নতুন ‘ড্যাপ’ কার্যকর হওয়ায় কতটা বদলাবে ঢাকা

হাসান হামিদ

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:৩৭ এএম

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরসহ রাজউকের আওতাধীন এলাকাকে বাসযোগ্য করতে গ্রহণ করা হয়েছে ২০ বছর (২০১৬-২০৩৫ সাল) মেয়াদি ড্যাপ অর্থাৎ ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান। বর্তমানে রাজউকের আওতাধীন এলাকা ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ, সাভার এবং গাজীপুরের একাংশ রাজউকের আওতাভুক্ত। রাজউকের এই অঞ্চল নিয়ে করা নতুন ড্যাপ সংক্রান্ত একটি গেজেট গত ২৩ আগস্ট গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে কার্যকারিতা হারিয়েছে ২০১০ সালে পাস হওয়া ড্যাপ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন গেজেট হওয়া ড্যাপ ঢাকার ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য প্রণীত যার মেয়াদ থাকবে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। তাই এটি রাজউকের আওতাধীন এলাকাবাসীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, রাজউকের আওতাভুক্ত ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য ঢাকা মহানগর এলাকার ড্যাপের (২০১৬-২০৩৫) খসড়া প্রকাশ করা হয় ২০২০ সালে। এরপর সবার কাছে আহ্বান জানানো হয় খসড়ার উপর সুপারিশ ও আপত্তি দাখিলের জন্য। সকল আপত্তি ও সুপারিশ বিবেচনার পর মহাপরিকল্পনাটি অনুমোদন করা হয়েছে। গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সম্প্রতি এটি কার্যকর হলো। পাশাপাশি এর মধ্য দিয়ে ২০১০ সালে পাস হওয়া ড্যাপ রহিত হয়েছে। কিন্তু প্রজ্ঞাপন প্রকাশের আগপর্যন্ত ২০১০ সালের ড্যাপের অধীনে যেসব কাজ সম্পন্ন হয়েছে বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বৈধ বলে গণ্য হবে। নতুন ড্যাপ কার্যকর হওয়াতে অনেকটাই আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য ও আধুনিক নগরী গড়ার পরিকল্পনায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তথা রাজউক গঠিত হলেও ভবন নির্মাণে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি এই সংস্থাটি। এবার নতুন করে যত্রতত্র স্কুল-কলেজ, মার্কেট, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধসহ ঢাকাকে দৃষ্টিনন্দন ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা-ড্যাপ সংশোধন করা হয়েছে। এটা আশার কথা।

জানা যায়, নতুন ড্যাপে সড়ক, নৌপথ ও রেলপথকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ভূমি পুনর্বিন্যাস ও পুনঃউন্নয়ন, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ডভিত্তিক জনঘনত্বের বিষয়ে দিকনির্দেশনাও আছে এই ড্যাপে। তাছাড়া এলাকাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্যুয়ারেজসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা সরবরাহে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। নতুন পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, রাজউকের আওতাধীন এলাকায় সরকার এখন থেকে প্লটভিত্তিক উন্নয়নের পরিবর্তে ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করবে। তাছাড়া আবাসিক ভবনের উচ্চতার ক্ষেত্রেও থাকবে না আর কোনো বিধিনিষেধ। তবে কোনো এলাকার রাস্তার প্রশস্ততা এবং নাগরিক সুবিধা যেমন- পার্ক, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রভৃতি বিবেচনায় রেখেই বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করতে হবে। এত দিন রাজউকের আওতাধীন এলাকায় সর্বোচ্চ ৮ তলা পর্যন্ত উচ্চতার ভবন নির্মাণের বিধিনিষেধ ছিল। নতুন ড্যাপে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনে ৫টি বৃহৎ আঞ্চলিক পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি ২৮৭টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৬২৭টি স্কুল, ৮টি ইকোপার্ক, ৪৯টি জলকেন্দ্রিক পার্ক এবং খেলার মাঠসহ বিনোদনের জন্য বেশ কিছু স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তদের সাশ্রয়ী আবাসনের ব্যবস্থার জন্যও স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে।

ড্যাপ সূত্র বলছে, বিশ্বের সব পরিকল্পিত শহরের জনঘনত্ব প্রতি একরে ৮০ জনের নিচে। নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনের জনঘনত্ব যেখানে ১১২ এবং অন্যান্য এলাকার ঘনত্ব প্রতি একরে ৬০-এর নিচে; সেখানে ঢাকার লালবাগ, বংশাল, সবুজবাগ, গেন্ডারিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার জনঘনত্ব প্রতি একরে ৭০০ থেকে ৮০০ জন বা তারও বেশি। আর এই ঘনত্ব পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব ভেবেই রাজউকের আওতাধীন এলাকায় জনঘনত্বকে বিবেচনা করে ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজউক বলছে, বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা শহরের অতি নিম্ন অবস্থানের অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং অধিক জনঘনত্ব। তাই ঢাকার বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে নাগরিক সুবিধাদি ও পরিষেবার বিপরীতে জনসংখ্যা নির্ধারণ করেই ভবনের উচ্চতা নির্ধারণের সুপারিশ হয়েছে।

নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক নগর পরিকল্পনা অনেক দূর এগিয়ে গেলেও দেশের নগর এলাকায় সঠিক পরিকল্পনার ধারণা এখনো সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। বাসযোগ্য নগর গড়তে জনঘনত্ব পরিকল্পনার বিষয়টি উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও ঢাকাসহ দেশের অন্য নগর এলাকার পরিকল্পনায় এই মৌলিক বিষয়টি অনুপস্থিত। এ কারণে শহরের বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা শহর অতি নিম্নমানে অবস্থানের অন্যতম কারণও এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অধিক জনঘনত্ব। আর নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় জনসংখ্যা, জনঘনত্ব এবং শহরের বিদ্যমান অবকাঠামো ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সাপেক্ষে শহরের ভারবহন ক্ষমতা বিবেচনা না করা হলে যে কোনো শহর তার বাসযোগ্যতা হারাবে। ঢাকা যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই হাতে নেওয়া পরিকল্পনা অতিদ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার।

এ বিষয়ে ড্যাপ পরিচালক ও রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০১৬-৩৫) প্রণয়নে জনঘনত্ব পরিকল্পনার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যা বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। এই মহাপরিকল্পনায় ব্লক-বেসড উন্নয়ন, মেট্রো স্টেশনের আশেপাশে ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে জনঘনত্বের ইনসেনটিভ দেওয়ার প্রবিধান রয়েছে। এছাড়া সময়ের বিবর্তনে একটি এলাকার নাগরিক সুবিধাদি ও সড়ক নেটওয়ার্কের উন্নতি ঘটলে অধিক জনঘনত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য গড়ে ৬৫০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প এই মহাপরিকল্পনায় রয়েছে। শহরের বৃহৎ স্বার্থে জনঘনত্ব শিথিল করা হয়েছে, তবে সাধারণভাবে এলাকাভিত্তিক নাগরিক সুবিধার অনুপাতে জনঘনত্ব হিসাব করা হয়েছে। তাছাড়া ঢাকাকে বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে এলাকা ভিত্তিক রাস্তা প্রশস্তকরণ, স্কুল, কলেজ ও নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যে এলাকায় জনঘনত্ব জোনিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। রাস্তার প্রশস্ততা অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা নির্ধারিত হবে। যেখানে বহুতল ভবনসহ সব উচ্চতার ভবন নির্মাণের সুযোগ থাকবে।

রাজউক সূত্র বলছে, কোনো প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয় শুধু ভবনের সামনের রাস্তার ভিত্তিতে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করে। কিন্তু নগর পরিকল্পনার দৃষ্টিকোণ থেকে একটি প্লটের উপর নির্মিত ভবনের আকার-আয়তন কেমন হওয়া উচিত তা শুধু প্লটসংলগ্ন রাস্তার প্রশস্ততার উপর নির্ভর করে না। এক্ষেত্রে সেই নগর এলাকার পরিকল্পনা সম্পর্কিত অবকাঠামো ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। এর মধ্যে সড়ক অবকাঠামো, সামাজিক সুবিধা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বাজার, উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠ, পার্ক, উদ্যান, জলাশয় ও জলাধার অন্যতম। এসব নিশ্চিত হলে ওই এলাকার ভারবহন ক্ষমতা নির্ণয় করে সর্বোচ্চ জনসংখ্যা নির্ধারণ করবার মাধ্যমে সেই এলাকার জনঘনত্ব নির্ধারণ করে প্রতি প্লটে কী পরিমাণ পরিবার বা মানুষকে ধারণ করা যেতে পারে সে ব্যাপারে পরিকল্পনার কৌশল ও পন্থা নির্ধারণ করা হয়। আর নতুন ড্যাপে এসবই রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করতে হলে এর জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। এছাড়া ঢাকার খোলা জায়গা, জলাভূমি কমে যাওয়ার ফলে এবং পরিকল্পনামাফিক অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধাদি তৈরি না করায় জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা কমে গিয়েছে। তাই এলাকাভিত্তিক জনঘনত্বকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে নতুন ড্যাপে।

ড্যাপ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারির আগে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) বলেছিল, ড্যাপের কারণে নির্মিতব্য ভবনসমূহের আয়তন বা উচ্চতা কমার কারণে নির্মিতব্য ফ্ল্যাটের সংখ্যা কমে যাবে। অন্যদিকে একই এলাকায় তার পাশের জমিতেই নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী ইতিমধ্যে নির্মাণ হয়ে গেছে অধিক সংখ্যক ফ্ল্যাটসহ ৮ থেকে ১০ তলা ভবন। যার ফলে বৈষম্য তৈরি হবে জমির মালিকদের মধ্যে। কিন্তু এ বিষয়ে রাজউকের প্রকল্প পরিচালক (ড্যাপ) আশরাফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে কোনো পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। শহরের দুই কোটি মানুষের স্বার্থ চিন্তা করেই ড্যাপ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোনো শহরে নির্বিঘ্নে চলাচল করার জন্য ২৫ ভাগ রাস্তার দরকার হয়, বর্তমানে ঢাকায় ৬ ভাগ রাস্তা আছে। সবার বাসযোগ্য করার জন্যই এসব পদক্ষেপ।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ঢাকাকে পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে প্রথম মাস্টার প্ল্যান তৈরি হয় ১৯৫৯ সালে। এই পরিকল্পনার মেয়াদ শেষের পর ১৯৯৫ সালে নতুন আঙ্গিকে ঢাকা শহরের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। আর এটি পরিচিত ছিল স্ট্রাকচার প্ল্যান নামে। ১৯৯৬ সালে অনুমোদিত এই পরিকল্পনার মেয়াদ নির্ধারণ হয় ২০১৫ সাল পর্যন্ত। ২০০৭ সালে ঢাকা শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য ড্যাপ তৈরি করা হয়। ২০১৫ সালে স্ট্রাকচার প্ল্যানের মেয়াদ শেষের পর নতুন প্ল্যানের কাজ শুরু হয়। সড়ক, রেল ও নৌপথের সমন্বয়ে বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বর্তমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ)।

জানা যায়, ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে করা এ পরিকল্পনায় ২ হাজার ৭৪৯ কিলোমিটার সড়কপথ উন্নয়ন করা হবে। পাশাপাশি দুই দফায় ১ হাজার ৩২৭ কিলোমিটার জলপথও উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য অবকাঠামো হিসেবে নেওয়া এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ভূমিকা রাখবে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নেও।   

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh