সচিবের বই নিয়ে কেন ট্রল

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৫০ এএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

সরকারি কর্মকর্তাদের ‘জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস’ বাড়ানোর জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকার যে বই বরাদ্দ দিয়েছে, এর মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নবীরুল ইসলাম বুলবুলের বই রয়েছে ২৯টি।

গত শনিবার (২৭ আগস্ট) প্রথম আলোতে এই সংবাদটি প্রকাশের পর দিনভর এ নিয়ে ফেসবুকে ট্রল হয়। নানা শ্রেণিপেশার মানুষ, এমনকি সমাজের বিশিষ্টজনরাও এই ঘটনার সমালোচনা করেন, রসিকতা করেন। অনেকে এই অখ্যাত লেখককে বাংলা একাডেমি, একুশে, এমনকি স্বাধীনতা পদক দেওয়া উচিত বলেও টিপ্পনী কাটেন। প্রশ্ন হলো, একজন অতিরিক্ত সচিবের এই বইকাণ্ড নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ কেন ট্রল করল? তিনি আসলে কী লিখেছেন? এতগুলো বই লিখলেন, অথচ দেশের মানুষ এতদিন তার নামই শুনল না, আবার তার সেই বইগুলো সরকারিভাবে কেনার সিদ্ধান্ত হলো কেন- এসব প্রশ্নও সামনে আসে।  

পাঠকের মনে আছে, জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গত ১৫ মার্চ এ বছরের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য ১০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করে সরকার। এতে সাহিত্যে অবদান রাখায় মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার পান কবি আমির হামজা। কিন্তু নামটি ঘোষণার পরপরই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। প্রথম দিকে বাংলা সাহিত্যে তার অবদান নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। একপর্যায়ে হত্যা মামলায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে বসে খোদ সরকার। এরপর তার ছেলে আছাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা হয়। ব্যক্তিগত শুনানিসহ সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ হলে তাকে তিরস্কার করে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়। 

বাংলাদেশের সরকার কাঠামো মূলত আমলানির্ভর। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন করলেও সেই আইনের খসড়া তৈরি করে দেন আমলারা। বলা হয়, রাজনীতিবিদদের অদক্ষতার সুযোগ নিয়ে আমলারা ক্ষমতাবান হয়েছেন এবং একসময় রাজনীতিবিদরা যেমন আমলাদের উপর খবরদারি করতেন, এখন সেটি উল্টে গেছে। এ নিয়ে খোদ জাতীয় সংসদে অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ সমালোচনা করেছেন। 

কিন্তু এ প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই যে, সরকার কেন এভাবে অতিমাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে গেল? স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদের মতে, রাজনীতিবিদরা নিজেরাই আমলাদের হাতে রাজনীতি তুলে দিয়েছেন। বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের জয় নির্ভর করে সরকারি কর্মকর্তাদের উপর। ফলে আমলারা জনপ্রতিনিধিদের উপর হুকুম চালাচ্ছেন। বাস্তবে যা হওয়া উচিত ছিল উল্টোটা (ডেইলি স্টার, ২৮ আগস্ট ২০২২)।

তবে যেভাবেই হোক, দেশের সরকার যে অতিমাত্রায় আমলানির্ভর, তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ কম। তারা যখন যেভাবে প্রয়োজন নিজেদের সুবিধা আদায় করে নেন। সেই হিসাবে সরকারি ক্রয়তালিকায় নিজের লেখা ২৯টি বই ঢুকিয়ে দেওয়া খুব বড় ঘটনা নয় নিশ্চয়ই। তাহলে সমালোচনা হচ্ছে কেন? সমালোচনা হচ্ছে কারণ ক্ষমতার অপব্যবহার। 

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির, অর্থনীতিবিদ ও লেখক আকবর আলি খান, কবি কামাল চৌধুরী, সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, সদ্য প্রয়াত সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারসহ আরও অনেক খ্যাতিমান লেখকও আমলা ছিলেন। তাদের মধ্যে প্রভাবশালী আমলাও ছিলেন। যারা ভালো লেখেন, পাঠক তার পেশাগত পরিচয় খোঁজে না। কিন্তু যাকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে সেই নবীরুল কী লিখেছেন? ২৯টি বই লিখলেন, তার কনটেন্ট কী? গণমাধ্যমের খবর বলছে, নবীরুল ইসলামের যেসব বই ক্রয়ের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তার অধিকাংশই কবিতার বই। যিনি এতগুলো কবিতার বই লিখলেন, তার নাম এত বছরেও দেশের মানুষ কেন জানল না? হতে পারে নিভৃতচারী লেখক? কিন্তু তিনি আসলে কী লেখেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় তার কবিতার কিছু নমুনাও দেখা গেছে। যেগুলোকে কবিতা বলা যায় কি না- তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তার মানে এটি খুবই স্পষ্ট যে, তিনি মূলত এসব বই লিখেছেন সরকারিভাবে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা কামানোর জন্য। হয়তো তিনি জানেন বা বোঝেন যে তার লেখার যে মান, সেগুলো দেশের স্বনামধন্য কোনো পত্রিকা ছাপবে না। ফলে তিনি সেগুলো বই আকারে প্রকাশ করেছেন। পয়সা কামানোর পাশাপাশি লেখক হিসেবে নিজের কমিউনিটিতে আলাদা মর্যাদা পাওয়া এবং সরকারের সুনজরে থাকার উদ্দেশ্য থাকাও অসম্ভব নয়।

বাস্তবতা হলো, সাবেক আমলা শহীদুল জহির বা আকবর আলি খানের মতো লেখকের সবগুলো বইও যদি সরকারি ক্রয় তালিকায় থাকত, তা নিয়ে মানুষ কোনো সমালোচনা তো করতই না, বরং বিষয়টি প্রশংসিত হতো। কিন্তু নবীরুল ইসলাম বা তার মতো আরও যেসব লেখকের বই সরকারি ক্রয় তালিকায় থাকে, সেসব বই কি আদৌ কেউ পড়ে? জনগণের অর্থে এসব ছাইপাঁশ কিনে একদিনে জন-অর্থের অপচয় যেমন হয়, তেমনি এসব বই কেনার যে মূল উদ্দেশ্য, পাঠাভ্যাস বাড়ানো, সেটিও ব্যাহত হয়। 

ফলে যখনই তাদের একজন প্রভাবশালী আমলা প্রভাব খাটিয়ে নিজের বই কিনতে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বাধ্য করেন এবং এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়, তখনই সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। আমলাদের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদ ও জনসাধারণের যে ক্ষোভ, সম্ভবত সেটিরই বিস্ফোরণ হলো একজন অতিরিক্ত সচিবের বইকাণ্ডে। তবে যে দেশে এখন শত কোটির নিচে দুর্নীতি হয় না, সেই দেশে ৮-৯ কোটি টাকার বই কেনার প্রকল্পে আর কত টাকাই বা লুটপাট হবে- এই প্রশ্নও সোশ্যাল মিডিয়ায় আছে। 

বাস্তবতা হলো, শুধু আমলা নন, রাষ্ট্রীয় কেনাকাটায় নিজের অখাদ্য বই গছিয়ে দেওয়ার কাজ আরও অনেকেই করেছেন, করেন। সাংবাদিক মশিউল আলম লিখেছেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি অর্থে পাঠ্যবইয়ের বাইরের (সৃজনশীল) বই কেনা শুরু হলে প্রথম বছরেই সরকারপন্থি একাধিক লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ অতিরিক্ত দাম রেখে মোটা মোটা বই ছাপিয়ে সরকারি ক্রয় প্রকল্পে বিক্রি করেছিলেন। সে সময় সংবাদপত্রে এ নিয়ে অনিয়মের কিছু খবর ছাপা হয়েছিল, কিন্তু শীর্ষ অনিয়মকারীদের কেউ কেউ এত প্রভাবশালী ছিলেন যে তাদের নাম মুছে দিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। কারণ তাদের কেউ ছিলেন সংবাদপত্রের সম্পাদকের বন্ধু, কেউ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুনজরপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী।’

একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নিশ্চয়ই অনেক প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। যিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের ২৯টি বই সরকারি ক্রয় তালিকায় ঢুকিয়ে দিতে পারেন, তিনি আরও বড় কোনো প্রকল্পের অর্থ ছাড় ও অনুমোদনের সময় কতটা সৎ ও নির্লোভ থাকতে পারেন, সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। 

এ রকম বাস্তবতায় গণমাধ্যমের খবর বলছে, তালিকায় নবীরুলের বই রাখা ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘লিস্টে আছে নাম। এটা চূড়ান্ত হবে না। এটা আমরা দেখছি, এটার বিষয়ে অবশ্যই আমরা একটি সিদ্ধান্ত নেব।’ (নিউজবাংলা, ২৮ আগস্ট ২০২২)।

শেষ পর্যন্ত হয়তো এই কেনাকাটা থেকে নবীরুল ইসলামের বইগুলো বাদ পড়বে। প্রশ্ন হলো, ফেসবুকে এ নিয়ে সমালোচনা না হলে কি এই ঘটনা ঘটত? রাষ্ট্রের সমস্যা তো শুধু একজন অতিরিক্ত সচিবের ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের ২৯টি বই বিক্রির ব্যবস্থা করাই নয়। বরং দেশে আরও অনেক বড় বড় সমস্যা এবং হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। কিন্তু সব ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা বা ট্রল হয় না এবং এইসব সমালোচনার মধ্য দিয়ে সব সমস্যার সমাধানও হয় না।

প্রশ্ন হলো, এই বইকাণ্ডটি যদি একজন অতিরিক্ত সচিবের না হয়ে ক্ষমতাসীন দলের বড় কোনো নেতার ক্ষেত্রে হতো, তাহলে কি সাধারণ মানুষ এবং সমাজের বিশিষ্টজনরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তোলার সাহস পেতেন? তার মানে বিষয়টা কি এমন যে, মানুষ কোনো কিছু নিয়ে ট্রল করা বা প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে সেটি নিয়ে আইনি, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে- সেটি বিবেচনায় রাখে?

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh