অর্থনীতি পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২২, ০২:৩৮ পিএম

শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইল ছবি

শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইল ছবি

ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও পরনির্ভরশীল রাখার নীতি গ্রহণ করেছিল। এমন দুর্বল অর্থনৈতিক অবকাঠামোও ধ্বংস হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধে।

একাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে ছিল একটি বিধ্বস্ত অর্থনীতি। যুদ্ধে অধিকাংশ সড়ক, সেতু ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল; আত্মসমর্পণের ঠিক পূর্বে পাকিস্তানি সেনারা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, অফিস-আদালত, দোকানপাট, সমুদ্রবন্দর, নৌবন্দর, রেললাইন সব ধ্বংস করে দেয়।

যুদ্ধোত্তর দেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে তাই প্রথমেই পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডে হাত দিতে হয়। বাস্তুহারা এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনের জন্য পাকবাহিনীর ভস্মীভূত করা ঘরবাড়ি পুননির্মাণ করতে হয়েছে। শত শত কিলোমিটার রাস্তা, শত শত কালভার্ট, পুল, ব্রিজ নির্মাণ ও সংস্কার করতে হয়েছে, বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিমানবন্দর মেরামত করতে হয়েছে, অচল সমুদ্রবন্দর সচল করতে হয়েছে, বন্ধ কলকারখানা চালু করতে হয়েছে। এমনকি স্বাধীন দেশের জন্য নতুন নোট ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছে।

স্বাধীনতার পর দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেছিলেন নানা পরিকল্পনা। ঘর নেই, বাড়ি নেই, বস্ত্র নেই, খাবার নেই, খাবার কেনার পয়সা নেই- চারদিকে শুধু হাহাকার। ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ থেকে প্রাপ্ত ১০০ কোটি ডলারের মতো অনুদানই ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের একমাত্র সম্বল।

ভাঙা রাস্তাঘাট এবং পরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতায় বিদেশ থেকে পাঠানো খাবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছানোও সম্ভব হচ্ছিল না। চট্টগ্রাম এবং মোংলা বন্দরে ডুবন্ত জাহাজ অপসারণ এবং মাইন মুক্ত করতে প্রায় দেড় বছর সময় লেগেছিল, এই কাজ করতে গিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার দু’জন বিশেষজ্ঞ নিহত হন। ফলে দেড় বছর সমুদ্রবন্দরে বিদেশি কোনো জাহাজ ভিড়তে পারেনি; বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি বন্ধ থাকায় শিল্প-কারখানা চালু করা সম্ভব হচ্ছিল না। কারখানায় শুধু কাঁচামালের অভাব নয়, বিদ্যুতের সরবরাহও ছিল না। রাশিয়ার সহায়তায় বিদ্যুতের ধ্বংসপ্রাপ্ত সাব-স্টেশনগুলো পুনর্নির্মাণ করতে এক বছর সময় ব্যয় হয়েছিল। বন্দর এবং বিদ্যুতের সাব-স্টেশন সচল হওয়ার পর কাঁচামাল আমদানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়, উৎপাদন শুরু হলে বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও আরম্ভ হয়। সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধুর সরকার ক্রেনসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি বন্দর দুটিতে সংস্থাপন করে আধুনিকায়নের পদক্ষেপ নেয় এবং নবগঠিত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ১৯টি জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেই ব্যাংকে কোনো নিজস্ব টাকা ছিল না, বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না, ছিল না কোনো স্বর্ণ বা রুপা। বাংলাদেশের নিজস্ব ছাপানো টাকা না থাকায় পাকিস্তানি রুপিতে ‘বাংলাদেশ’ সিল দিয়ে লেনদেন সচল রাখতে হয়েছিল। অবশ্য পাকিস্তানি সেনারা তাদের ছাপানো টাকাও অক্ষত রেখে যায়নি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা বের করে তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। সদ্য স্বাধীন দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার আর্থিক দীনতা এত প্রকট ছিল যে, তাদের দায় পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে বিদেশের ব্যাংকগুলো সন্দেহ পোষণ করত, ফলে দেশি ব্যাংকে স্থাপিত এলসিতে বিদেশি ব্যাংকের দায় পরিশোধের নিশ্চয়তা প্রধান অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অভ্যন্তরীণ রুটে কয়েকটি ফ্লাইট চালু করা সম্ভব হলেও একটি বোয়িং সংগ্রহ না করা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক রুটে নিজেদের কোনো ফ্লাইট ছিল না। পাকিস্তান আমলে যৌথ মালিকানায় অর্জিত বিভিন্ন সম্পদ ভাগাভাগি করতে পাকিস্তান অস্বীকার করায় বাংলাদেশ পাকিস্তান আমলের কিছুই পায়নি; অথচ পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে তাদের পাওনা আদায় করে নিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭৩ সালে হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ববাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির কারণে বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেল, সার, গম, চালসহ নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। অন্যদিকে যুদ্ধের বছর গোলাগুলির মধ্যে উৎপাদন প্রায় বন্ধ ছিল, যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব না হওয়ায় স্বাধীনতার পরের বছরও পূর্ণাঙ্গ চাষাবাদ শুরু করা সম্ভব হয়নি। এমন বিরূপ অর্থনীতির মোকাবেলায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবে না মর্মে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন। সবুজ বিপ্লবের আহ্বান জানান; বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুধু কৃষক সমাজ নয়, সর্বস্তরের মানুষ কৃষিজ উৎপাদনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে ঢাকার সরকারি কলোনির প্রতিটি ভবনের পাশে সবজি চাষের সমারোহ দেখেছি, দেখেছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সোনালি ধানের চাষ। বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশকে কৃষি অর্থনীতিতে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন, ভর্তুকি দিয়ে প্রায় বিনামূল্যে কীটনাশক ও সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ঘোষিত ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেটে কৃষিখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১০০ কোটি টাকা।

গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বগুড়ায় পল্লী উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষির উন্নতির জন্য বঙ্গবন্ধুর গ্রাম-প্রকল্পের মূলনীতি ছিল উৎপাদন বৃদ্ধি, সুষম বণ্টন, কর্মসংস্থান ও গ্রামের সামগ্রিক উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধু ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা ১০০ বিঘা নির্ধারণ করে দেন। তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা ছাড়াও সেচের মাধ্যমে সারাবছর ফসল উৎপাদনের সূচনা করেন। কৃষকদের কৃষি কাজে আগ্রহী ও উৎসাহ প্রদানার্থে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়, কম সুদহারে চাষিদের মাঝে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সূচিত দ্বিতীয় বিপ্লবে কৃষির আধুনিকায়নে সমন্বিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে সমবায় পদ্ধতিতে জমির আইল উঠিয়ে দিয়ে চাষাবাদের কথা বলা হলেও জমির ওপর ব্যক্তি মালিকানা অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছিল। আপদকালীন খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালেই ১০০টি খাদ্যগুদাম তৈরি করা হয়। লবণের ওপর থেকে কর তুলে নেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে যাতে পাকিস্তানি আমলের মতো কতিপয় ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ পুঞ্জীভূত না হয় সেজন্য বঙ্গবন্ধু পুঁজি বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তবে ব্যক্তিগত বিনিয়োগে শুধু পুঁজির অভাব নয়, দক্ষ উদ্যোক্তারও অভাব ছিল। কারণ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ব্যবসা-বণিজ্য, শিল্প, ব্যাংক-বীমা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হতো বিধায় বাঙালি সমাজে খুব বেশি উদ্যোক্তা এবং দক্ষ ব্যবস্থাপক তৈরি হয়নি, সুযোগও ছিল না। ফলে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবলের অভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কলকারখানাগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছিল না।

সমাজে বিরাজমান বৈষম্যমূলক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে শোষণমুক্ত অর্থনীতির কাঠামো বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রণীত সংবিধান ও দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। ১৯৭৩-৭৮ অর্থ বছরের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে- ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামোর পুননির্মাণ, কৃষি ও শিল্পের পুনর্গঠন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরতা কমানো, শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমদানি নির্ভরতা হ্রাস করা, দেশীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, আধুনিক চাষাবাদের মাধ্যমে খাদ্য-শস্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন, সমাজতন্ত্রের কল্যাণমূলক নীতির বাস্তবায়ন করে আয়-ব্যয়ের বৈষম্য কমানো ইত্যাদি।

বঙ্গবন্ধু আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দেশ পুনর্গঠনে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন; যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুননির্মাণে এই সময়টুকু ছিল খুবই কম। দুর্নীতি যা হয়েছে তার চেয়ে প্রচার হয়েছে বেশি। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল পণ্যের জন্য কাড়াকাড়ি খুব বেশি অস্বাভাবিক ছিল না। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য তখন চারদিকে শুধু ষড়যন্ত্র আর ষড়যন্ত্র- অর্থনীতির ভিত গড়ার জন্য একদিকে বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রম, অন্যদিকে কলকাতার নকশালদের রাজনীতি। আমদানি নির্ভর অর্থনীতিতে রপ্তানি পণ্য পাট পুড়ে ভস্মীভূত, মজুদদার-মুনাফাখোর-চোরাচালানি গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য, ভর্তুকির খাদ্যের বন্টনে অরাজকতা ইত্যাদি রোধ করা বঙ্গবন্ধু সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দেশের অভ্যন্তরে নানা ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে বৈরী অবস্থান গ্রহণ করে। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করতে চুয়াত্তরে দুর্বিষহ দুর্ভিক্ষ তৈরিতে সহায়তা করেছিল আমেরিকা, তাদের দেয়া ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যায় মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি, চীন অনুসারি বামপন্থী, জাসদের উগ্রপন্থীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। এদের সমন্বিত গোপন তৎপরতায় দেশব্যাপী শুরু হয় হত্যা, খুন, সন্ত্রাস, ব্যাংক লুট। এত সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের নিয়ে গঠন করেছিলেন পরিকল্পনা কমিশন।

স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের সমৃদ্ধির সম্ভাবনার বাস্তব রূপ দিতে সমর্থ হয়েছিলেন; কিন্তু পরিকল্পিত অর্থনৈতিক নীতি-পদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ার আগেই তিনি নির্মম হত্যার শিকার হন। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে হয়তো শুধু গ্রামীণ অর্থনীতি নয়, সমগ্র বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থারই ইতিবাচক পরিবর্তন আরও দ্রুততর হতো।


লেখক- সাবেক নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh