ফের জনপ্রিয়তা বাড়ছে ইমরান খানের

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২২, ০৩:৩১ পিএম

একের পর এক জনসভায় সরকারকে ঘায়েল করছেন ইমরান খান। ছবি : ডন

একের পর এক জনসভায় সরকারকে ঘায়েল করছেন ইমরান খান। ছবি : ডন

ক্ষমতা ছাড়ার তিন মাস পর ফের জনপ্রিয়তা বাড়ছে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের। কার্যত দেশটিতে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট চলছে, তারই ধারাবাহিকতায় ইমরান আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। 

বিশ্লেষকদের মতে, তিন মাস আগে ইমরান যখন ক্ষমতাচ্যুত হন, সেই সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আর ওই সময়ে ক্ষমতা ছাড়ার ফলে ইমরান এ তিন মাসে এটা প্রমাণ করতে চাইছেন যে, এ সংকট বৈশ্বিক, এর জন্য তার সরকার দায়ী নয়। এখন পাকিস্তানে সংকট দিনে দিনে তীব্রতর রূপ ধারণ করেছে। দেশটিও এগিয়ে চলেছে দ্রুত দেউলিয়াত্বের পথে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, অর্থনৈতিক সংকট যত তীব্র আকার নিচ্ছে, পাকিস্তানে ইমরানের জনপ্রিয়তাও তত বাড়ছে।

সম্প্রতি তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) জয় পেয়েছে পাঞ্জাবে। ১৭ জুলাইয়ের ওই নির্বাচনে রেকর্ডভাঙা জয়ে ইমরানের জনপ্রিয়তার বিষয়টিই আলোচনায় এসেছে। প্রদেশটি শরিফ পরিবারের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। প্রদেশের স্থানীয় উপনির্বাচনে ২০টি আসনের মধ্যে ইমরানের পিটিআই পেয়েছে ১৫টি। আসনগুলোয় মোট ভোটের দুই-তৃতীয়াংশই পেয়েছে পিটিআই। এর আগে কখনোই শরিফ পরিবারের বাইরে আর কেউ পাঞ্জাবের নির্বাচনে এমন ফল অর্জন করতে পারেনি। ২০টি আসনের মধ্যে শরিফ পরিবারের পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) বা পিএমএল-এন পেয়েছে পাঁচটি। এ আসনগুলো আবার শরিফ পরিবারের নিজেদের বা এর আশপাশের এলাকা। এ ছাড়া দেশটিতে এ পর্যন্ত উপ-নির্বাচনগুলোয় ভোটার উপস্থিতি সাধারণত খুবই কম দেখা যায়। কিন্তু এবারের উপ-নির্বাচনে ভোট দিয়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি ভোটার।

প্রসঙ্গত, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় অদক্ষতার অভিযোগে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন তার রাজনৈতিক বিরোধীরা। পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরান খান সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা হাতে নেয় শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাজনৈতিক জোট পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)। এরপর সময় পেরিয়েছে তিন মাস। এ তিন মাসে পাকিস্তানের অর্থনীতির সামান্যতম উন্নতি হয়নি। দেশটি এগিয়ে চলেছে দ্রুত দেউলিয়াত্বের পথে। পাকিস্তানি রুপির অবস্থান মুদ্রাবাজারে ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে উঠছে। জুলাই মাসের শেষ দুই সপ্তাহে অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ২২৮ রুপি ছাড়িয়েছে প্রতি ডলারের বিনিময় হার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের হাতে রিজার্ভের পরিমাণ নেমে এসেছে প্রায় ৯৩৯ কোটি ডলারে, যা দিয়ে দুই মাসেরও আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব না। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশটির পক্ষে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশটির বিভিন্ন স্থানে দিনে ৮ থেকে ১৮ ঘণ্টা ব্ল্যাকআউটের ঘটনাও ঘটছে। জ্বালানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নিয়মিত বিক্ষোভ-ধর্মঘটে নামছেন পরিবহন খাতের শ্রমিকরা। গত এক বছরে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৩২ শতাংশের বেশি।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পিডিএম বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে কি-না সে বিষয়ে এখন সংশয় দেখা দিয়েছে। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশটির জনগণ এখন ক্ষমতাসীনদের উপর বিরক্ত। দেশটিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দিনে দিনে তীব্র হচ্ছে। আর এর সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির ময়দানে আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছেন ইমরান। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো সামির পাতিল বলেন, ‘এই মুহূর্তে ইমরানের নতুন সরকার কিংবা শরিফ নেতৃত্বাধীন সরকার কেউই সাধারণ পাকিস্তানিদের স্বস্তি নিশ্চিত করতে পারবে না। তারা আবারও ব্যর্থ হয়েছেন।’

এদিকে পাঞ্জাবের উপ-নির্বাচনের চিত্র সরকারকে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। পাঞ্জাবে জয়ের পর আত্মবিশ্বাসী ইমরান কেন্দ্রীয় সরকারকে অক্টোবরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। তবে জোট সরকারের পিএমএল-এন ও পিপিপি ২০২৩ সালের মাঝামাঝি নির্বাচন করতে চায়। এই সময়ে তারা সরকারে বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। ইমরানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে।

এ ছাড়া পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার অবসরের সময় ঘনিয়ে আসছে। দ্বিতীয় মেয়াদে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালনে এরই মধ্যে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি। পিডিএম সরকারের কর্তাব্যক্তিদের প্রত্যাশা, নতুন অনুগত সেনাপ্রধান নিয়োগের মাধ্যমে পিটিআইয়ের ক্ষমতাগ্রহণ ঠেকাতে পারবেন তারা। আবার নতুন সেনাপ্রধানের নিয়োগকে সম্ভাবনা হিসেবেও দেখছে পিটিআই। কারণ পিটিআই সরকারের শেষের দিকে বাজওয়ার সঙ্গে  ইমরানের সম্পর্ক ভালো ছিল না। তবে ইমরান চাইছেন বাজওয়া সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় নির্বাচন হোক। তাহলে নতুন সেনাপ্রধান নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবেন তিনি।

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ইমরানের এই পুনরুত্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে দেশটির দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় ইমরানের নজিরবিহীন জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি দেশটির নতুন বাস্তবতাকে নির্দেশ করছে। সেখানে শুধু যে অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়রাই ক্রিয়াশীল এমন নয়; বিদেশিরাও খেলছেন নিজ নিজ স্বার্থে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন শরিফ পরিবার যদিও চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রক্ষা করে গেছে; তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আবার বিলাওয়াল-জারদারির পিপিপি মার্কিনপন্থি বলে পরিচিত। সম্প্রতি ভূরাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সুস্পষ্ট- একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি, অপরদিকে চীন ও রাশিয়া। উপমহাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আধিপত্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আর ইমরান চীনকে কট্টরভাবে সমর্থন দিয়েছেন। তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার জন্য দায়ী করছে যুক্তরাষ্ট্রকে। ইমরান আবার ক্ষমতায় এলেও তার অবস্থান একই থাকতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে চীন বর্তমান সরকারের চেয়ে ইমরানকেই বেশি পছন্দ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

পাকিস্তানে রাজনীতিই শেষ কথা নয়। সামরিক আমলাতন্ত্র সেখানে ক্ষমতাচর্চার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। যে কারণে সেখানে ক্ষমতায় থাকা বা না থাকার বিষয়টি অনেক তবে-কিন্তুর উপর নির্ভরশীল। সামরিক বাহিনীর মার্কিনপন্থি অবস্থানের পরিবর্তন ছাড়া মার্কিনবিরোধী কেউ ক্ষমতায় বেশি টিকে থাকতে পারবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদি ইমরান তা করতে চান, তাহলে হয় তাকে মার্কিন প্রশ্নে নমনীয় হতে হবে, তা না হলে গোটা সামরিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও সামরিক বাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল করবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। আর সে ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত দেশটির রাজনীতি-অর্থনীতি কোনদিকে যাবে, তা বুঝতে আরও কয়েক সপ্তাহ পাকিস্তানের দিকে নজর রাখতে হবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh