শানু মোস্তাফিজ
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:২৫ এএম | আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০২:৫০ পিএম
শানু মোস্তাফিজ
ভারতের জোড়হাটের ডেপুটি কমিশনারের কাছে বিশজন চা শ্রমিক এসে বলে, আমাদের এক বছরের কাজ করার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল। এক বছর শেষ হয়েছে। আমরা এখন বাড়ি যেতে চাই। কেননা এ সময় যে মজুরি দেওয়া হয় তা থেকে তারা আধা পয়সাও জমাতে পারেনি। তাই তারা আর থাকতে চায়নি।
কমিশনার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে জানায়, তোমরা কাজে যাও। কেউ বাড়ি যেতে পারবে না। কিন্তু রাজি হয় না এবং বাড়ির পথে হেঁটেই রওনা দেয়। এভাবে যখন অনেক শ্রমিক কাজ ছেড়ে বাড়ির পথে রওনা দেয় তখন তাদেরকে আটকানোর জন্য করিমগঞ্জের রেলস্টেশনে খবর দেওয়া হয়, শ্রমিকদের যেন টিকিট দেওয়া না হয়। টিকিট না পেয়ে শ্রমিকরা হাঁটতে শুরু করে। যখন কালৌরাতে পৌঁছায় তখন দুই শত শ্রমিককে পুলিশ আটকে রাখে।
এদিকে গোয়ালন্দে কয়েক হাজার শ্রমিক জমা হয়েছিল। সেখানে মহাত্মা গান্ধীর দলের লোকদের সঙ্গে রেলের লোকের ঝগড়া হলে তারা বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের টিকিট দেয়। শ্রমিকরা গোয়ালন্দ থেকে ফরিদপুর স্টেশনে পৌঁছলে সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেট ট্রেন থেকে সব শ্রমিককে নামিয়ে নেয়। সারারাত তাদেরকে পুলিশের হেফাজতে রেখে সকালে তাদেরকে পথে বের করে দিলে তারা হাঁটতে থাকে এবং এর তিন মাইল দূরে কংগ্রেসের লোকজন তাদেরকে খাবার দেয় এবং কোকসা থেকে তাদেরকে ট্রেনে তুলে দেবে বলে সঙ্গে থাকে। ওই সময় সাহেবরা শ্রমিকদেরকে পুলিশ দিয়ে তাড়িয়ে বেলগাছিতে নিয়ে যায়। সেখানকার লোকেরা তাদেরকে সেদিনের মতো খেতে দেয়। তবে সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেট বলে, তারা ট্রেনে উঠতে পারবে না। শহরের লোকেরা বলে, তারা সকলে মিলে তাদের টিকিটের দাম দেবে। কোনো কারণে ম্যাজিস্ট্রেট নমনীয় হয় এবং তাদেরকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দেয়। পথে বহু শ্রমিক কলেরায় মারা যায়।
যখন তারা করিমগঞ্জে পৌঁছে তখন সরকার থেকে জানানো হয়, তাদেরকে দৈনিক এক আনা মজুরি দেওয়া হবে। তবুও তারা ফেরে না। সেদিন প্রচণ্ড রোদ উঠেছিল। শ্রমিকরা সেই রোদে অসুস্থ হয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়ে। এরপর তারা হেঁটে চাঁদপুরে এসে দেখে সাহেবদের লোক চাঁদপুরের ঘাট থেকে তক্তা সরিয়ে নিয়েছে। যদিও তারা ঠিক করেছিল যেভাবেই হোক তারা জাহাজে উঠবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জাহাজে উঠতে পারে না এবং নদীতে পড়ে যায়। যারা সাঁতার জানত না তারা নদীতে ডুবে মারা যায়। ওই সময় মহাত্মা গান্ধীর একজন পাদরি বন্ধু শ্রমিকদের সাহায্য করার জন্য সরকারের লোকদের কাছে যান এবং কিছু করতে না পেরে ফিরে আসেন। এরপরও তিন হাজার শ্রমিক চাঁদপুরের ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু উঠতে পারে না। ক্লান্ত শরীরে রাতে যখন তারা প্ল্যাটফর্মে ঘুমিয়ে পড়ে, তখন সরকারি সৈন্যরা তাদেরকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারে। একজন শ্রমিক অসুস্থ ছিল। ওই সময় সে তার কোলের বাচ্চা নিয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে টিকিট ঘরের তারের বেড়ায় আটকা পড়লে সেই অবস্থায় সৈনরা এসে তাকে মারে। সে চিৎকার করলে শহরের লোকেরা লণ্ঠন হাতে এসে দেখে, ততক্ষণে অনেকে মারা গেছে। তাদের রক্তাক্ত দেহ পড়ে রয়েছে মাটিতে।
এ ঘটনা কী প্রমাণ করে? কী বার্তা পাই আমরা এখান থেকে? কাহিনিটি বলছিল প্রায় সত্তরোর্ধ্ব চা শ্রমিক কালাকান্ত পট্টনায়ক। এ প্রশ্ন শুনে কী বলবে ভেবে পায় না তার সামনে গোল হয়ে বসে থাকা হাড় জিরজিরে জীর্ণ-শীর্ণ শরীরের ছোটখাটো মানুষগুলো। তাদের চোখের জল গাল বেয়ে মাটিতে পড়ে এবং তারা নিঃশব্দে চেয়ে থাকে একে অপরের দিকে। কালাকান্ত বলে, “আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন অসম সাহসী, সৎ আর পরিশ্রমী। পাহাড় ও সমতলের জঙ্গল পরিষ্কার করে চা গাছ লাগিয়েছেন। সেই গাছকে দেবতার মতো পুজো করে পরিচর্যা করেছেন। কিন্তু পরিণামে তারা কী পেয়েছেন? আমরা কী পাচ্ছি? মাসে দু-এক দিন মাছ-মাংসও খেতে পাই না। রোগ হলে চিকিৎসা পাই না। শিক্ষার ভালো ব্যবস্থা নেই। একটি ঘরেই হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগলের সঙ্গে আট-দশজন ঘুমাই।”
আজকের কালাকান্তর মতো বহু কালাকান্তর দেখা পাওয়া যায় ভারতীয় লেখক মুলকরাজ আনন্দের লেখা ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ বইটিতে। আসামের চা শ্রমিকদের নিয়ে তিনি বইটি লিখেছেন। ১৯৩৭ সালে ইংল্যান্ড থেকে সেটি প্রথম প্রকাশ হলে সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে তা নিষিদ্ধ করা হয়। এর সাত বছর পর বইটি ভারত থেকে প্রকাশ হলে অনেক প্রশংসিত হয়।
ওই বইয়ের ১৫২ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে, “গত সত্তর বছরের মধ্যে ভারতবর্ষের এই কুলিদের (শ্রমিক) পারিশ্রমিকের হার বদলায়নি। ১৮৭০ সালে একজন কুলির আয় ছিল মাসে পাঁচ টাকা। ১৯২২ আসামের চা বাগানের একজন কুলির সবচেয়ে বেশি আয় মাসে সাত টাকার বেশি হবে না। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্যে কুলিদের একমাত্র খাদ্য চাল- তার দাম দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। একজন কুলি যা রোজগার করে তার সবটাই খরচ হয়ে যায় চাল কিনতে।”
এখনো চা বাগানের শ্রমিকদের অবস্থা একই রকম- বলছেন সংশ্লিষ্টজনরা। সম্প্রতি চা শ্রমিকরা তাদের দৈনিক মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ১৮ দিন ধরে ধর্মঘট করেন এবং অনেকে অসুস্থ হন, মার খান এবং কেউ কেউ এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ঘটনায় মালিকপক্ষ তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকার পরিবর্তে ১৪৫ টাকা করলে শ্রমিকরা সন্তুষ্ট না থাকায় তারা তাদের ধর্মঘট চালিয়ে যান এবং প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ১৩ জন চা বাগানের মালিকের সঙ্গে বৈঠক করে আরও ২৫ টাকা বাড়িয়ে তা ১৭০ টাকা করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, দৈনিক মজুরি কি চা শ্রমিকদের একমাত্র ইস্যু? তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন? শ্রমিকরা বলছেন, ‘না।’
তারা বলছেন, “আমরা দুইশ বছর ধরে চা বাগানগুলোতে বংশ পরম্পরায় কাজ করলেও যে জমিতে বাস করছি শুনছি, সেই জমি আমাদের নয়। আমাদের জন্য নামমাত্র চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও আমরা বাইরে থেকে চিকিৎসা করাই বা বিনা চিকিৎসায় মারা যাই। আমাদের রয়েছে খাবার পানির সমস্যা। স্যানিটেশন, ঝুঁকিভাতা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ নানা ধরনের সমস্যা।” যদিও বলা হয়েছে, প্লাকিং বোনাস, বার্ষিক ছুটি ভাতা, বেতনসহ উৎসব ছুটি, অসুস্থতাজনিত ছুটি আনুপাতিক হারে বাড়বে। এছাড়া চিকিৎসা-সুবিধা, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের পেনশন, পোষ্যদের শিক্ষা বাবদ ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য ব্যয়- সবকিছু মিলিয়ে দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকার মতো পাবে। কিন্তু শ্রমিকরা নিশ্চিতভাবে বলছেন, “আমরা যে সুবিধা পাই তাতে এত টাকা হবে না। এগুলো আগে থেকেই লেখা রয়েছে। কিন্তু এ সব সুযোগ-সুবিধা আমরা খুব কমই পেয়ে থাকি।” বিষয়গুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সত্যতা যাচাই করার জন্য বিস্তর সময় প্রয়োজন। যেভাবে বাগান মালিকরা চা বাগানের জমি সরকারের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে লিজ নিয়ে প্রচুর লাভবান হচ্ছেন, সেভাবেই শ্রমিকদের এসব বিষয়কে মূল্যহীন গণ্য করেন।
জিনিসপত্রের দাম অনুযায়ী শ্রমিকদের মজুরিতে এখনো ভারসাম্য আসেনি। আবার কত দিন পর তাদের মজুরি বাড়ানো হবে সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়নি। সবকিছু পরিষ্কার করে লিখিত নিয়ম থাকা প্রয়োজন। যাতে মালিকপক্ষ এবং শ্রমিকপক্ষের মাঝে কোনো ক্ষোভ বা অসন্তোষ না থাকে এবং বিষয়টি এখনই নির্ধারণ ও নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। যদি বিষয়টি ভোট কেনার জন্য করা হয়ে থাকে তাহলে শ্রমিকরা আবারও ফুঁসে উঠবেন। তবে তা যেন আর কোনো নেতিবাচক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী না হয় এ বিষয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। কেননা আজকের এই ডিজিটাল যুগে এবং দেশে যে উন্নয়নের ধারা চলছে সেই ধারাবাহিকতায় শ্রমিকদের ঠকানোর এ ধরনের প্রয়াস এবং এই অসম বণ্টন যেমন অমানবিক তেমনি চরম লজ্জার। এ দায় শুধু চা বাগান মালিকদের নয়, এটি সমানভাবে সরকারেরও। কেননা সরকারি জমি পক্ষান্তরে জনগণের সম্পত্তি। চা শ্রমিকরা এখন এ দেশের নাগরিক। শ্রমিক হিসেবে সব কিছু নিয়ম অনুযায়ী পাওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে। যা বাস্তবায়নে সরকারের দায়বদ্ধতা রয়েছে।
আরেকটি কথা, দেশে উৎপাদিত কোনো পণ্য বিদেশে পাঠাতে গেলে তারা যে কর্ম পরিবেশ বা কমপ্লায়েন্সের কথা বলে চা বাগানের ক্ষেত্রে সে রকম কোনো নিয়ম নেই কেন? এ ধরনের নিযম থাকলে চা শ্রমিকদের বঞ্চনা এবং নিপীড়ন অনেক কমে যাবে। তাহলে কালাকান্তর প্রশ্নগুলো আর ভেসে বেড়াবে না চা বাগানের পাতায় পাতায়।
শানু মোস্তাফিজ
লেখক ও গবেষক