জাহিদ সোহাগ
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৩:৫৩ পিএম
প্রতীকী ছবি
হোমিওপ্যাথ ও অন্যান্য
মেলায় ঢুকে সে বুঝল, কপালের ওপর রোদ তেতে আছে; মানে পশ্চিমে হেলে পড়া সেই জ্বলন্ত চুল্লি; যেন সন্ধ্যার আগেই তার এক পৃথিবী ভাত রেঁধে ফেলা দরকার, তাই জ্বলছে নিজেরই রক্ত খেয়ে।
এমন তেরছা তাতানো রোদে কপালের দুপাশের শিরায় তীব্র ব্যথা এসে যেন ব্লেড দিয়ে চিরে চিরে দেয়; তখন সে দৃষ্টিভ্রমের মতো দেখতে পায় হ্যানিম্যানের মেটেরিয়া মেডিকা হাতে তার ছাত্ররা হেঁটে বেড়াচ্ছে; তাদের থেকে কেউ একজন পৃষ্ঠা উল্টে বলে দেবে, মাইগ্রেন; Natrum Mur, সঙ্গে Apis Mel লেজ হিসেবে জুড়েও দিতে পারে; সঙ্গে গোটা দশেক প্রশ্নের অনুমান-নির্ভর উত্তর সে দিতেও পারে, নাও দিতে পারে; এই ছাত্রদের দেখলে তার মনে পড়ে অধীর কুণ্ডুর ছেঁড়া কাঁথা-কুথুরির মতো বইটা, তেলচিটে হিন্দু; বেঢপ সুন্দরী বউ নিয়ে ভিটায় লণ্ঠন জ্বেলে যে পালিয়েছিল ভারতে; এর আগে হোমিওপ্যাথ দিয়ে সামাল দিতে না পারা বহুমূত্র বাধিয়ে নিয়েছিল।
সে নিজেও প্রায় হোমিওপ্যাথি করতে বসেছিল; সর্দার জিল্লুর বাজারের পুকুরে এক ড্রাম [আউন্স] বেলেডোনা ঢেলে তাকে বলেছিল, দেখিস আর কারো জ্বরজারি হবে না।
সে আশ্চর্য হয়ে বলেছিল, পুরা একটা পুকুর জ্বরের ওষুধ হয়ে গেল!
সর্দার তাকে বুঝিয়েছিল, এটা হলো মেমোরি অব মেডিসিন তত্ত্ব; এই পানির ভিতর মেডিসিনের স্মৃতি আজীবন রয়ে যাবে।
সর্দারের এই যুক্তি খারিজ করতে যথেষ্ট উদ্ভট যুক্তির দরকার, তারচেয়ে মেনে নিয়ে সে মনে মনে, ডিএইচএমএস পাস করার পর বঙ্গোপসাগরে ডাক্তার ফারুকের আলমারিসুদ্ধ ঢেলে দেয়ার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু কপাল মন্দ, অধীর কুণ্ডু এবং তার সাগরেদ বিমল কুণ্ডু ইন্ডিয়ায় গায়েব; এর মধ্যে অধীর চিতায় ভস্ম হয়েছে; সর্দারের কথায় তার আস্থা কমেছিল আগেই : সর্বহারা পার্টি থেকে হাত ধুয়ে সে এক পীরের মুরিদ হয়েছিল, পীর তাকে বলেছে, তুই হোমিওপ্যাথি কর।
সর্দার অস্ফুট স্বরে বলেছিল, আমি তো ম্যাট্রিক পাসও... কথা শেষ না হতেই পির হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, যা, যা, হবে।
সেই থেকে এই পীরই তার একই সঙ্গে খোদা ও রাসুল; যার ছবি দিয়ে তার চেম্বার মুড়ে দিয়েছে। সর্দার ভেবেছিল সে এই কালাইমারায় তার সত্যিকারের সাগরেদ; তাকেই কেবল ফিসফিস করে বলতে পারত, মানুষ যদি খোদারে চিনত তবে তার লুঙ্গি টেনে খুলে ফেলত।
এমন বিশ্বাস তখনো তার জন্য নয়।
সর্দার একদিন খুনের মামলায় জেল খেটে ক্যানসারে মরে এসেছে বাড়িতে; যদিও সে ওয়াদা করেছিল তার পীরের সঙ্গে দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়বে।
হোমিওপ্যাথি সংক্রান্ত এইসব স্মৃতি বইমেলার রোদ পেরিয়ে কাগজ প্রকাশনের স্টলে ঢুকে দেয়ালের অরেঞ্জ রঙে তার বমি-বমি অস্থিরতা পেতে শুরু করলে সে জামার নিচ থেকে উলের পাতলা সোয়েটার খুলে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ইব্রাহিমকে বলে, কী? বিক্রি কেমন?
ইব্রাহিম নিচের ঠোঁট উল্টে কথার খরচ বাঁচায়।
সে বাইরে দাঁড়িয়ে মিটার দিয়ে রোদ মাপে; এমন রোদে কেমন ভিডিও হবে ভাবতে ভাবতে তার চোখ যায় তীব্র স্কাই শাড়িতে, গগলস সত্ত্বেও কপালে হাত রেখে রোদ চাপা দিয়ে প্রায় ক্যাটওয়াকের মতো হেঁটে হেঁটে আসতে থাকা মেহবুবার দিকে; সে দুহাত প্রসারিত করে যেমন সমুদ্রের সামনে গেলে; একটা দুটো বই কিনে ছবি তুলতে তুলতে সে তার স্পর্শ পেয়ে প্রেম ও বিরহের যুগপৎ ছোবলে আক্রান্ত হয় আর মেহবুবা উড়ন্ত চুমু ছড়াতে ছড়াতে চলে যায়; আর তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে তার কপালের ওপর সূর্য বর্শা দিয়ে খোঁচাতে থাকে, আর ব্যথাটা কপালের হাড়ের ভেতর তীব্র তীব্র ডিম পাড়তে শুরু করলে সে একটা প্যারাসিটামল দাঁতে চেপে রেখে মেসেঞ্জারে লেখে তার বুক কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে।
মুরগি
নিজের মাগটাকে তারের মতো সোজা করেছে আর মুরগি কিনা ভদ্রলোকের মতো খোঁপে ঢুকবে না?
প্রত্যেক সন্ধ্যায় এই আধা-পাখিগুলো এই গাছে বসে তো ওই বেড়ায় বসে, আর সে হিশ্ হিশ্ করে, আয় তি তি তি তি বলে কাছে ভেড়ায় তো একটা দুইটা মোরগ বাক্ দিয়ে আরেকটার পিঠে ওঠে। মুরগিগুলো মোরগ দুটোকে ঘিরেই দৌড়ায় উঠানময়।
তার মেজাজ চটে যায়। বড় লাঠি দিয়ে পেটানোর চেষ্টা করে আর মুহূর্তেই মোরগ-মুরগির ডাকাডাকিতে সে নিজেই হয়ে যায় বিদিশা।
মাগটা বারান্দায় বিড়ি টানে আর পিচ্ পিচ্ থুতু ফেলে। বলে, ‘বেইচ্যা দেও।’
দপ্ করে তার মাথায় আগুন জ্বলে। শুয়ারের বাচ্চা, মুরগা কেনতে পারোস? না আণ্ডা কেনতে পারোস? বলতে গিয়েও সে না বলে কথাটা গিলে ফেলে। মাগটাকে কালই ধরে এনেছে জুয়ার আস্তানা থেকে। কিছু বললে এখনই ফুড়ুৎ দেবে। তারচেয়ে সে মাগটাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে।
মুরগির সঙ্গে না পেরে সে ঘুঁটে আনতে মাঠে যায়। এরই মধ্যে আকাশে গুড়ুম-গাড়ুম। বৃষ্টি। অন্ধকার চিরে নামা সাপের জিভের মতো বিদ্যুৎ হয়তো তার শরীরের ভেতর দিয়ে চলে যায় আরো অন্ধকারে।
লম্বা সুযোগ পেয়ে মাগটা জুয়ার কোর্টে বসে মোরগ-মুরগিগুলো নিয়ে, তার রক্তে উত্তেজনা লাফিয়ে ওঠে টাকাগুলোর কক্ কক্ করে ডেকে ওঠা দেখে।