নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:২৭ এএম | আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০১:৩৬ পিএম
ব্যাটারিচালিত রিকশা। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর প্রত্যেকে এলাকার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এসব সড়কগুলো রাজধানীর প্রধান সড়কের সাথে মিলিত হয়। প্রধান সড়ক ছাড়া এমন কোনো স্থান অবশিষ্ট নেই যেখানে এসব রিকশা চলছে না। এলাকাগুলোর প্রবেশমুখে ভিড় করে থাকে এসব রিকশা। এসব যানবাহনের চালকদের নেই কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স, নেই কোনো প্রশিক্ষণ। এমনকি তারা কোনো ট্রাফিক আইনের ধারও ধারেন না। তারা বেপরোয়া গতিতে রিকশা চালিয়ে থাকেন। এতে করে রাস্তায় বেড়েই চলেছে বিশৃঙ্খলা, যানজট ও দুর্ঘটনা। এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা রাজধানীবাসীকে প্রতিনিয়ত অসহনীয় ভোগান্তি উপহার দিয়ে চলেছে।
সাধারণ রিকশাচালকরা বলছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশায় কম পরিশ্রমে বেশি আয় হয়। পায়েচালিত রিকশা যতটুকু দূরত্বে ৪০ টাকা হাঁকে, সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা ২০ থেকে ২৫ টাকায় রাজি হয়ে যায় এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছায়। এতে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা আরেকবার যাত্রী নিতে পারেন। তাদের মদ্যে একটা তাড়াহুড়ো থাকে। যার ফলে ঘটে দুর্ঘটনা।
তবে দ্রুত গন্তব্য পৌঁছানো, অধিক যাত্রী পাওয়ার আশায় চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এবং ওভারটেকিংয়ের প্রবণতার বিষয়টি ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন।
মিরপুরের ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক আবদুর রহমান বলেন, ‘ব্যাটারির রিকশা সারাদিন চালানো লাগে না। আধবেলা চালালেই ১৫-১৬টা ট্রিপে ৫০০ টাকার মতো থাকে।’
অবৈধ হওয়ার পরও ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান কেন—এমন প্রশ্নে রহমান বলেন, ‘এখন গ্যারেজগুলাতে ব্যাটারি রিকশা বেশি। আর এই রিকশা চালাতেও আরাম। অবৈধের বিষয়টা গ্যারেজ মালিক জানে।’
ব্যাটারিচালিত রিকশা লোহা দিয়ে তৈরি। তাই এ রিকশা টেকসই বেশি। দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। এছাড়া এই রিকশা পুনরায় বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যায়। এসব কারণে রিকশার মালিকরা ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রতি আগ্রহী বলে জানান ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রস্তুতকারক বাবুল।
তিনি জানান, এসব রিকশা ৬৫ হাজার থেকে এক লাখের মধ্যে পাওয়া যায়। তবে এসব রিকশা কোনো বৈজ্ঞানিক নকশায় বানানো হয় না। রিকশার মালিকদের প্রয়োজন অনুযায়ী নকশায় বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয় বলে জানান বাবুল।
তিনি বলেন, ‘আমরা রিকশার বডি স্থানীয় ওয়ার্কশপ থেকে বানিয়ে আনি। ব্যাটারি আরেক জায়গা থেকে কিনে আনতে হয়। আমি সবগুলা একসাথে সেট করে বিক্রি করি।’
ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিক্যের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন পথচারীরা। তাদের অভিযোগ, এলাকার ভেতরের রাস্তাগুলো এমনিতেই সরু, তার ওপর ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো এখন আকারে বড় করেছে। ফলে এলাকার প্রবেশমুখেই তৈরি হয় জ্যাম। এছাড়া এলাকার ভেতরে এসব রিকশার বেপরোয়া গতি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা রাস্তা পার হতে গিয়ে অসুবিধায় পড়ছেন।
‘অটোরিকশা সড়কের চলমান যমদূত’, এমনটা মন্তব্য করে বাইকচালক বাধন বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা তাদের খেয়াল-খুশিমতো চলে। অন্য যানগুলোকে তোয়াক্কাই করেন না। তাদের চাইতে আমাদেরই বেশি সতর্ক থাকতে হয়। কোনো লুকিং গ্লাস নাই, যখন-তখন রিকশার মোড় ঘুরিয়ে দেন চালকরা। পুরো রাস্তা দখল করে ওভারটেকিং করা তো তাদের কাছে এখন স্বাভাবিক বিষয়।’
না চাইলেও ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহার করতে হয় বলে দাবি বেশিরভাগ যাত্রীর। তাদের মতে, এখন রাস্তায় আর পায়েচালিত রিকশা খুঁজেই পাওয়া যায় না। আবার অনেক যাত্রী ভাড়া কম ও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যায় বলে এই রিকশা ব্যবহার করেন। তবে ঝুঁকির বিষয়টাকেও বড় করে দেখছেন যাত্রীরা।
মিরপুর কাজিপাড়ার বাসিন্দা মুয়াজ বলেন, ‘আমাদের এলাকার মূল সড়ক হলো ১৪ ফুট, কোনও ফুটপাত নেই। এর মধ্য দিয়েই সব ধরনের গাড়ি চলে, মানুষও চলে। সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশার যে গতি, একটু অসতর্ক হলেই দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।’
একই অবস্থা রাজধানীর অন্যান্য এলাকার। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশার সমস্যার সমাধান হিসেবে সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন বলে সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘রাজধানীতে এখন অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষ হেঁটে চলাচল করে। কিন্তু তাদের জন্য বেশিরভাগ এলাকার সড়কগুলোয় নেই কোনো ফুটপাত। বাধ্য হয়েই যান চলাচলের সড়কেই পথচারীদের হাঁটতে হয়। এটা ঝুঁকিপূর্ণ।
রিকশার পরিবর্তে এলাকাগুলোতে আধুনিক ইলেকট্রিক মিনিবাস চালুর পরামর্শ দিয়ে মো. হাদিউজ্জামান বলেন, এখন যেমন ১০ জন যাত্রী ১০টি ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহার করছে, ইলেকট্রিক মিনিবাস-ব্যবস্থা চালু করলে সড়কে ১০টা রিকশার জায়গায় একটা যান চলবে। এতে রাস্তাগুলোয় বেশ জায়গা পাওয়া যাবে। এছাড়া বিদ্যুৎ ব্যয়ও কম হবে। এলাকাভিত্তিক যানগুলো তখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে; যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এসব রিকশার ক্ষেত্রে নেই।