বাঙালির চোখের কোণে জমাটবাঁধা শোকাশ্রু

ড. আফসার আহমদ

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২২, ১২:৩৯ পিএম | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২২, ১১:০৫ পিএম

শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইল ছবি

শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইল ছবি

বঙ্গবন্ধু কোনো ব্যক্তির একক পরিচয় নয়, একটি জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষার নাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ঘাতকের বুলেটে তাঁর নির্মম মৃত্যুর শোক এ জন্যই কোনো একক ব্যক্তির মৃত্যুর শোক নয়, একটি জাতির ট্র্যাজিক মৃত্যুর বেদনায় মুহ্যমান জাতীয় শোক।

প্রতি বছর আগস্ট আসে, আমাদের অস্তিত্বের মর্মমূলে শেকড় ছিঁড়ে যাওয়ার বেদনা টের পাই। সেই বেদনায় হৃদয় ক্ষতাক্ত হয়ে ওঠে। আমাদের চেতনাপ্রবাহে কেবলি ভেসে বেড়ায় দিশেহারা নিজের এবং সবার অস্তিত্ব- আমরা ভাবতে থাকি, সেই পাকিস্তানি দুঃশাসনের কালে ডুবে যেতে যেতে একটি জাতি জেগে উঠেছিল যে মানুষটির অঙুলি হেলনে তাকেই হত্যা করেছিল পথভ্রষ্ট কিছু সৈনিকরূপী হায়েনা তাদের দেশি-বিদেশি দোসরের ইশারায়।

বাঙালি আজও, তাঁর মৃত্যুর ৪৬ বছর পরে শোকস্তব্ধ, ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে। হত্যাকারীরা একজন একক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল। এ জন্য যে, তিনি ছিলেন সমষ্টি ও সামগ্রিকতার প্রতিরূপ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক এবং পাকিস্তান নামের একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। মহাকালের খেরোখাতায় হত্যাকারী নয়, নিহত বঙ্গবন্ধু মহামৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়েই বেঁচে থাকবেন। 

২০২১ সালের আগস্ট আর পঁচাত্তরের আগস্টের মাঝখানে ৪৬ বছরের ব্যবধান। যে প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সময় তরুণ ছিল, তাদের ঘরেও এখন আরেকটি তরুণ প্রজন্ম। এই নতুন প্রজন্মের চেতনার গলি ঘুপচিতে লুকিয়ে রয়েছে বিকৃত ইতিহাসের কালো ছায়া। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসমনষ্ক করে গড়ে তুলতে হবে। তাদের জানাতে হবে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে রয়েছে। বর্তমানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে ডিজিটাল বাংলাদেশের শুভ সূচনা হয়েছে, তার ফলে বিশ্বের তাবৎ তথ্যভাণ্ডার এখন হাতের মুঠোয়। এই ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা শুধু কাগজে না রেখে এর সব সুবিধা ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুকে পৌঁছে দিতে হবে তরুণ প্রজন্মের কাছে। বঙ্গবন্ধু উঠে আসবেন ইতিহাসের মহান চরিত্র হয়ে আমাদের নাটকে, উপন্যাসে, গল্পে, কবিতায়, সিনেমায় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে। শোকস্তব্ধ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনাকে ধারণ করে বাঙালির আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের বর্তমান অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করতে হবে।

রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে সারা বিশ্ব যখন একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে, বাংলাদেশ নামের তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশ, যখন দারিদ্র্য ও মহামারির সঙ্গে লড়াই করছে; তখনো আমাদের সমষ্টিগত শক্তির প্রেরণা হয়ে থাকেন বঙ্গবন্ধু। কারণ বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান নামের একটি দানবিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। তাই একটি সংগ্রামী জাতির এই প্রত্যয় থাকা খুবই স্বাভাবিক, যে কোনো মহামারি ও মন্বন্তরের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার ক্ষমতা বাঙালির রয়েছে। বঙ্গবন্ধু বর্তমান বাংলাদেশ এবং প্রজন্মান্তরের বাংলাদেশের জন্য কেন প্রাসঙ্গিক এবং অনিবার্য, সেই বিষয়টি অনুধাবন করা প্রয়োজন। 

বঙ্গবন্ধু আজও প্রাসঙ্গিক এ জন্য যে, বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাঙালিকে স্বাধীনভাবে বাঁচবার এবং মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য একটি স্বাধীন দেশ তিনি এনে দিয়েছিলেন বলেই বাঙালি এখন মানুষরূপে দেশে এবং বিশ্বে পরিচিত। এই যে উদার ব্যপ্তি প্রকাশের ক্ষমতা তিনি এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করে তার চর্চা করলেই বাংলাদেশের প্রকৃত রূপটি চেনা সহজ হবে। তিনি এ জন্যও প্রাসঙ্গিক। এই যে একটি স্বপ্নের দেশ তিনি এনে দিলেন। এটিও বিবেচনায় রাখতে হবে যে, বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শিখিয়েছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে বাঙালির মননে ও বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাকে আজও প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশ শুধু স্বাধীন নয়, সমৃদ্ধির সুউচ্চ শিখরে পৌঁছাবে একদিন। সেই স্বপ্নপূরণ এখন যে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে- এ জন্য বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বপ্নপূরণের বাতিঘর হিসেবে বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও প্রাসঙ্গিক থাকবেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালির সহস্র বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সেই সংস্কৃতিবান জাতিরাষ্ট্র গঠনের সব প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির মদদপুষ্ট তৎকালীন মোশতাক, জিয়ার সরকার। কারণ যে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার মূলে কুঠারাঘাত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সরকারগুলো। তারা প্রথমেই ধর্মের জিকির তুলে এবং ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় ধরে টান দিল। বাঙালির জীবনযাপনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জাতিগত সম্প্রীতি জড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলতে চাইল। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু নিজে এবং এদেশের সব ধর্মের মানুষকে দেখিয়েছিলেন, যে স্বপ্নের প্রেরণায় ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, এদেশের সর্বস্তরের মানুষ তাকে নস্যাৎ করে দিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর। খন্দকার মোশতাক থেকে জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়ার শাসনামলে মৌলবাদী শক্তির ক্রমাগত যে উত্থান ঘটেছিল, তার অবলেশ এখনো বাংলাদেশের শাসন কাঠামোর ভেতরে-বাইরে সংগোপনে সক্রিয়। তার উচ্ছেদের জন্য যে শক্তি, সাহস ও প্রেরণার প্রয়োজন সে তো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ভেতরে নিহিত; কিন্তু বেদনার বিষয় যে, গোপনে যারা স্বাধীনতাবিরোধী তারা এখন ধুমিয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম যপ করে নানা জায়গায় প্রতিষ্ঠা করে নিচ্ছে। 

১৫ আগস্টে অন্ধকার রাতে মানবতাবাদী যে মহান নেতাকে পাকিস্তানি অন্ধকারে পরিপুষ্ট কুলাঙ্গার কিছু সৈনিক হত্যা করেছিল, যাদের পেছনে ছিল দেশ ও বিদেশের অপশক্তি- তারা শুধু একটি সময়ের প্রেক্ষাপটে একজন মানুষকেই হত্যা করেনি, তারা একটি পরিবারের নারী পুরুষ এবং শিশুকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তাই হত্যাকারীরা সেই সময়ে এবং পরবর্তী সময়ে কেড়ে নিয়েছিল বাঙালির শোক করবার অধিকার। ভয়াল আগস্টে রক্তাক্ত নিহত নেতা ক্রমাগত সূর্যস্পর্শী হয়ে উঠবে সে কথা তারা এবং তাদের নিয়ন্ত্রক বহিরাগত শক্তি জানত বলেই ১৫ আগস্টকে বানিয়েছিল খালেদা জিয়ার কল্পিত জন্মদিন। সারা জাতি যখন শোকস্তব্ধ, তখন এই নির্লজ্জ বেহায়াপনা তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বকে বড় অশ্লীলভাবে প্রকটিত করে। 

ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো কাল পরম্পরায় শক, হুন, পাঠান, মুঘল, ইংরেজ ও পাকিস্তানিদের আস্তাকুঁড়ে দিক চিহ্নহীন উড়েছিল যে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু তাদের এনে দিলেন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাব একটি শতাব্দীর উন্মুখ প্রতীক্ষার নাম। 


লেখক : প্রয়াত অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh