জনশুমারি ও জনসংখ্যা নিয়ে বিতর্ক কেন

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২২, ১০:১৬ এএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

জরিপ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাক্যটি এরকম যে, ‘মিথ্যা তিন প্রকার : মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা ও জরিপ।’ খুব কম জরিপের ফলই প্রশ্নাতীত বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠানের জরিপের ফল নিয়েও সমালোচনা হয়।

যেমন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দেশের বিভিন্ন খাতের সুশাসন নিয়ে যে জরিপ করে, সরকার ও সরকারি দলের তরফে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এছাড়া দুর্নীতির ধারণা সূচক, মানবাধিকারের সূচক, আইনের শাসনের সূচক, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকেও যখন বাংলাদেশের অবস্থান খুব খারাপ প্রমাণ হয়, সেসব জরিপের ফলও সরকারের তরফে প্রত্যাখ্যান করা হয় বা পক্ষপাতদুষ্ট বলে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ এই সূচকগুলো তৈরি হয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে। 

তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয় দুটি জরিপ বা গবেষণার ফল নিয়ে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে জনসংখ্যা এবং অন্যটি মাথাপিছু আয়। সরকারি হিসাবে এখন বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার (ডেইলি স্টার, ১০ মে ২০২২)। কিন্তু খোলা বাজারে টিসিবির ট্রাক থেকে কম দামে পণ্য কিনতে মানুষের যে লম্বা লাইন এবং সেখানে মধ্যবিত্তদেরও ভিড় বাড়ছে বলে যেসব ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়, তা দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, ২ হাজার ৮২৪ ডলার কোথায় গেল বা মাথাপিছু আয় বাড়ল আসলে কাদের? কতজনের?

সিনিয়র সাংবাদিক শওকত হোসেন একটি মন্তব্য করেছেন যে, ‘বিনিয়োগ বাড়ছে না, সরকারের রাজস্ব আয় কম, বাড়ছে না মানুষের আয়, সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে মূল্যস্ফীতি; অথচ রাতারাতি বেড়ে যাচ্ছে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়। মানুষের মাথাপিছু এই আয় বর্তমান বাজারের প্রকৃত চিত্রের সঙ্গে কি সংগতিপূর্ণ? জিডিপি ও মাথাপিছু আয় কি চোখের দেখায় বেড়েছে, নাকি এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ আছে, তা জানা আজকাল মুশকিল হয়ে গেছে। সরকারের পরিসংখ্যানের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে অনেক দিন ধরেই।’ (প্রথম আলো ১০ মে ২০২২) তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহীমের বরাতে লিখেছেন, “আমি তরুণ বয়সে দেখেছি, জিডিপি কত হবে, তা আগে ঠিক করা হয়। পরে ‘ব্যাক ক্যালকুলেশন’ করে হিসাব ঠিক করা হয়।”

২০১৯ সালে দৈনিক কালের কণ্ঠ বিবিএসের খানা জরিপের গোঁজামিল নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়, মাঠপর্যায়ে যখন খানা আয়-ব্যয় জরিপের কাজ চলছিল, তখন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেউ নিয়মমতো তদারকিতে যাননি। এই সুযোগে ৬৪ জেলার পরিসংখ্যান কর্মকর্তারাও গণনাকারীদের কাছে যাননি। ফলে গণনাকারীরাও বাড়ি বাড়ি না গিয়েই নিজেদের খেয়ালখুশিমতো তথ্য জুড়ে দিয়েছেন ফরমে। প্রতিবেদনে গোপালগঞ্জ পৌরসভার এক পরিসংখ্যান কর্মকর্তার ভাষ্য ছিল এ রকম, ‘আমরা করবটা কী? গণনাকারী নিয়োগেও চেয়ারম্যান-মেম্বাররা নিজের লোক ঢুকিয়ে দেন। ওরা সব আনাড়ি, পরিসংখ্যানের কাজ কিচ্ছু জানে না... এভাবে রাজনৈতিক নিয়োগের লোকজন দিয়ে কোনোদিন সঠিক তথ্য-উপাত্ত মিলবে না।’

এ রকম পরিস্থিতি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিপের ফল নিয়ে মানুষের ব্যাপক অনাস্থা ও অবিশ্বাসের মধ্যেই প্রকাশ হয়েছে দেশের প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি। এবারের শুমারিকে ডিজিটাল বলা হচ্ছে কারণ পুরো কাজটি হয়েছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। মাঠকর্মীরা ট্যাব নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং সব তথ্য ডিজিটালি আপ করে সেখানেই হিসাব-নিকাশ করা হয়েছে। পুরো এই কাজে সরকারের খরচ হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা।  সবশেষ জরিপের ফল বলছে, এখন বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার। কিন্তু এই সংখ্যা প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। তাদের যুক্তি হলো, অনেক বছর আগেই বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। তাহলে কি দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে না? অথচ বিভিন্ন সভায়, আলোচনায়, সংবাদ ও বিশ্লেষণেও এত দিন বলা হতো, দেশের জনসংখ্যা ১৭ থেকে ১৮ কোটি। তাহলে জরিপে জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি হয় কী করে? কেউ কেউ এ রকম প্রশ্নও করেছেন, মাথাপিছু আয় বেশি দেখানোর জন্যই কি জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে?

২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর প্রথম আলোর একটি খবরে বলা হয়, জন্মনিবন্ধন অনুসারে দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১০ লাখ। আবার বিবিসির এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বাংলাদেশে কয়েক কোটি মানুষের জন্মনিবন্ধন তথ্য সার্ভারেই নেই (বিবিসি বাংলা, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। উল্লিখিত তথ্যগুলোর ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, দেশের অন্তত ২০ শতাংশের মতো মানুষ এখনো জন্মনিবন্ধনই করেনি। তাহলে প্রশ্ন হলো, দেশের প্রকৃত জনসংখ্যা কত? উল্লেখ্য, ২০১১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭ জন। তার মানে ১০ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে দুই কোটি ১১ লাখ ১৪ হাজার ৯১৯ জন। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২২%, যা আগের তুলনায় কমেছে।

অস্বীকার করা যাবে না, দেশে জন্মহার কমেছে। নব্বই দশকের মতো এখন জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নিয়ে সরকার খুব বেশি তৎপর না হলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। বাংলাদেশের মতো আয়তনে ছোট ও সীমিত সম্পদের দেশে অধিক জনসংখ্যার কুফল সম্পর্কে মানুষ সচেতন হচ্ছে। আবার স্বামী-স্ত্রী দুজনই কাজ করেন, এমন সংখ্যাও বাড়ছে। ফলে একটির বেশি সন্তান হলে তাকে মানুষ করা কঠিন- বিবেচনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে, তাতে সন্দেহ নেই। সেই হিসাবে ২০১১ সালের পরে গত ১১ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দুই কোটি ১১ লাখ এবং তা অস্বাভাবিক নয়। 

কিন্তু তারপরও মানুষ কেন এই সংখ্যা নিয়ে অবিশ্বাস করে? এর কারণ পারসেপশন। মানুষ ধরেই নেয়, সরকার সব সময়ই দেশের জনসংখ্যা কমিয়ে বলে; কারণ জনসংখ্যা বেশি দেখানো হলে সেই অনুপাতে মাথাপিছু আয় ভাগ করতে হয়। এর বাইরে সরকারের আরও হিসাব-নিকাশ থাকে। আর এটি শুধু পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতি মানুষের অবিশ্বাস বা সন্দেহ নয়, পুরো সরকারি সিস্টেম নিয়েই মানুষের এই সংশয় রয়েছে। কিন্তু তারপরও যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই লিখেছেন যে, তাদের কাছে কোনো গণনাকারী যাননি এবং স্বয়ং পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও বলেছেন, ‘সাত দিনব্যাপী চলা এই কর্মযজ্ঞে অনেকের মধ্যে দায়িত্বহীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এ কারণে অনেকে গণনা থেকে বাদ পড়েছেন।’ এবারের মানুষ গোনার কাজে অবহেলা হয়েছে বলেও তিনি স্বীকার করেন (প্রথম আলো, ২৯ জুন ২০২২)।

এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কোনো কিছু গোপন করা সত্যিই কঠিন। যখন এই জনশুমারি চলছিল, তখনই ফেসবুকে অসংখ্য মানুষ লিখেছেন, তাদের বাড়িতে কোনো গণনাকারী যাননি। তার মানে তারা গণনা থেকে বাদ পড়েছেন। কোথাও কোথাও তথ্য সংগ্রহ না করেই দরজার সামনে স্টিকার টানিয়ে দেওয়া হয়েছে- এমন অভিযোগও রয়েছে। তাহলে কত মানুষ এই ডিজিটাল জনশুমারিতে বাদ পড়েছে, তা কি আদৌ জানা যাবে? সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, সাড়ে তিন লাখের বেশি গণনাকারী দেশজুড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সবার উপর নজর রাখা সম্ভব হয়নি। আর জনশুমারির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, গণনা থেকে কেউ বাদ পড়লে হটলাইন নম্বরে ফোন করে গণনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ রাখা ছিল। কিন্তু মানুষ এই সুযোগ না নিয়ে বাদ পড়েছেন বলে সমালোচনা করছেন। 

জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, অনেকের বাসায় গণনাকর্মীরা যাননি বলে যে অভিযোগ এসেছে, যাচাইয়ে সেগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়নি। তারপরও জনশুমারি ও গৃহগণনার ভুলত্রুটি খুঁজে বের করতে থার্ড পার্টির মাধ্যমে পরীক্ষা করা হবে। পোস্ট ইনুমারেশন চেক (পিইসি) নামে এই পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (বিআইডিএস)। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে মাঠপর্যায়ে (প্রায় ৫৪০টি নমুনা এলাকা) ফের জরিপ করবে সংস্থাটি। এর মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে কাভারেজ এরোর (বাদ পড়া কত) এবং কনটেইন এরোর (প্রশ্নপত্রের তথ্যের ভুল)। এতে দেশের জনসংখ্যা আরও অন্তত ৪ শতাংশ বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, বর্ষা মৌসুমে শুমারি করা ঠিক হয়নি। তাছাড়া জরিপ চলাকালে বৃহত্তর সিলেটে বন্যা চলছিল। সব মিলিয়ে অনেকেই বাদ পড়েন। প্রকল্প পরিচালক বাদ পড়ার বিষয়টি মানতে না চাইলেও এটিই বাস্তবতা যে, এ রকম জরিপে সবসময়ই কিছু মানুষ বাদ পড়েন। পরে সেটি সমন্বয় করতে হয়। সুতরাং এবারও যারা বাদ পড়েছেন, তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে সংশ্লিষ্টরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবেন, এটিই প্রত্যাশা। কারণ জনশুমারিতে দেশের প্রকৃত জনসংখ্যার চিত্র উঠে না এলে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ কঠিন হয়। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নসহ যে কোনো নীতিকৌশল নির্ধারণে জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য অত্যন্ত জরুরি। এর ভিত্তিতে দেশের মোট খাদ্যসহ সব পণ্যের চাহিদা নিরূপণ, সরবরাহ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু জনসংখ্যার সঠিক তথ্যের অভাবে এ ধরনের যে কোনো পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে।

সুতরাং এবারের ডিজিটাল জনশুমারিতে অনেকে যে বাদ পড়েছেন এবং মাঠকর্মীদের মধ্যে অনেকের কাজেই যে গাফিলতি ছিল, সেটি স্বীকার করে নিয়ে বাদ পড়াদের একটি আধুনিক ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্ত করাই হবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ। সেই সঙ্গে এটিও মনে রাখতে হবে, শুধু পারসেপশন দিয়ে বলে দেওয়া যায় না যে জরিপের ফল অস্বাভাবিক। কারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিচালিত কোনো জরিপের ফল প্রত্যাখ্যান করতে হলে তার বিপরীতে কোনো বৈজ্ঞানিক ডাটা বা তথ্য-উপাত্ত থাকতে হয়। শুধু পারসেপশন দিয়ে এটি বলে দেওয়া যায় না, দেশের জনসংখ্যা ২০ কোটি। কারণ এটিও মনে রাখতে হবে, জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। বৈষয়িক নানা কারণেই তারা এখন একটি সন্তানেই সন্তুষ্ট থাকছেন। সুতরাং ২০১১ সালে দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১৪ কোটি ছিল বলে ২০২২ সালে এসে ২০ কোটি হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh