুঃখের চেয়ে সুখ আরো বেশী দুঃখময়’। তবে এ কাব্যে নারী-‘প্রণয়’ অপরূপ মাত্রা লাভ করেছে। ‘আমি’-‘তুমি’র পৌরাণিক আক্ষেপ-আস্বাদ চিরতরে ব্যঞ্জনা লাভ করে। কবি প্রেম-ব্যবচ্ছেদ বয়ে এনেছে কষ্টকাতরতা, অকৃত্রিম জন্ম-সৃষ্টির ভ্রমণময় অরূপ আলাপন, অশরীরী আদ্যোপান্ত জীবনরেখার ভেতরের ক্লান্তিধ্বনি। এরূপ আখ্যানের অবচেতন দ্বন্দ্বময় প্রকাশরূপ আবুল হাসানে উন্নত মানের স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। এ প্রত্যাদেশে আনন্দের বৈপরীত্য থাকলেও তা নির্মল-শান্ত সুখকর, কারণ কেন্দ্রের সৃজন তো নারীর-যা বসুন্ধরাময় এবং ততোধিক যৌবনময় :

(ক) আর ঐ যে অমৃত ঝর্ণা, ওকে কারা বুকে এনে অতটা স্বর্গীয় শব্দে

     স্রোতস্বিনী ডাকে!         

(খ) আজো শীতরাতে তুমি কুয়াশায় ক্ষুধিত চাঁদের মতো বাঁকা কটিদেশ,

     হায় তুমি, হায় অবিরাম রাতে ভেসে আসা উষ্ণ ছিপ নৌকা আমার!

কবির এ নির্ভার কথন, কল্পোক্তির অনুধ্যান নিশ্চিত করে মধ্যবিত্ত সত্তার ‘অন্ধকার’ অবয়বটি। সে লক্ষ্যে উপমান চিত্র উপমেয়, রূপকল্প, ইমেজ ইঙ্গিত পরিস্রুত হতে থাকে। যৌনতা আর জীবন রঙ অভিন্ন, অবসাদ-ক্লান্তি আর আনন্দও অভ্রান্ত, কিন্তু প্রশ্ন এ ব্যক্তির জীবন এমন কেন? এর শেষ ঠিকানাই বা কি? যে অকৃত্রিম প্রকৃতি ও নিসর্গে তার জন্ম, জন্মের পরে হারাতে বসে মাতৃকোল-বাগান-বাবা-ভাই পরে উত্তীর্ণ বয়সে প্রেমিকা, প্রেম আর অসুখময় সুখ। সেখানে সমাজ-রাষ্ট্র আরও বিঁধে দেয় নানারকম কষ্টতিলক। মুক্তি কী? কবির চিহ্নিত সময়ে কবিভাষার এ রূপরেখাটি আরও ঊর্ধ্বগামী হয়ে পড়ে পৃথক পালঙ্ক (অক্টোবর ১৯৭৫)-এ এসে। ‘হাসানের বই-এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও নতুন, চমকপ্রদ ও তাৎপর্যময় নাম পৃথক পালঙ্ক, হয়তো প্রকৃতিই নির্বাচন ক’রে দিয়েছিলো, জীবনের শেষ দিনগুলো দ্রুত যখন ফুরিয়ে আসছিলো তখন পৃথক এক পালঙ্কের ভাবনা হয়তো তাঁর মাথার ভিতর অবধারিতভাবেই জেগে উঠেছিলো।’ (‘গণসাহিত্য’, ৪র্থ বর্ষ, জানুয়ারী ১৯৭৬) কবিতায় ‘উপনিষদ’ হয় উপলক্ষ। ‘মধ্যরাতে ঝাউকান্না কেঁদে বলে, শান্তি হোক, ওরে শান্তি হোক’-শান্তির বারতা শিল্পিত হয়ে ওঠে। মৃত্যুঞ্জয় রূপ পরিগৃহীত  “নচিকেতা”য় :

মারী ও বন্যায় যার মৃত্যু হয় হোক। আমি মরি নাই- শোনো

লেবুর কুঞ্জের শস্যে সংগৃহীত লেবুর আত্মার জিভে জিভ রেখে

শিশু যে আস্বাদ তারে নারী যে গভীর স্বাদ

সংগোপন শিহরণ পায়- আমি তাই।   

শ্রেষ্ঠ এ কাব্যটিতে যেন পূর্ণতা আসে কবির। সিম্ফোনিতে পূর্ণ প্রশান্তময়, বৃক্ষ-পক্ষী আবার ফিরে আসে-তবে তা পুরনো অর্থে নয়, শ্রেয়ো-তাড়নায়। সৌম্য তার রূপ। জেগে ওঠার প্রত্যয়। উঁচু মাপে ব্যাপক মহাজাগতিক অভীক্ষাটির উদ্ভাসন ঘটে :

শুধু এই নষ্ট জমি তোমাতে তোলেনা ধর্ম,

শস্যক্ষেত, বৃক্ষভূমি, মাটি ও মৃত্তিকা আজ

মরিতেছে অবক্ষয়ে ঘুণ ধরিতেছে।

অথবা, 

বৃষ্টির ফোঁটাকে মনে হয় তোমার পায়ের পাতার শব্দ,

পাতার শব্দকে মনে হয় তোমার গাড়ীর আওয়াজ;

আমি চক্ষু সজাগ করি, কান উৎকর্ণ, ইন্দ্রিয় অটুট,

তুমি আসছো না, তুমি আসছো না

তোমার কত হাজার বছর লাগবে আসতে?

এমন শব্দ-নির্বাচন, নতুন উপমা ও অভিনব চিত্রকল্প নির্মাণে দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে। নিজের অন্তর্গত চেতনালোকে নির্বাসিত হন তিনি। সেখানে কীর্তিত হন ‘ভেজা মাটির বৃষ্টিতে’ কিংবা ‘পারদমাখা শয্যা’য়। এসবের ভেতরেই জীবন-মৃত্যুর বিপরীতাত্মক প্রান্তকে মেলে ধরতে চান কবি। 

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-সম্বলিত এ কবিতায় কবি মৃত্যু-পংক্তির রূপময় পরিবেশ রচনা করেন। বিষণ্নতায় হন দগ্ধ। মৃত্যুচেতনা বিদ্যমান প্রকৃতিরাজিতে স্থির কম্পমান। পৃথক পালঙ্ক সে ক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ। ত্রিশোত্তর কবিদের প্রভাব হলেও তা হাসানের হাতে অন্য। একটি আলোকিত কবিভাষা এক্ষেত্রে নির্মিত হতে দেখা যায়। কবিকণ্ঠটি পরিষ্কার। আগেই এ কাব্যের প্রথম কবিতা “নচিকেতা”র উদাহরণ এসেছে। তাতে ঘোষিত কবিস্বর। বিনষ্ট বা গলিত জীবনের আরোপিত ক্রন্দনে কাতর নন কিংবা পাশ্চাত্য স্বভাবে জাঁ আর্তুর র্যাঁবো (JeanArthur Rimbaud) বা লোরকা’র অনুভাবের প্রত্যক্ষ প্রেরণাবন্দি নন। যদিও বলতে শোনা যায় ‘লোরকার বিষণ্ন জন্ম’র কথা। কিন্তু তা ব্যক্তি-পরে দেশের পটচিত্রে, পরিস্রুত বাঙালির ভঙ্গুর পীড়িত সমাজ-কাঠামোয়। আগের কাব্যে যেটি স্পষ্ট নামে প্রকাশিত “গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর”, “কবির ভাসমান মৃতদেহ”, “আমি অনেক কষ্টে আছি”। বিষণ্নতা ব্যাপক চিত্রে প্রতিফলিত। উপর্যুক্ত উদাহরণটির মতো অনেক পংক্তিতে তা আইকনে পরিণত। সার্বভৌম এ আনুষ্ঠানিকতাটি পূর্বজ অনেক কবি লালন করলেও গভীর অনুভবের চর্চায় বা বিচিত্র বিষয়বস্তুর ভেতর দিয়ে [মৃত্যু, রোগ, নারীর জৈববস্তু (স্তন, যোনী, জরায়ু), মহামারী, মন্বন্তর] তাকে আধারবন্দী করা অত্যন্ত নতুন। এটি প্রকৃতির বিচিত্র রঙে (বৃষ্টি, বৃক্ষ, নদী, পক্ষী) ব্যাপক। কবির টোটেমব্রতও যেন এ ধর্মটিকে অনেক প্রসারিত করে, যাতে মনুষ্যত্ব-মানবিক সারাৎসার রীতিমাফিক তার আদর্শে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। একই সঙ্গে নারীর সত্তাগত সম্ভাবনা ও অধিকার চেতনাও অপরিস্ফুট নয়। তাবৎ মহিমার প্রকৃতি কাব্য-প্রকরণ ধারণ করলে আবুল হাসান নিজের ভেতরে নির্মাণ-পুলকে বা নবায়িত সৃষ্টিতে পৌঁছুলে তার প্রতাপটুকু বিস্ময়কর বলে স্বীকার করার কিছু থাকে না। কারণ, এ পথের বাঁকে এবার তার নব-প্রতিভার স্তর কায়েম হয়েছে, তার প্রকাশ উদিষ্ট পৃথক পালঙ্ক। 

এ কাব্যের প্রবণতা আত্ম-উৎসারণ। রোগশয্যা, স্মৃতিচিহ্ন, অসুখ, নরকের আগুন, রুগ্নতা, হাসপাতাল, মৃত্যু, এপিটাফ-এর ভেতর থেকে পুরাণের পাখির মতো জেগে ওঠা। আত্মার এ জাগর-আখ্যান চিরজয়ী, মৃত্যুঞ্জয়ী, জয়শ্রী। ‘আমার অনলে আজ জাগো তবে হে জীবন, জয়শ্রী জীবন!’, ‘মধ্যরাতে ঝাউকান্না কেঁদে বলে, শান্তি হোক, ওরে শান্তি হোক!’, ‘সমস্ত শান্তি ভেঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে মানুষের মনীষার শেষ বৈনাশিকে!’- এভাবে আত্মাকে অনলে পুড়িয়ে, ‘শান্তি’-র চিরজীবিত শিল্পকাঠামো রচনা করেন। 

এতে প্রকরণবৈশিষ্ট্যও নিরূপিত হয়। পুনরুদ্ধার বা রিভাইভ অনেকটা যীশু-পুরাণে-উপনিষদে প্রজ্বলিত। এ প্রজ্বলনের পথ জাগতিক সকল প্রাণীর শুভপ্রেরণায়। কিন্তু সেটি উজ্জীবিত হওয়ার সরণী সমাজ-বিধৃত অভাব, দুঃখ, বেদনা, গ্লানির ভেতর দিয়ে। কবি দুঃখ-বেদনারও কাব্যময় প্রসিদ্ধি নির্মাণ করেন। স্মৃতিসৌধে বা উদ্ধত-ভীতিকর প্রাণীবাচক বিশেষায়ণে তার শিল্পিত রূপ-কাঠামো রচনা করেন। বাংলার প্রকৃতিতে কিংবা বিধৃত বিবর্তিত সমাজ ও জীবনচেতনায় তার পুনর্বয়ন লাভ ঘটে। সমাজের উপরকাঠামোয় প্রকাশিত যে স্তর তার কারণ হিসেবে ভেতরের কাঠামো ও কার্যকারণ সম্পর্ক, কর্পোরেট বা মার্কেন্টাইল বাণিজ্যের শাসনে নিপতিত ব্যক্তি, যে জন্মেই কুঁকড়ে গেছে, ব্যথাদীর্ণ ক্ষয়িষ্ণু মন ও মনন, প্রেমবিনাশী ও দুর্বিনীত দ্বন্দ্বে সৃষ্ট ক্ষত আর দুঃখচিহ্নিত প্রহরের গরল নিয়ে তবুও জয়ী জীবিতের শান্ত-সন্ধান প্রচেষ্টায় রত কবির উপলব্ধ প্রকরণ। ছন্দও সে লক্ষ্যেই সচেষ্ট। 

এ শান্তির ইমেজ রূঢ়-বিদ্রƒপাত্মক-বিকৃত-কঠোর কিন্তু শেষাবধি উপনীত শান্তি পারাবারে। তৃতীয় এ কাব্যটিতে পূর্বের কাব্যচিন্তনের সরণী বেয়ে কবি পৌঁছেছেন দুর্লভ শান্তি পারাবারে। যেখানে নিজস্ব রূপ-ধারণাটি পূর্ণ ও জীবনজয়ী মানুষের সারাৎসাররূপে চিহ্নিত। বিভাগোত্তর কাব্যভাবনায় এর স্বরূপ পার্থিবতার ভেতর দিয়ে লোকোত্তর বিশেষত্ব লাভ করতে সক্ষম হয়। ‘মৃত’ মানুষের পুনরুত্থানে যে নবজন্ম তা বৃষ্টি, নদী, সমুদ্র, রৌদ্র কিংবা গোলাপ, কোমল হরিণ রূপকে প্রকাশিত। এ রূপকার্থ কবি-উক্তিতে লোকোত্তররূপে পরিগণিত নিম্নোক্ত দৃষ্টান্তে :

(ক) আমাকে শোনাতে হবে সেই কবেকার এক সত্যমাথুর :

প্রবাহ নদীর প্রাণ,-নাবিকের দল ফিরে এসো,

আমার দু’পাশে আজ মরা ঢেউ, অভিভূত অন্য বন্দর!

(খ) এ বৃষ্টি কি নবজন্ম?

কিছুই জানিনা শুধু অক্সিজেনের নল নাকে নিয়ে বসে থাকি জাগাতুর!

আর শব্দে টের  পাই : একলক্ষ জিরাফ, হলুদ সাপ, সিংহের সবুজ দল

সমস্ত জীবন ভেঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে আমার ভিতরে!

(গ) দেরী হয়ে গেছে বৃক্ষ : পায়ে ধরি :জ্জবলো

আমার ক্ষয়িষ্ণু জমি, কোন মহাদেশে গেলে

ফিরে পাবে সুরেলা সবুজ?

উপর্যুক্ত দৃষ্টান্তে পুনরুজ্জীবন ঘোষিত হয় কোন্ মূল্যবোধে? সত্যমাথুর আবুল হাসান পাপ ও পবিত্রতাকে জৈবিক সত্যসন্ধে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে পুরা-ইতিহাস-পুরাণ মিথস্ক্রিয়ায় সামগ্রিক বিষয়কে রূপময় সৌন্দর্যে ভূষিত করেন। সেখানে সৌন্দর্য কামগন্ধভারাতুর, ললিতলোভনকান্তি :

সৃষ্টি এত সৌন্দর্যপ্রধান! সৌন্দর্য এমন ভীরু এমন কুৎসিত!

সাপ, খেলনা, নর্তকী, নদী ও নারী

অপাপবিদ্ধতায় স্বর্গ-নরকের পৌরাণিক বিশ্বাস কিংবা সমাজসাপেক্ষ বেশ্যালয়, ঘোলামদ, অশ্লীলতা ক্ষ্যাপা দূর্বাশার ক্ষেদে পুড়িয়ে ফেলেন। নৈর্ব্যক্তিক চিন্তনে জগতের  বৈভবকে এক ধরনের পার্থিবতা দেন, তার ভেতরেই তুমুল হয়ে ওঠে অপার্থিব আকুলতা। যেটি সময় ও সমাজ-নিরপেক্ষ হয়েই চিরন্তনতা লাভ করে। মরমী বা আধ্যাত্মিক অবিনাশী রূপে যাবতীয় কুৎসিত-কণ্টককে হরণ করে। রচনা করে সেই মর্মজ্ঞান- যা একমাত্র ও অনিঃশেষরূপে মানুষেই সর্বশেষরূপে পরিগণিত। এভাবেই আবুল হাসান স্বীয় আখরে সুপ্রতিষ্ঠিত হন আমাদের কবিতায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh