রাহমান চৌধুরী
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০১:১৪ পিএম | আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:২৬ পিএম
রাহমান চৌধুরী। ফাইল ছবি
কিছুদিন ধরেই পোশাক নিয়ে বিতর্ক চলছে বাংলাদেশে। বিতর্কের দুটি পক্ষ রয়েছে। বিতর্কে এক পক্ষ বলছেন, পোশাকের প্রভাব রয়েছ মানুষকে প্রলুব্ধ করার। নিশ্চয় রয়েছে, না হলে নৃত্যশালার পোশাক ভিন্ন রকমের হবে কেন? মানুষের উপর প্রভাব সৃষ্টি করার ব্যাপারে পোশাকের বিরাট ভূমিকা থাকে। সেজন্য রাজা-বাদশাহ, পুরোহিতরা ভিন্ন ধরনের পোশাক পরিধান করে সাধারণ মানুষ থেকে। মধ্যযুগ পর্যন্ত রাজারা পরিধান করতেন জমকালো পোশাক।
অনেকে বলছেন, নারীর সংক্ষিপ্ত পোশাক পুরুষকে প্রলুব্ধ করে। কথাটা হলো শুধু পোশাক কেন, প্রতিটি বস্তু এবং প্রতিটি ঘটনাই মানুষের উপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ বিশেষ খাবারের দোকানে পোড়ানো মাংস ঝুলিয়ে রাখা হয়, খাদ্য-রসিককে প্রলুব্ধ করার জন্যই। কথাটা মিথ্যা নয়, বহু মানুষ বা শিশুরা তার দ্বারা প্রলুব্ধ হয়। কিন্তু যিনি নিরামিষভোজী, তিনি কি প্রলুব্ধ হবেন খাবারের দোকানে ঝুলানো মাংস দেখে? প্রশ্নই ওঠে না। বরং নিরামিষভোজীর ক্ষেত্রে তার ফল বিপরীত হতে পারে। কথাটা হলো, প্রলুব্ধ হওয়ার মতো অভিজ্ঞতা বা মানসিকতা নিয়ে বড় না হলে, নারীর সংক্ষিপ্ত পোশাক কাউকে প্রলুব্ধ করতে পারে না।
সেই আশির দশকের শুরুতে যখন আমরা চলচ্চিত্রের উপর সংক্ষিপ্ত একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলাম, তখন দীর্ঘ একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হয়েছিল। প্রামাণ্য চিত্রটি ছিল বাইরের একটি নৃগোষ্ঠীর জীবন যাপন, শরীরে তাদের পোশাক বলে কিছুই ছিল না। কিন্তু সকলেই তারা নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই। সম্পূর্ণ উলঙ্গ মা সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশুকে কোলে নিয়ে তার স্বামী আর অন্য পুত্র-কন্যাদের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। চারপাশের প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন সবাই সেখানে উলঙ্গ। পুরো একটা জনগোষ্ঠী যে উলঙ্গ সে ধারণাটা আমাদের, কিন্তু তাদের এ বোধটুকুও নেই যে তারা উলঙ্গ। কারণ বছরের পর বছর তারা এভাবেই জীবন যাপন করে আসছেন, নিজেরা কখনো তার মধ্যে সামান্য অসঙ্গতি খুঁজে পাননি। দূরে বসে আমরা ভাবতে পারি তারা অসভ্য। তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। ভারতের আন্দামানে এমন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এখনো আছে বলে জানা যায়।
সভ্যতার আদিম যুগে মানুষ উলঙ্গই ছিল, কিন্তু তখন ধর্ষণ বলে কোনো শব্দ চালু ছিল না। যখন মানুষ সভ্য হয়েছে, বহুরকম নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, নানারকম অহংকার দানা বাঁধছে মানুষের জীবনে, মানুষ যখন তার শরীরে পোশাক চাপিয়েছে- বাস্তবিকভাবে নারীরা তখন থেকেই ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। প্রায় প্রতিদিন ধর্ষণ কথাটার সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটছে। ধর্ষণের সঙ্গে মূল সম্পর্কটা আসলে পোশাকের নয়, ক্ষমতার। ক্ষমতা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তার অপব্যবহার হয়। যদি প্রাচীন যুগের নানাধরনের উপকথা বা সাহিত্য বিচার করা যায়, সেখানে দেখা যাবে নানাভাবে ক্ষমতাবান দেবতাদের ধর্ষণের শিকার হচ্ছে দেবী বা মানবীরা। যদি ইতিহাস অনুসন্ধান করা যায়, দেখা যাবে যুদ্ধের মাঠেই ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা গেছে। শুধু নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নারীরাই সেখানে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন তো নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কী ঘটেছিল? যারা নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তারা কি অর্ধনগ্ন হয়ে বসেছিলেন? নাকি ক্ষমতা আর অস্ত্রের দৌরাত্ম্যে ঘটেছে ঘটনাগুলো?
নুসরাত নামে এক মাদ্রাসার ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল মাদ্রাসার এক শিক্ষকের দ্বারা, পোশাকের সেখানে কি অপরাধ ছিল? নুসরাত কি সংক্ষিপ্ত পোশাক পরেছিল? পাশ্চাত্যে বিকিনি পরিধান করে সমূদ্র সৈকতে নারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে কি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে? সংক্ষিপ্ত পোশাক যদি ধর্ষণের কারণ হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ সেখানে ঘটার কথা। বাস্তবে কী ঘটছে? ধর্ষণের ঘটনা সেখানেই ঘটতে দেখা যায় যেখানে রাষ্ট্র এবং প্রশাসন সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সিলেটে ছাত্র নামধারী কিছু পেশিশক্তি যখন স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে, সেই নারী কি অর্ধনগ্ন ছিল? ভিন্নদিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে তালিবানদের দিকে। যতরকম অভিযোগ থাক তাদের বিরুদ্ধে, ধর্ষণের সামান্য অভিযোগ নেই। কারণ সেরকম শিক্ষার বিপরীত শিক্ষাই তারা পেয়েছিল। তালিবান নেতৃত্ব ধর্ষণকে দেখেছে বিরাট অপরাধ হিসেবে। কর্তৃপক্ষের ধর্ষণের পক্ষে মদদ ছিল না, মদদ না থাকলে খুব বেশি এসব ঘটতে পারে না।
বাংলাদেশে হঠাৎ কিছুদিন ধরে পোশাক পরিধান নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলো খুবই অবান্তর। নতুন একটা বিতর্ক তোলা হয়েছে জল ঘোলা করার জন্য। মানুষ কী খাবে, কী পরিধান করবে সেটা তার ব্যক্তিগত রুচি। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য শক্তি আফগানিস্তানের মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত বোরকা তুলে দিতে চায়, তখন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছে তেমন এক চৌকস আফগান তরুণী যুক্তরাষ্ট্রের এক সেমিনারে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আফগান নারীরা বোরকা পরিধান করবে কি করবে না, সে সিদ্ধান্ত নেবে আফগান নারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের বা বাইরের কারোরই এতে নাক গলাবার কিছু নেই। পাশ্চাত্য যেমন বোরকাকে মনে করে পশ্চাৎপদতা, আফগানিস্তানের মানুষ তেমনি পাশ্চাত্যের বিকিনি পরিধানকে পছন্দ করে না। কিন্তু আফগানিস্তানের সরকার কি পাশ্চাত্যের এসব ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছে? প্রশ্নটা সেখানেই, যার যা ব্যক্তিগত অভিরুচি। কাউকে বাধ্য করবার কিছু নেই। সারা বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নানারকম পোশাক পরিধানের রেওয়াজ রয়েছে, সেগুলোকে কি কারও একক বা গোষ্ঠীগত ইচ্ছায় নিষিদ্ধ করে, সবার শরীরে একই রকম ‘ইউনিফর্ম’ পরিয়ে দিতে হবে?
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে পোশাক প্রশ্নে প্রগতিশীল নামধারীরা পর্যন্ত বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে থাকেন। মুসলমানরা ইদানীং ব্যাপকভাবে যে হিজাব পরিধান করে থাকে সেটাও তাদের চোখে সমালোচনার বস্তু। হিজাব মানে মাথা ঢাকার জন্য একটুকরো কাপড়। নারীর মাথার চুল কাঁধ গলা ঢেকে রাখার সংস্কৃতি অনেক দিনের। পাশ্চাত্যের নারীরা যখন বড় বড় ফ্রক পরিধান করতেন তখনো তারা মাথায় একটা গলবস্ত্র বা স্কার্ফ বাঁধতেন। ব্রিটেনের প্রয়াত নারীর মাথায় এরকম স্কার্ফ বাঁধা অনেক ছবি দেখতে পাওয়া যাবে। মাথা ঢাকবার সংস্কৃতিটা শুধু মুসলমানদের নয়, সকল ধর্মেরই। খ্রিষ্টান নানরা বা সেবিকারা মাথা ঢেকে রাখেন। সেক্ষেত্রে লক্ষ করা যেতে পারে মাদার তেরেসার পোশাক। মুসলমানদের মধ্যে অনেক ধার্মিক লম্বা পোশাক পরিধান করার জন্য ব্যঙ্গ-উপহাসের শিকার হন। কিন্তু ভুলে যান খ্রিষ্টান পাদরিা লম্বা একটা আলখাল্লা পরিধান করে থাকেন। লম্বা আলখাল্লা পরিধান করতেন মধ্যযুগের পাশ্চাত্যের রাজা বাদশাহরাসহ অভিজাতরা। মুসলমানদের ক্ষেত্রে তাহলে সে ক্ষেত্রে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হবে কেন?
মরুভূমির মানুষদের মধ্যে লম্বা কুর্তা আর পাগড়ি পরিধান করার সংস্কৃতি ইসলামের আবির্ভাবের আগেই। ফলে এটাকে ইসলামি পোশাক ভাবার সামান্য কারণ নেই। মানুষের পোশাক পরিধান করার প্রথম সংস্কৃতি চালু হয়েছে স্থানীয় ভৌগোলিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। কারও পোশাক নিয়ে হাস্যরস করাটা তাই ভব্যতার লক্ষণ হতে পারে না। মুসলমানদের মধ্যে হিজাবের বাড়াবাড়ি আরম্ভ হয়েছে, বুশ যখন ওয়ান-ইলেভেনকে কেন্দ্র করে ক্রুসেড ঘোষণা করেছিল আর মুসলিম জগতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করতে আরম্ভ করে। যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানরা অনেকেই তখন নিজের স্বাতন্ত্র্য ধারণ করার জন্য হিজাবের আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই হিজারের অনুকরণ চলছে এখন বাংলাদেশে। মাত্র দু-দশকের কথা।
বাংলাদেশের আদালতে আইনজীবীরা গরমের দিনেও যে একটা কালো কোট গায়ে দেন, দুশ বছরের বেশি সময় ধরে সেটাও ব্রিটিশ শাসকদের একধরনের অনুকরণ। বিচারব্যবস্থা বা আইনের তাতে উনিশ-বিশ কিছু আসে যায় না। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন মানুষ শাসকদের দিয়ে যাওয়া বিভিন্ন পোশাক অনুসরণ বা অনুকরণ করে চলেছেন। সারা বিশ্বেই তা ঘটছে। বুদ্ধের অনুসারী ভিক্ষুরা এখনো অনেকে পরিধান করেন গেরুয়া, তা একইভাবে অনুসরণ করেন অনেক হিন্দুও। ধর্মীয় পোশাক পরিধান বা অনুসরণ করা নিয়ে খ্রিষ্টান, হিন্দু, ইহুদি আর অন্যদের সমালোচনা করা না হলেও- সমালোচনা হতে থাকে মুসলমানদের। ব্যাপারটা খুব একপেশে আর অন্যায়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সেই অন্যায়ের ফলেই মুসলমানরা নিজেদের পোশাকের সম্ভ্রম রক্ষায় আরও কট্টর হয়ে উঠেছে।
মূলত তাতে মুসলমানদের বৃহত্তর লাভের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। বিভিন্ন ঘটনা বা তাদের উপর আক্রমণের কারণেই বহু মুসলমানের কাছে পোশাক একটা গোঁড়ামির পর্যায়ে চলে গেছে। সত্যি বলতে ইসলামের নবীকে পোশাকের ক্ষেত্রে অনুসরণ করাটা আবশ্যক বা ফরজ নয়, সুন্নত। চাইলে কেউ অনুসরণ নাও করতে পারেন।
যারা সংক্ষিপ্ত পোশাক পরা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আর নিজেদের ইচ্ছা জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছে তাদেরকে মনে রাখতে হবে, শক্তি প্রয়োগের প্রশ্ন উঠলে বিশ্বের চারদিকে বসবাসকারী অন্যরা অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। ধরা যাক, পাশ্চাত্য যদি মনে করে সেখানে বসবাসকারীরা চার্চের ইচ্ছার বাইরে ভিন্ন কোনো পোশাক পরিধান করতে পারবে না, তখন কী ঘটবে? সারা বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের মানুষ রয়েছে। যদি ইসলাম ধর্মের লোকরা পোশাকের ব্যাপারে নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে চায়, বাকি ধর্মের মানুষরা তাদের নিজের নিজের রাষ্ট্রে সেটা চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার রাখে।
স্মরণ রাখতে হবে, মতাদর্শগত লড়াই এক ধরনের ব্যাপার আর কারও ব্যক্তিগত রুচির উপরে আক্রমণ করা ভিন্ন প্রসঙ্গ। যারা গরুর মাংস খাবে তাদের যেমন গরুর মাংস খেতে বাধা দেওয়া যায় না, যারা শূকরের মাংস খাবে তাদেরকেও তা খেতে বাধা দেওয়া যায় না। যার যা ইচ্ছা খাবে, যার যা ইচ্ছা খাবে না। যার যা ইচ্ছা পরিধান করবে, যার যা ইচ্ছা পরিধান করবে না। যদি একপক্ষ কর্তৃত্ব করতে চায়, তাহলে অপর পক্ষও কর্তৃত্ব করতে চাইবে। তখন অহেতুক রক্তপাত ঘটবে।
বর্তমানে পোশাক নিয়ে শিক্ষক হিসেবে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বহু ছাত্রী হিজাব আর বোরকা পরিধান করে আসে। কয়েকজন এমনভাবে বোরকা পরিধান করে, যাদের চোখ দুটো ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। যখন তারা আমাকে সালাম দেয়, বুঝতেই পারি না যে তারা আমার ছাত্রী। সাধারণত আমি আমার সকল শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা হলে কথা বলি। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলা হয় না। কারণ তাদেরকে আমি চিনতে পারি না- শুধু চোখ দেখে ক্লাসের অনেক ছাত্রীকে কি মনে রাখা সম্ভব?
কয়েক দিন আগে দুজন ছাত্রী করিডোরে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করল, ‘স্যার, আপনি কিন্তু আমাদের এড়িয়ে যান।’ যখন বুঝলাম দুজনই আমার ছাত্রী, তখন বললাম শুধু চোখ দেখে কেমন করে চিনব আপনাদের। দুজনই হাসল। বলল, ‘ঠিক বলেছেন স্যার।’ তখন মনে পড়ল, ভারতের সন্ত্রাসী আন্দোলনের যুগে বহু বিপ্লবী বোরকা পরে নারী সেজে পুলিশের চোখে ধোঁকা দিয়ে পালিয়েছিল। ফলে বোরকা অনেক দিন ধরেই কিছুটা সন্দেহজনক পোশাক বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং মানুষের কাছেই। বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠানে তাই বোরকা পরা নিষিদ্ধ। নিশ্চয় সেটা ধর্মীয় কারণে নয়- বোরকা পরিধান করে মানুষকে বা প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করা যায় সে-কারণেই।
মনে রাখতে হবে বোরকা ইসলাম ধর্মের পোশাক নয়। নবীর সময়ে বোরকার খবর পাওয়া যাচ্ছে না। পর্দার বাড়াবাড়ি ইসলাম ধর্মে ছিল না। ইসলামে বলা হয়েছে মার্জিত রুচির কথা। নারীদের শালীনতার কথা। ইসলামে নবীর স্ত্রীসহ বহু নারীকে দেখা গেছে যুদ্ধ করতে। পর্দা আর বোরকা পালন করে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব না। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে দেখা যাচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যে পর্দার বাড়াবাড়িটা এসেছে মধ্যযুগের বাইজানটাইন সভ্যতা থেকে। নবীর প্রথম স্ত্রী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ফলে ইসলামে নারীদের ব্যবসা-বাণিজ্য আর চাকরি-বাকরি করার বাধা নেই।
ইসলামে নর ও নারীর জন্য শিক্ষালাভ আবশ্যক বা ফরজ করে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধর্মের ক্ষেত্রে যা ঘটে, ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। বহু রকম কট্টর ধ্যান ধারণা যুক্ত হয়েছে। ইসলাম ধর্মের মানুষ বহুভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে যুগের পর যুগ, শতকের পর শতক ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। চিন্তাভাবনার ভিতর নানারকম গোঁড়ামি ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষরাই একদা জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট বিরাট সব অবদান রেখেছিল। এরপর যেন পোশাকি ব্যাপারটা প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সত্যিকার অর্থে পোশাক মানুষের কোনো পরিচয় নির্ধারণ করে না। মানুষের মূল পরিচয় নির্ধারিত হয় তার কর্মদ্বারা। মনে রাখতে হবে, পোশাক মানুষকে বিভ্রান্ত করে। সম্মানিত পুরোহিতের পোশাক পরিধান করে মানুষ কুকর্মে অংশ নিতে পারে। মানুষের নিজেকে পাল্টাতে সময় লাগে, পোশাক পাল্টাতে না। মুখোশধারী মানুষের মতো, পোশাক একটা মুখোশ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশে এই যে বোরকার প্রচলন বাড়ছে দিন দিন; এর পেছনে ধর্মীয় কারণ নয়, দেশ বিদেশের বহু মুনাফার প্রশ্ন জড়িত। সম্ভবত আমরা শুধু ধর্মটাই দেখি, এর পেছনের মুনাফাটা দেখি না।
লেখক: শিক্ষক, সমাজ-গবেষক, নাট্যকার