আবুল হাসানের অসহায় এলাকা

জাকির তালুকদার

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২২, ০৪:৪৫ পিএম

আবুল হাসানের অসহায় এলাকা- জাকির তালুকদার

আবুল হাসানের অসহায় এলাকা- জাকির তালুকদার

প্রাচ্যের যৌথপরিবার পশ্চিমের বিস্ময় উদ্রেক করে। এই যৌথতার মধ্যে পশ্চিমী মনীষীরা অনেক ক্ষেত্রে খুঁজে পান মানুষের আদি যুথবদ্ধতার চিহ্ন। যা আসলে গোত্রেরই সংক্ষিপ্ত একক। তাদের কাছে এই যৌথপরিবার পরিগণিত হয় ছায়াঘেরা-মায়াভরা, স্নেহ ও সম্মানের পারস্পরিক প্রবাহমণ্ডিত এক স্বর্গীয় একক হিসেবে। কিন্তু ধাবমান রেলগাড়ির জানালা পথে দেখা বাংলার গ্রামের মতো উপরোক্ত যৌথ পরিবারের ছবিও যথেষ্টই প্রতারক। এর ভেতরে ঢুকলে দেখা যায়, এই যৌথ পরিবার মূলত একব্যক্তিকেন্দ্রিক। একজন ব্যক্তিই সচরাচর একটি যৌথ পরিবারের প্রধান। গোত্রপতির মতোই তিনি সচরাচর  লাভ করেন অন্য সদস্যদের আনুগত্য। কিন্তু এর উল্টোপিঠে আছে ঐ তথাকথিত প্রধান ব্যক্তির নিরন্তর ক্ষয়ে যাওয়ার বাস্তবতা। কেননা সচরাচর দেখা যায়, ঐ একজন ব্যক্তিই মাত্র ঐ পরিবারের উপার্জনকারী। বাকিরা তার উপার্জনের নিশ্চেষ্ট অন্নভোগী। ঐ একজন ব্যক্তিকে নিরন্তর পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করতে হয়, সম্পদ সৃষ্টি করতে হয়। দায়িত্বের বোঝা তার হালকা করার কেউ নেই। এর ফলে ঐ ব্যক্তি হারিয়ে বসেন তার সৃজনশীলতা। জীবনের সমস্ত রূপ-মাধুর্য মরে যায় তার দৈনন্দিনতা থেকে। তার জীবন পরিণত হয়ে পড়ে নিরন্তর বোঝা টানার এক ক্ষমাহীন ভারবাহী জীবনে। তার জীবনীশক্তি ক্ষয়ে যায় সময়ের চেয়ে দ্রুততায়, তার উদ্যম ও সৃজনশীলতা বলি হয়ে যায় নিষ্করুণ বাস্তবতার যূপকাষ্ঠে, তার অবসর পরিণত হয় অর্থচিন্তার গোলকধাঁধাঁয়। তারপরে একদিন তিনি যখন নিঃশেষিত হয়ে যান, তখন দেখা যায় তার পরিবারে তার সম্মানের চেয়ার সকলে তার অজান্তে সরিয়ে নিয়েছে তার পেছন থেকে। যেহেতু তার সমস্ত উদ্যম, সমস্ত উপার্জন ব্যয়িত হয়েছে  অন্যের পিছনে, তাই তার বৃদ্ধত্বের সঞ্চয় বলতে কিছু থাকে না। ফলে তিনিও পরিণত হয়ে যান পরিবারের বোঝাতে । তখন তিনি কোনো ক্ষমা পান না। সমীহ তো দূরের কথা। তার প্রৌঢ়ত্বের অক্ষমতার সময় অন্যরা তার যৌবনের ভারবহনের কথা বেমালুম ভুলে যায়। তাই আমাদের সমাজে প্রৌঢ়ত্বে প্রবেশ করা মানেই এক অসহায় এলাকায় প্রবেশ করা। 

আমরা আবুল হাসানকে দেখি এমন এক নিষ্করুন বাস্তবতার ছবি আঁকতে। তাঁর গল্পের শিরোনামটিও ‘অসহায় এলাকা’। যদিও কবির কুহকী গদ্য এই গল্পটির সমস্ত দেহে একটি বিষাদের আবহ লেপ্টে দিয়েছে, যাতে পাঠকের কাছে এটিকে রোমান্টিক বিষাদের গল্প বলেও প্রতিভাত হবে। আবুল হাসানের দূর্বলতা  বা সবলতা যাই ই বলা হোক না কেন, এটাই হচ্ছে তাঁর অমোচ্য বৈশিষ্ট্য। 

গল্পে আমরা পাই একজন ‘তিনি'কে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত। পেনশন পাবার পরেও বেশ কিছুদিন সংসারে নিজেকে অপাঙক্তেয় ভাবেননি তিনি। প্রতি মাসের পয়লা তারিখে ন্যাপথলিন দেয়া পুরনো চামড়ার স্যুটকেস থেকে সযত্ন সতর্কতার সাথে ইস্ত্রি করা পাজামা-পাঞ্জাবি বের করে তিনি শহরে যেতেন পেনশন তুলতে। সেদিন সকালে স্ত্রী আমেনা নতুন পাতিলে দুটো কাঁচকলা সেদ্ধ বসিয়ে, উঠোনের মরিচ গাছ থেকে দু-তিনটি মরিচ তুলে ভাত রেঁধে দিতেনÑ গরম ভাতের সুগন্ধের সঙ্গে মাসের সেই একটি দিন অন্তত স্ত্রীর চিকন মায়াবী ডাক শোনা যেত। যুবতী থাকাকালীন যেভাবে তার কন্ঠ ঝংকৃত হতো, সেইভাবে মমতা ও প্রেমের সঙ্গে স্ত্রী তাকে ডাকতেন- ‘খেতে এসো’!

কিন্তু মাসের সেই একদিনের জীবন-সুগন্ধও তার হাতছাড়া হয়ে গেল। যেদিন থেকে মেজো ছেলে সংসার তদারকির ভার নিল এবং সঙ্গে সঙ্গে শহর থেকে পেনশন তোলার প্রতিনিধিত্বও অর্জন করে ফেলল।

সেদিন থেকে পুরোপুরি বাড়তি। নিজের চোখে এবং অন্যদের চোখেও। তারপর থেকে শুরু হয় তার অন্তর্মুখী জীবন। আর তখন থেকেই যেন কবি আবুল হাসান পুরোপুরি প্রবিষ্ট হয়ে যান গল্পের ’তিনি’ সত্তায়। তাঁর প্রতিটি কার্যক্রম এবং অনুভূতি হয়ে ওঠে সংবেদনশীলতার  চূড়ান্ত স্তর। আমরা জানি, চরিত্রের মধ্যে লেখকের এই যে প্রবিষ্ট হয়ে যাওয়া, তা আসলে শিল্পেরই প্রবেশন। লেখক ও তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের নিষিক্তিই শিল্পমাত্রার সঠিক নির্দেশক। আমরা দেখি প্রাক-উনত্রিশ আবুল হাসান প্রবিষ্ট হয়ে যান ষাটোর্ধ্ব ‘তিনি’র জীবনে। ফলে সেই ব্যক্তির জীবন আর নিছক জীবন থাকে না, হয়ে ওঠে সংবেদনশীলতার সারাৎসার। 

সংসারে অপাঙক্তেয় মানুষ বিকল্প আশ্রয় খোঁজে।  এক্ষেত্রে তার আশ্রয় হয় বাগানের কয়েকটি সবজি-গাছে জলসিঞ্চন, পাঁচ ওয়াক্তে প্রার্থনা আর মনোযোগী কোরআন তেলাওয়াত। কিন্তু সেসব কি তার বিকল্প আশ্রয় হতে পারে?

পারে যে না তার প্রমাণ তার জীবন, তেমনই গল্পের সর্বত্রই পাওয়া যায়। ‘তিনি একা একা গোপনে অযৌক্তিকতাবোধে ক্ষুণ্ন হন।’ বর্তমানের নিরানন্দ বাস্তবতা ছাপিয়ে অতীতে ফিরে যাওয়ার নাছোড়, ব্যর্থ চেষ্টায় তিনি বারংবার রক্তাক্ত হতে থাকেন। তার প্রৌঢ়া স্ত্রীর কাছে তিনি এখন বাহুল্য হয়ে গেছেন, একথা মেনে নিতে তার কষ্ট হয়। স্ত্রীর এই কঠোর-ভর্ৎসনাময় রূপকে তিনি কিছুতেই মেলাতে পারেন না অতীতের সাথে। উল্টো প্রায়সই  তিনি মানসচক্ষে দেখতে পান, কোলকাতার চাকরি জীবনের প্রথম পাদে, শুকিয়া স্ট্রিটের একটি দু’কামরাঅলা দালানের ভিতর একটি নিরাভরণ চৌকির ধবধবে সাদা চাদরের ওপর গ্রামীণ সম্ভ্রান্ত বংশের যুবতী এক কন্যাকে। যার শরীরে বিবাহের অলংকার ধবধব করছে। যার উচ্চতা নাতিদীর্ঘ। পেলব শরীরের শয়নভঙ্গিটি সাদা চাদরের শুভ্রতার ভিতর একেবারেই যেন মানিয়ে গেছে। কানে একছড়া ওয়াসেল মোল্লার দোকানের হাল্কা দুল। লজ্জা মাখানো চিবুকে তার স্বর্ণাভা দুলে দুলে উঠতেই সারা ঘরে একটা অপার্থিব সূর্যাস্ত নেমে এসেছে। 

কিন্তু এখন?

স্ত্রী-র রূপ সম্পূর্ণ উল্টো। হয়তো এটাই সংসারের ধর্ম, নিম্ন-মধ্যবিত্তের নিয়তি। কিন্তু তিনি তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। তার যৌবনের বাসন্তী রাত্রিতে যে যুবতীটি এত সুষমাময়ী ছিল, নির্লোভাতুরা নিঃশর্তভাবে নেপথ্যচারিণী, সেই যুবতীটি, মাত্র তিনটি সন্তানের মাতা হওয়ার পরে এরকম ঘোর সংসারী হয়ে উঠছে, এটা তার কাছে বেখাপ্পা লাগে। জীবনের কোনো অংকের সাথে নারীর এই লোভ-নির্লোভের অংশ তিনি মেলাতে পারেন না। 

একদিকে সুসময় হারানোর বেদনা। আরেকদিকে বর্তমান বাস্তবতা মেনে নিতে না পারার কষ্ট। এই দুয়ে মিলে তাকে শাঁখ করাতের মতো কেটে চলে। নিঃশব্দ অথচ নিরন্তর রক্তপাতে তিনি ক্ষয়িত হতে থাকেন। কিন্তু সহ্য করা ছাড়া তার অন্য কোন উপায় থাকে না। ‘ঝিনুক নীরবে সহো!’ 

কিন্তু তার পরেও মানুষ অপ্রতিরোধ্য। গল্পের শেষাংশে দেখা যায় অবোধ বিক্রমে জেগে উঠতে চাইছেন ‘তিনি’। লেখকের ভাষায়Ñ কি জানি কেন তিনিও আজ হঠাৎ তাঁর যৌবনের কিছু উদ্বৃত্ত বাসনায় নিজেকে পড়ন্ত পৌরুষ ফিরিয়ে দিলেন। দোকান থেকে কিনলেন তাল মিছরী। কিছু গুয়ামৌরী। প্রজাপতি মার্কা দেশলাই। বহুদিন হলো ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন, তবু বাকিতে কিনে ফেললেন এক প্যাকেট দামি সিগারেট। যে সিগারেট তাদের ছোট্ট গ্রাম্য বাজারে দুষ্প্রাপ্যও বটে। আর নিলেন কিছু হালকা অঙ্গরাগÑ যৌবন বয়সে, এমনকি মধ্যবর্তী বয়স পর্যন্ত স্ত্রীর রাত্রির সাহচর্যের জন্য তিনি যা যা ব্যবহার করতেন অথবা যা যা তার অভ্যাস ছিল, সব তিনি জোগাড় করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। জোগাড় করেও ফেললেন। 

কিন্তু যে কাজে তিনি পরিপূর্ণ ব্যর্থ হলেন, তা হলো স্ত্রীকেও তার মতো জাগিয়ে তুলতে। আর ঘটনাক্রমে সেই রাতটিও পরিণত হলো তার জীবনের শেষ রাতে। 

আবুল হাসান তাঁর কবিতার মতোই এই গল্পেরও প্রতি পংক্তিতে গেঁথে দিয়েছেন অমোচনীয় বিষাদ। কিন্তু কবিতায় যা পর্যবসিত হয় রোমান্টিক বিষাদে, গল্পের নিজস্ব ধর্ম অনুযায়ী  তা শুধু বিষাদের আখ্যান হিসেবে সীমাবদ্ধ না থেকে নিজেকে প্রসারিত করেছে বহুদূরব্যাপী। সমাজস্থিত ব্যক্তি ও প্রতিব্যক্তির কথোপকথন এবং ক্রিয়া-বিনিময়ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গল্পটি ফুটিয়ে তুলেছে নিম্ন-মধ্যবিত্তের এক বৈচিত্র্যহীন কিন্তু সতেজ জীবনপ্রবাহ। আবুল হাসানের কবিতাগুলোর মতো এই গল্পও তাই আমাদের জীবনে সমান প্রাসঙ্গিক। তবে মনে রাখতে হবে একথা প্রযোজ্য শুধু গল্পের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেই। প্রকরণের বা অবয়বের ক্ষেত্রে নয়। 

০২.

অনেক ক্ষেত্রেই কবিদের লেখা ছোটগল্প তাঁদের কাব্যভাবনার প্রসারণ হয়ে যায়। গল্পের যে একটি আলাদা প্রকরণ রয়েছে, গল্পের অন্তর্ভুবন যে কবিতার চাইতে ভিন্ন সেকথা তারা স্মরণে রাখেন না। ফলে তাদের সেই লেখাগুলোকে ভিন্ন স্বাদের রচনা বলা গেলেও গল্পের অভিধা প্রদান করতে দ্বিধা হয়। অবশ্যই ব্যতিক্রম রয়েছে। অনেক কবির হাত দিয়ে অনেক শক্তিশালী ছোটগল্প রচিত হয়েছে। আমাদের ভাষাতে এবং অন্য ভাষাতেও তার প্রমাণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিন্তু ‘নর-নারীর নাম সম্বলিত ঘটনাবলিকেই’ যেমন উপন্যাস বলা যায় না, তেমনি গদ্যে লেখা চিন্তার বিচ্ছুরণমাত্রই গল্প নয়। 

আবুল হাসানের স্বল্পব্যপ্ত জীবনে কবিকৃতির যে অসামান্য দীপ্তি, সেগুলোর পাশে তাঁর গল্পগুলিকে স্থাপন করলে বড় বেশি নি®প্রভ মনে হয়। এই মনে হবার পেছনে দেরিদা-কথিত লেখকসম্পর্কে পাঠকের পূর্বধারণাও কাজ করে অনেকাংশে। তাঁর কবিতার হঠাৎ পংক্তি যেভাবে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে, সেই একই অনুভূতি প্রত্যাশিত হয় তাঁর গল্পের কাছেও। কিন্তু নিষ্করুণ সত্য হচ্ছে, তা পাওয়া যায় না। তারপরেও আবুল হাসানের গল্পগুলি আলোচনায় আনতে হবে গুরুত্বের সাথেই। সংস্থাপন করতে হবে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা বাংলা গল্পের ধারাবাহিকতায়। মিলিয়ে দেখতে হবে সেগুলোর সঙ্গতি ও অসঙ্গতি। 

বাস্তবতা হচ্ছে, গল্প যদি গল্পের শর্ত পূরণ না করে তাহলে ‘কবির লেখা গল্প’ বলে সেগুলো আলাদাভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, যেভাবে পাবলিক বাসে সংরক্ষিত থাকে ‘মহিলা আসন’। সেগুলো গল্প হবে না। হবে ‘কবির লেখা গল্প’। সাহিত্যের এক ভিন্ন প্রপঞ্চ।  

কেন গল্প লিখতে গেলেন আবুল হাসান? নিশ্চয়ই তিনি প্রচলিত গল্পধারায় সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না বিধায় নিজেই হয়তো দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন তার সময়ের গল্প কী রকম হওয়া উচিত! অথবা নিছক ইচ্ছা হয়েছে বলে গল্প লিখেছেন অথবা পত্রিকায় গল্প লিখলে প্রাপ্ত সম্মানির পরিমাণ বেশি তাই। অথবা কবিতায় যে কথা বলতে পারেননি, কাব্যেও প্রকরণটিকে যে কথা বলার জন্য যথেষ্ঠ মনে হয়নি, সে কথা বলে ভারমুক্ত হবার জন্যই গল্প লিখেছেন। 

উপরোক্ত ধারণার যে কোনো একটি বা দুইটি বা সবগুলিই সঠিক হতে পারে। আর তাহলে স্বতঃসিদ্ধভাবে একথাও মেনে নেয়া যায় যে, গল্প প্রকরণ হিসেবে আলাদা একটা জিনিস, আলাদা একটা শিল্প-মাধ্যম। এখানেও দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারটি থাকে। আর সেই দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারটিতে আবুল হাসান গুরুত্ব দিয়েছেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। 

‘অসহায় এলাকা’ গল্পটি অন্য অর্থেও আবুল হাসানের জন্য কিঞ্চিৎ অসহায় এলাকাই। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh