স্থিতিশীল হচ্ছে না ডলারের বাজার

অরুন্ধতী বসু

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৩০ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

মার্কিন ডলারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় নাভিশ্বাস বিশ্বের। এই মুদ্রার বিপরীতে সম্প্রতি জাপানি ইয়েন ও ইউরোর মান দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে।  ২০২০ সালের মার্চ, করোনা ভাইরাস মহামারির প্রথম ঢেউ চলছে। সেই সময় ডলারের সূচক রেখাচিত্রের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছায়। এখন ডলারের মান সে উচ্চতায় না পৌঁছলেও কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মার্কিন ডলারের বাজার এক রকম স্থিতিশীল ছিল বলা যায়।   

চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির হার সম্প্রতি রেকর্ড করেছে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পর সবচেয়ে দুর্বল ট্রেড ব্যালেন্স মাথাব্যথার উদ্রেক করেছে দেশটির নীতিনির্ধারকদের। তা সত্ত্বেও মার্কিন ডলারের দাপট বেড়েই চলেছে। কেনেথ রগফ প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে লেখা এক নিবন্ধে বলছেন, এর কারণ ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে চারটি বিষয় বিশ্বের প্রধান মুদ্রার গতিবিধিকে প্রভাবিত করছে বলে মনে করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক্স অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের এই অধ্যাপক।

তিনি বলছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সুদহার বাড়াতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডরেল রিজার্ভ  (ফেড)। সেই সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে মার্কিন অর্থনীতি মন্দার কাছাকাছিও নেই। তাই এখনো দেশটির অর্থনৈতিক নীতিমালা কঠোর করার জায়গা রয়েছে। ইউরোপও সমানভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে। ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) এ বিষয়ে আরও সতর্র্কতা অবলম্বন করছে। এর আংশিক কারণ ইউরো অঞ্চলের জন্য অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরও দুর্বল। ইতালির ঋণের বিশাল বোঝা নিয়ে উদ্বিগ্ন ইসিবি। তবে ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটাও বিশ্বাস করে, জ্বালানি মূল্য সংক্রান্ত বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার অব্যাহত থাকবে না। চীনের মতো জাপান এখনো মূল্যস্ফীতির উচ্চ হারের কবলে পড়েনি। অদূর ভবিষ্যতে নীতিমালা কঠোর করার সম্ভাবনা নেই জাপানি কেন্দ্রীয় ব্যাংক অব জাপানের। গত মাসে সুদহার কমিয়েছে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়না। 

ডলারের শক্তিধর হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে ভূরাজনৈতিক কারণও। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বেশি তাৎক্ষণিক ঝুঁকিতে আছে ইউরোপ। অন্যদিকে চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্বে ঝুঁকির মুখে প্রতিবেশী জাপান। মন্দা হোক বা না হোক, ইউরোপ এবং জাপান উভয়কেই দীর্ঘমেয়াদি সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে পুনর্গঠন করতে হবে। তারপর চীনে চলমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি, যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি প্রভাবিত করে ইউরোপ ও জাপানের অর্থনীতিকে। চীনের ক্ষয়িষ্ণু প্রবৃদ্ধির মূল কারণ- জিরো-কোভিড নীতি সংক্রান্ত লকডাউন, নির্মাণ খাতে পরম্পরা, প্রযুক্তি খাতে ধস এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণসহ বেশ কিছু বিষয়। এগুলোয় কোনো টেকসই পরিবর্তন হওয়ার আভাস মিলছে না। সবশেষ, জ্বালানির দাম। সবরকম জ্বালানি পণ্যের দাম এখনো অনেক বেশি। প্রকৃত অর্র্থে যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু  ইউরোপ এবং জাপান এ পণ্যের বড় আমদানিকারক হিসেবে ডলারের উপকার করছে। 

কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, ইউরোপ ও জাপানের তুলনায় নিরাপদ আশ্রয়স্থল যুক্তরাষ্ট্র। তারা একটি শীতল গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত থাকা সত্ত্বেও এটা সত্যি হতে পারে। আর এ যুদ্ধ ততক্ষণ শেষ হবে না যতক্ষণ এতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতি রয়েছে।

অন্যদিকে ইউরো অঞ্চলে যখনই কোনো সংকট দেখা দেয়, তখন তা কাটিয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিশ্বজুড়ে প্রকৃত সুদহার বাড়তে শুরু করলে এ অঞ্চলকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। ৭০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পথে জার্মানির মূল্যস্ফীতি। ইসিবির সুদহার বৃদ্ধিতে ঋণের বোঝা আরও বাড়তে পারে ইতালির সরকারের ওপর। মার্কিন ডলারের বর্তমান শক্তিশালী অবস্থান প্রভাব ফেলছে গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। কারণ বিশ্ব বাণিজ্যের একটি বড় অংশ, বলা যায় অর্ধেকই হয় ডলারে। আর অনেক দেশের আমদানি ও রপ্তানির দুই ক্ষেত্রেই রয়েছে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশটির মুদ্রার দাপট। যেমন- ডলারের ঊর্ধ্বগতিতে বিশ্বের অনেক জায়গায় আমদানি কমে যায়। তাই বৈশ্বিক বাণিজ্যে পরিসংখ্যানগতভাবে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা।

অন্যভাবেও উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির উপর বিশেষভাবে প্রভাব ফেলতে পারে ডলারের শক্তিশালী অবস্থান। কারণ উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির এই দেশগুলোর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ঋণ নিতে পারে শুধু ডলারে। এবং উচ্চ মার্কিন সুদহার দুর্বল ঋণগ্রহীতাদের সুদহারকে অসামঞ্জস্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে, অনেক উদীয়মান অর্থনীতির দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশি মুদ্রার উপর নিম্নমুখী চাপ রোধ করতে সক্রিয়ভাবে সুদহার না বাড়ালে আরও বেড়ে যেত ডলার সূচক। তবে এই ধরনের কঠোরতা অবশ্যই তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যেসব বড় উদীয়মান বাজারগুলো এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ সুদহার এবং শক্তিশালী ডলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছে, তা তাদের একটি বিশাল প্রাপ্তি। কিন্তু ফেড এমন আক্রমণাত্মক কড়াকড়ির পথ অনুসরণ করলে তারা কত দিন চলতি হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে তা দেখার বিষয়, বলছেন কেনেথ রগফ। বিশেষ করে পণ্যের দরপতন অব্যাহত থাকলে এবং চীনা অর্থনীতির শ্লথগতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মন্দার কবলে পড়লে উদীয়মান অর্থনীতির বর্তমান পদক্ষেপ কাজ নাও করতে পারে।

মার্কিন বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই সম্পন্ন হয় ডলারে। তাই স্বল্প মেয়াদে ডলারের শক্তিশালী অবস্থানে বাণিজ্য অংশীদারদের তুলনায় কম প্রভাবিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। কিন্তু ক্রমাগত শক্তিশালী ডলার দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় বাজারে  প্রভাব ফেলবে। কারণ ডলারের শক্তিশালী অবস্থানে অপেক্ষাকৃত বেশি ব্যয়বহুল স্থানে পরিণত হবে যুক্তরাষ্ট্র। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্যান্য প্রধান মুদ্রার বিপরীতে ডলারের সাম্প্রতিক উত্থানের কি সমাপ্তি ঘটতে পারে। আশির দশকের মাঝামাঝি এবং একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ডলারের দাম অতিরিক্ত বৃদ্ধির পর তীব্র পতন হয়।

কিন্তু রগফের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এখনই কোনো পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন।  ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আরও খারাপের দিকে মোড় নিলে মার্কিন মুদ্রার বিপরীতে ইউরো এবং ইয়েনের আরও ১৫ শতাংশ পতন সম্পূর্ণভাবে সম্ভব। এ মুহূর্তে শুধু একটি বিষয়ই নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে তা হলো, ২০১৪ সালে শুরু হওয়া অসাধারণ স্থিতিশীল মুদ্রা বিনিময় হারের বাজার এখন ইতিহাস।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh