ঝিনুক আর মুক্তার মন্তাজ-

‘ঝিনুক নীরবে সহো’র নেপথ্য কাহিনি

মোশতাক আহমদ

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২২, ০৭:১২ পিএম | আপডেট: ০৪ আগস্ট ২০২২, ০৭:৪১ পিএম

‘ঝিনুক নীরবে সহো’ লেখার কাহিনিটা ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ বইয়ের পরিশিষ্টে লেখা আছে; কিন্তু সব কথা হয়তো বলা হয়নি। আরো কিছু কথা আছে। ২০১৩ সালে আবুল হাসানের জীবনের ছোট ছোট কিছু গল্পের ভিত্তিতে নতুনধারা পত্রিকায় একটা লেখা প্রকাশ করেছিলাম, আমার ডকুফিকশন ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ লেখার বীজটা সেখানেই। সেই লেখাটুকুও একদিনে হয়নি। ২০১১ সাল থেকে আমরা ‘আবুল হাসান’ নামে একটা ফেসবুক গ্রুপ শুরু করেছিলাম কবির প্রতি আগ্রহের কারণেই, সেই গ্রুপের পাতায় আবুল হাসান সম্পর্কিত নানা লেখা, নানা তথ্য আর ছবি জোগাড় করে একটা ছোটখাটো আর্কাইভ তৈরি করছিলাম। ফলে একদিন সেখানেই কবির জীবনের অনেক উপাদান সংগৃহীত হয়ে যায়। কবি শামীম আজাদ পাঠালেন কবির শেষ দিনগুলো নিয়ে একটা ছোট্ট লেখা। এর আগে বিশ্বজিৎ ঘোষের লেখা কবির জীবনী পড়ে কবির জীবনের অনেক অধ্যায় সম্পর্কে জানতে পারি; কিন্তু শূন্যস্থানও থেকে যায় অনেক। 

আমি একবার চেষ্টা করলাম কবির কয়েকটা কবিতার রচনার সাথে তাঁর জীবনের ছোট ছোট গল্পগুলোকে মেলাতে। কবির কবিতায় পাই তাঁর বাবার কথা ‘চামেলি হাতে নিম্নমানের মানুষ’-এ; ফাতিমা ফুফুর কথা পাই, ফুফু মর্মায়িত স্বরে কোরআন তেলাওয়াত করছেন ‘পাখি হয়ে যায় প্রাণ’ কবিতায়; কবি স্বয়ং নিজেকে মেলে ধরেন ‘আবুল হাসান’ কবিতায়; কবির বোনের উল্লেখ পাই, তিনি উঠোনে আসা কাকদেরকে ভাত ছিটিয়ে দিয়ে সম্ভাব্য অমঙ্গল দূর করতে চাইছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের আত্মস্মৃতিতে দুজনের অনেক গল্প পেয়ে যাই। আবুল হাসানের একটি অপ্রকাশিত কবিতার সংকলন আর কবির জীবনীতে কিছু চিঠি পাই— শওকত ওসমান, বন্ধু সাংবাদিক মাহফুজুর রহমান, নির্মলেন্দু গুণকে কবির লেখা; আর শওকত ওসমানের লেখা একটা চিঠি পাই, পেয়ে যাই পূর্ব বার্লিনের কিছু অস্পষ্ট ফটোগ্রাফ। এসব উপাদান থেকে সার্বক্ষণিকভাবেই নানা সূত্র খোঁজার একটা উৎসাহ চলতে থাকে। 

একদিন হঠাৎ করেই লিখতে বসে যাই, বইমেলায় প্রকাশের কোনো তাড়া দিই না নিজেকে। কবির জন্মদিনে বইটা প্রকাশ করতে চাই। আমি বুঝে ফেলি কবির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫-এর সময়কালে কবির জীবনের একটা গল্প লিখবার সব উপাদান হয়তো আমি জোগাড় করতে পারব না, সে ক্ষেত্রে আমাকে কল্পনার আশ্রয়ও নিতে হবে, যে কল্পনা হবে সত্যাশ্রয়ী, বিভিন্নজনের লেখায় হয়তো তার কিছু আভাস আছে। সেদিন রাতে পূর্ব বার্লিন হাসপাতাল থেকে কবির লেখা মর্মস্পর্শী চিঠিগুলোর পাঠ উদ্ধার করে নিজের কম্পিউটারে টাইপ করার পর তা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। কবি অনেক আশা নিয়ে পূর্ব বার্লিনের চ্যারিটি হাসপাতালে হৃদ রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন। অসম্পূর্ণ চিকিৎসা শেষে ফেরার সময় বিমানে বসে বসে কবির যে অনুভূতি হয়েছিল বলে আমি ভেবেছিলাম, সেটুকুই লিখে ফেলে আমার এক বন্ধুকে পড়তে দিলাম। আমার বন্ধু সেই লেখা পড়ে চমকে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আবুল হাসানের ডায়েরি আমি কোথায় পেয়েছি? তখনই আমি বুঝে গেলাম আমি যা লিখতে চাচ্ছি তা হয়তো লিখতে পারব। 

এরপরে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কবির জন্ম এবং মৃত্যু পর্যন্ত বছরগুলোকে একটি চার্টে ফেলে বিভিন্ন বছরে কবির জীবনে ঘটে যাওয়া প্রধান ঘটনাগুলোকে টুকে ফেলি, বিভিন্ন সময়কালে কবির কবিতা ও অন্য রচনাগুলোকেও সেই ছকে ফেলে ভাবতে থাকি। এক সময়ে মনে হলো, কবির পুরো জীবনটাই আমার চোখের সামনে ভাসছে। আমার বইয়ের পেছনে সংযুক্ত রেফারেন্সের বই, পত্র-পত্রিকা, অনলাইনের ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নানা লেখাও সূত্রগুলো এরপর থেকেই আমি অনেকটা বানের জলের মতো আমার কাছে চলে আসতে দেখি। আমার বন্ধু, শুভাকাক্সক্ষী, অচেনা মানুষদের কাছ থেকেও নানাসূত্র পেতে থাকি। শালুক পত্রিকা, মূল্যায়ন পত্রিকা থেকে শুরু করে ১৯৭৬ সালের কিছুধ্বনি পত্রিকা পর্যন্ত নানা সূত্র থেকে আমি প্রয়োজনীয় তথ্য পাই। আবুল হাসানের জীবনে অনেক কবি সাহিত্যিক, শিল্পী, বন্ধুদের যাতায়াত। আমি তাঁদেরকেও ব্যবচ্ছেদ করতে শুরু করি, কারো কারো সাথে দেখা করে, কারো কারো সাথে ফোনে কথা বলে অনেক গল্প পেয়ে যাই। অসুস্থ কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী করোনাকালের জন্য আমার সাথে দেখা করতে রাজি হননি; কিন্তু অনেকবার টেলিফোনে কথা বলে কবির জীবনের অনেক গল্প করেছেন। ঘোর করোনাকাল না হলে আরো কিছু সাক্ষাৎকারের আলোকে বইটা ঋদ্ধ হতে পারত। 

জুন ২০২০-এর শেষ সপ্তাহে লিখতে শুরু করলেও ডিসেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত আবুল হাসানের বার্লিন অধ্যায় নিয়ে তিন-চারটি ব্যর্থ ইমেইলের উত্তর ছাড়া সঞ্চয়ে কিছুই নাই। বার্লিনের হাসপাতাল থেকে সবিনয়ে কোনো তথ্যই না দেয়ার কথা বলছে বারবার। সম্পূর্ণ অন্ধকারে। এরকম সময়ে শাওন আজিম, সাজ্জাদ শরিফ, শাহাদুজ্জামান হয়ে ওয়াকিলুর রহমানের কাছ থেকে আবুল হাসানের বার্লিনের সেই শিল্পীবন্ধু রাইন হার্ট হেভিক্যার নামটা জানতে পারি। সেটা ২০২১-এর জানুয়ারি মাস। তখন আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে অসুস্থ শিল্পী রাইনহার্ট হেভিক্যার প্রায় নিষ্ক্রিয় ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সক্রিয় বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি এবং কবি স্টিফেন মারসিনিয়াকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হই। আত্মস্বীকৃত অলস স্টিফেন আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করেন। স্টিফেনের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ২৩ মার্চ মৃত্যুর আগের শেষ শীতকালটিতে শিল্পী রাইনহার্ট হেভিক্যা এ কথা জেনে নাকি খুব প্রীত আর তৃপ্ত ছিলেন যে আবুল হাসানের পরবর্তী জন্মদিনেই আমার বইটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। স্টিফেন এখনো আমাকে নতুন নতুন তথ্য দিচ্ছেন। হয়তো নতুন সংস্করণে সেসব কথা যোগ করতে পারব। 

এই বইয়ের জন্য হীরা-মানিক দিয়েছেন প্রিয় শিক্ষক রফিক কায়সার, জাহিদুল হক, নাজিম আনওয়ার রূপম এই কজনের নাম বলি! কত অভাবিত উৎস থেকেই না কত খুঁটিনাটি সাহায্য পেয়েছি। আবুল হাসানের সময়টাকে ধরে রাখার জন্য চলমান উইকিপিডিয়া বন্ধু অমি রহমান পিয়ালের সুইস ঘড়িতে কটা বাজে সে খেয়াল না রেখেই জানতে চেয়েছি নূরা পাগলার বৃত্তান্ত, আজম খানের মুক্তিযুদ্ধের কথা কিংবা শশাঙ্ক পাল বা হুমায়ুন কবিরের নিহত হবার ঘটনা। মুহূর্তের মধ্যে পেপার কাটিং বা স্ক্রিনশট হাজির হয়ে গেছে! অনিন্দ্য সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ, সাময়িকপত্র গবেষক ইসরাইল খান আর বহুপ্রজ তরুণ কবি-গবেষক পিয়াস মজিদ ছিলেন আমার অতন্দ্র প্রহরী। 

আবুল হাসানের আদরের ছোট বোন বুড়ি (হোসনে আরা খানম) আপা যে কত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তার কোনো ইয়ত্তা নাই; কিন্তু তাঁকে কী কী প্রশ্ন করব তা যদি জানতাম! এত বছর পরও কি প্রয়াত ভাইকে নিয়ে কথা বলতে গেলে তাঁর মন হাহাকার করে ওঠে কিনা এই অনিশ্চয়তায়ও ভুগেছি। 

‘‘আহমদ ছফার ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ আর দিলারা হাশেমের ‘আমলকির মৌ’ উপন্যাস থেকে গুরুত্বপূর্ণ গল্প পেয়েছি, জীবনীর উপাদানের আভাস ইঙ্গিত পেয়েছি। সুরাইয়া খানমের চরিত্রটি দাঁড় করাতে তাদের দুটি উপন্যাস আমাকে সাহায্য করেছে, সাথে আবুল হাসানের ছোটগল্প তো ছিলই। এ বিষয়ে আরো সাহায্য করেছেন কামরুন জিনিয়া, আসাদ আলম সিয়াম। 

আমি খুব সচেতন ভাবেই ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ সালের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও ঘটনাগুলোর উপরে আবুল হাসানের জীবনের দিনগুলোকে স্থাপন করার চেষ্টা করেছি। কেননা সেই টালমাটাল সময়টা আবুল হাসান একজন ছাত্র, কবি ও সাংবাদিক হিসেবে যাপন করেছেন। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা পরবর্তী অস্থিরতা, বঙ্গবন্ধু হত্যা, এ সব ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী আবুল হাসান। তাঁর জীবনে ও কবিতায় এসব ঘটনার প্রভাব আছে। 

নানাসূত্র থেকে গল্প এবং গল্পের চোরাস্রোত খুঁজে পেয়ে লিখতে লিখতে আমি বিশ্বাস করেছি রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতায়—‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি/ কবি তব মনোভূমি/ রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য।’ সেই সূত্রগুলোকে মন্তাজের মতো মিলিয়ে দিয়েছি, আর আমার নিজস্ব কল্পনা ও বিবেচনায় অবয়ব পেয়েছে আবুল হাসানের জীবনভিত্তিক ডকুফিকশন ‘ঝিনুক নীরবে সহো’।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh