জুমার বয়ানে শুদ্ধতার আহ্বান

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২২, ০৯:০১ এএম

জুমার নামায আদায়ের সময় বায়তুল মোকাররম থেকে তোলা ছবি। ছবি: সংগৃহীত

জুমার নামায আদায়ের সময় বায়তুল মোকাররম থেকে তোলা ছবি। ছবি: সংগৃহীত

মুসলিম উম্মাহর কাছে জুমার দিন (শুক্রবার) একটি বিশেষ দিন। দিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাঞ্জেগানা মসজিদ, বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত কিংবা দোকানপাটে পড়া গেলেও জুমার নামাজ জামে মসজিদেই পড়তে হয়। এদিন মুসলিম বিশ্বের মসজিদে-মসজিদে ধনী-গরিব, ছোট-বড় সব শ্রেণির মুসলমানের সমাবেশ ঘটে। জুমার দিনকে সম্মিলনের দিনও বলা হয়।

জুমার নামাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়। জুমার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘খুতবা’। আরব দেশগুলোতে শুধু আরবি ভাষায় খুতবা দেওয়া হয়। আরবিতে খুতবা পড়া ও শোনা ওয়াজিব বা অবশ্যপালনীয়। তাই এটা কখনো পরিত্যাগ করা যাবে না। বাংলাদেশসহ অন্য অনারব দেশগুলোতে আরবি মূল খুতবার আগে মুসল্লিদের বোঝার জন্য নিজ নিজ মাতৃভাষায়ও বয়ান করা হয়। সাধারণত আরবি খুতবার বিষয়বস্তুর আলোকেই ভাষান্তর বা ভাবান্তর করা হয়। আর খুতবাও হয়ে থাকে সমসাময়িক বিষয় নিয়েই।

জুমার নামাজের আগে বয়ান করা সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর যুগেও ছিল। বয়ানের গুরুত্ব তুলে ধরে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দান করবে। তারাই হলো সফলকাম’ (সুরা আলে ইমরান : আয়াত-১০৪)। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা একটি আয়াত হলেও আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও’ (তিরমিজি)।

জুমার বয়ান হতে পারে অপরাধ ও কুসংস্কারমুক্ত ইসলামী আদর্শ সমাজ গড়ার মাধ্যম। মসজিদের খতিব, মুসল্লি, বিশেষত মহল্লাবাসী ও মসজিদ কমিটি সম্মিলিতভাবে চাইলেই এর বাস্তবায়ন অসম্ভব কোনো বিষয় নয়। মসজিদ কমিটিকে একজন হকপন্থি যোগ্য আলেমকে খতিব হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। যিনি কোরআন-হাদিসের আলোকে ইসলাম, সমাজ ও মানুষের অসঙ্গতিগুলো পর্যায়ক্রমে প্রতি জুমায় তুলে ধরবেন। যেমন- সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, যৌতুকপ্রথা, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, কুসংস্কার, মাদকাসক্তি, যুবসমাজের অধঃপতন, ইসলাম ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমকালীন প্রসঙ্গ ইত্যাদি। 

মক্কা মোকাররমার মসজিদে হারাম এবং মদিনা মোনাওয়ারার মসজিদে নববীর জুমার খুতবায়ও সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এছাড়া কোরআন-হাদিসের আলোকে দুনিয়ার জীবন, পরকালের জীবন, জান্নাতের শান্তি, জাহান্নামের শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে তো আলোচনা করবেনই। 

মোটকথা, খতিব প্রচলিত নিয়মে আলোচনার নির্দিষ্ট বিষয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে ইসলামের সার্বিক বিষয় পর্যায়ক্রমে মুসল্লিদের মাঝে তুলে ধরবেন। এক্ষেত্রে মুসল্লিদেরও আগেভাগে মসজিদে গিয়ে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এভাবে প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা শুনতে শুনতে মুসল্লিদের ইসলাম সম্পর্কে জানার পরিধি বাড়বে। ইসলাম ও সমাজের অসঙ্গতিগুলো দূর হতে থাকবে।

জুমার আজানের পর জুমার নামাজ ছাড়া অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আর জুমার দিন জুমার নামাজে আগেভাগে হাজির হওয়া এবং মনোযোগ সহকারে জুমার বয়ান ও খুতবা শোনার বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন ফরজ গোসলের মতো গোসল করে নামাজের জন্য আসে, সে যেন একটি উট কোরবানি করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি গাভী কোরবানি করল। যে ব্যক্তি তৃতীয় পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি শিংবিশিষ্ট দুম্বা কোরবানি করল। যে ব্যক্তি চতুর্থ পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি মুরগি কোরবানি করল। যে ব্যক্তি পঞ্চম পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি ডিম কোরবানি করল। পরে ইমাম যখন খুতবা প্রদানের জন্য বের হন, তখন ফেরেশতারা জিকির শোনার জন্য হাজির হয়ে থাকেন।’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি)।

কিন্তু অনেক মসজিদে মুসল্লিরা সময়ক্ষেপণ করে মসজিদে এসে থাকে, ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খতিব যথাসময়ে বয়ান শুরু করতে পারেন না, কিংবা মোটেও বয়ান করা হয়ে ওঠে না। আবার গ্রামের কিছু মসজিদে বলতে গেলে বয়ানই হয় না। হয়তো খতিব সেভাবে কথা বলতে অভ্যস্ত নন অথবা খতিব-মুসল্লি কেউই এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেন না। মুসল্লিরা অযথা বসে থেকে গল্পগুজব করে সময় নষ্ট করেন, এমনটি করা মোটেও উচিত নয়। 

আলহামদুলিল্লাহ, দেশের কিছু মসজিদে বিশেষ করে রাজধানী, জেলা ও থানা শহরের বিভিন্ন মসজিদে একদল যোগ্য তরুণ আলেম-খতিব বয়ানের এই উপকারী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন প্রতিকূলতা এড়িয়ে এই ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। সমাজের সাধারণ মানুষ এর মাধ্যমে অনেক উপকৃত হচ্ছেন। মুসল্লিদেরও তারা সেভাবে গড়ে তুলেছেন।

আমরাও যদি সমাজ বদলের এই মিছিলে শামিল হতে চাই, তাহলে মুসল্লিদের সাথে পরামর্শ করে বয়ানের সময় ঠিক করে নেওয়া যায়। সহজ পদ্ধতি হলো, প্রথম আজানের পর বয়ান শুরু করবেন, মুসল্লিরা এসে নীরবতার সাথে বয়ান শুনবেন। খুতবার পাঁচ-দশ মিনিট আগে তা শেষ করে মুসল্লিদের সুন্নত পড়ার সুযোগ দেবেন। এরপর খতিব সাহেব আজানের পর আরবি ভাষায় দুটি খুতবা দিয়ে সাথে সাথে নামাজ পড়াবেন। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১২/৩৮৬-৩৯২)।

ইসলামের আলোকে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে দেশের প্রতিটি জুমা মসজিদে ইলম ও আমলদার সহি আকিদার যোগ্য আলোচক খতিব নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন এবং খতিবদেরও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী যুগোপযোগী বয়ান করা কর্তব্য। বিশেষ করে বর্তমানে নৈতিকভাবে অধঃপতনের শিকার আমাদেরকে পরিশুদ্ধ করা ও মানুষের মনে পরকালীন ভয় বিস্তারে খতিবদের জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh