বিদ্যুৎ-গ্যাসের দামও বাড়বে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২২, ০৯:০২ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ভোক্তারা অসহনীয় ভোগান্তির মদ্যে পড়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সামনে সেই ভোগান্তি আরো বহু গুণে বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা ধারণা করছেন, খুব শিগগিরই সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামও বাড়াবে। 

তারা বলছেন, ঋণ নিয়ে আলোচনার সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর কথা বলেছে। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা এবং বাজেট সহায়তা হিসেবে সংস্থাটির কাছে আনুষ্ঠানিক ঋণের বিষয়ে আলোচনার সময় সরকারের পক্ষ থেকে দেশের রাজস্ব ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কিছু সংস্কার আনা হবে বলে জানানো হয়েছে। আগামী মাসে সংস্থাটির সাথে ঋণ নিয়ে ফের আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হবে। তার আগেই বাড়তে পারে বিদ্যুৎ ও গ্যাস বাড়বে।

দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমার প্রবণতা যখন মানুষের মাঝে কিছুটা আশার সঞ্চার করছিল, তখন গত শুক্রবার (৫ আগস্ট) সরকার ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে। 

এর বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যে জনজীবনে পড়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম এবং পরিবহন ভাড়া এক লাফে অনেক বেড়েছে। জীবনযাত্রার পাশাপাশি শিল্প, কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে পরিস্থিতিকে আরো জটিল আকার ধারণ করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। 

গত মাসে ঢাকা সফর করে যাওয়া আইএমএফ মিশন তাদের সমাপনী বিবৃতি সম্প্রতি সরকারকে পাঠিয়েছে। এতে সরকারের অবস্থান এবং আইএমএফের কিছু সুপারিশের উল্লেখ রয়েছে। মিশনের সাথে বৈঠকের পর সরকার আইএমএফের 'রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ট্রাস্ট' তহবিল থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে প্রত্যাশিত ঋণের পরিমাণ উল্লেখ না থাকলেও অর্থ বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, ঋণের সম্ভাব্য পরিমাণ সাড়ে ৪ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলার। ঋণ নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হলে তখন সংস্থাটির সুনির্দিষ্ট শর্তের বিষয়গুলো সামনে আসবে।

আইএমএফ মিশনের সমাপনী বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে টাকা-ডলার বিনিময় হারের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কমানো হয়েছে। আমদানি-নির্ভর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অতি প্রয়োজনীয় নয় এমন পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এখন পেট্রোল ও অকটেনের পাশাপাশি তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে। মিশন মনে করে, আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে মিলিয়ে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ কৌশল নিলে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সরকারের বাড়তি ব্যয়ের ক্ষেত্রে তা সহায়ক হবে। লক্ষ্যনির্দিষ্ট সামাজিক ব্যয় বাড়ালে তা গরিবদের রক্ষায় সহায়তা করবে। একই সাথে তা বিভিন্ন সংস্কারের বিষয়ে আইএমএফের সাথে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।

আইএমএফ বলেছে, পর্যাপ্ত রাজস্ব আয়ের অভাব এবং উচ্চ ভর্তুকির কারণে বাজেটের ঘাটতি অর্থায়ন করতে অভ্যন্তরীণ উৎসের উচ্চ মূল্যের ঋণের দিকে সরকারের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। এ কারণে আর্থিক স্বস্তির জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। এ অবস্থায় আর্থিকভাবে টেকসই উপায়ে উন্নয়ন, সামাজিক এবং জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং সরকারের ব্যয় যৌক্তিকীকরণ এ সময়ের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তবে দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে করোনা এবং বৈশ্বিক অভিঘাত মোকাবিলার জন্য সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।

আইএমএফের পরামর্শ এবং সরকারের অবস্থান নিয়ে এরই মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে সমকালের প্রশ্নের জবাবে গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় আগে থেকেই মানুষ চাপে আছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম এত বাড়ানো উচিত হয়নি। বিপিসি আগে অনেক লাভ করেছে। চলতি অর্থবছরের জন্য তাদের কিছু ভর্তুকির ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে। আরো কিছুদিন অপেক্ষা করলে হয়তো এখনকার লোকসান থাকত না।


তিনি মনে করেন, তেলের পর গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে জনজীবনে এবং একই সাথে অর্থনীতিতে আরো নেতিবাচক অভিঘাত পড়বে। এর ফলে উৎপাদনের ওপর আঘাত আসায় রাজস্ব আয় কমে যেতে পারে। অন্যদিকে দেশে উৎপাদন কমে গেলে আমদানি নির্ভরতা বাড়বে। সুতরাং শুধু ভর্তুকির বিবেচনা না করে, সামষ্টিক অর্থনীতি এবং ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আইএমএফের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। রাজস্ব প্রশাসন কিংবা ব্যাংক খাতে সংস্কারের পরামর্শকে তিনি ইতিবাচকভাবে দেখেন। সংস্থাটির সাথে আলোচনার ক্ষেত্রে সরকারকে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং একই সাথে ভোক্তার স্বার্থ মাথায় রাখতে হবে।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, জ্বালানি তেলের পর গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে মূল্যস্ম্ফীতি আরো বাড়বে। শিল্পের উৎপাদনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি মনে করেন, কৃষি এবং শিল্পে আমাদের আমদানি নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। কৃষিতে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে সেচ পদ্ধতিতে যেতে হবে। বিশ্ববাজারের অভিঘাত কমানো যাবে- এমন পরিকল্পনা গ্রহণ খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।

আইএমএফের অন্যান্য পরামর্শ: 

আইএমএফ মনে করে, জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়ে সরাসরি বাজেটের ঘাটতি অর্থায়ন পরিহার করা উচিত। সেটা সরকারের ব্যয় যৌক্তিকীকরণের জন্য সহায়ক হবে। সংস্থাটি আরো বলেছে, এ মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সুরক্ষা দেওয়া খুব জরুরি। কারণ বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য বেশ চাপের মধ্যে আছে। এছাড়া আর্থিক খাতে আরো কিছু সংস্কার জরুরি। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিং করতে হবে। খেলাপিঋণ ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকের নিজস্ব দক্ষতা বাড়ানোসহ আরো কিছু পরামর্শ তাদের রয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর ওপর তুলনামূলক বেশি জোর দিয়েছে আইএমএফ। কেননা রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশে অনেক কম। ভ্যাটের হার কাঠামো সহজ করা, পুরো রাজস্ব সংগ্রহ পদ্ধতির আধুনিকায়নসহ রাজস্ব প্রশাসনে আরো সংস্কার আনতে সরকার আইএমএফের কাছে কারিগরি সহায়তাও চেয়েছে আইএমএফের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

বিদ্যুৎ ও গ্যাস নিয়ে সরকারের অবস্থান: 

দেশে গত জুন মাসে গ্যাসের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে গত মে মাসে গণশুনানি হয়। যেখানে ক্যাব এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। 

গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জ্বালানি তেলের পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। 

তিনি জানান, গ্যাস আমদানিতে প্রতি ইউনিটে খরচ হচ্ছে ২৮ টাকা। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সেই গ্যাস ৫ টাকায় দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিটে খরচ হচ্ছে ৮ টাকা, যেখানে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হচ্ছে ৭ টাকা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২ টাকা ৭৫ পয়সা।

চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির জন্য ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এলএনজি আমদানির জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রয়েছে। এলএনজির দাম বিশ্ববাজারে যেভাবে বেড়েছে, তাতে আরো ভর্তুকির প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করছে সরকার।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh